ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গলছে এন্টার্কটিকা- ধেয়ে আসছে বিপর্যয়

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৪ আগস্ট ২০১৭

গলছে এন্টার্কটিকা- ধেয়ে আসছে বিপর্যয়

বরফ মোড়া এন্টার্কটিকা গলে যাচ্ছে। এর ফলে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে। যুগের পর যুগ ধরে এন্টার্কটিকায় তুষারপাত ঘটে বিশাল বিশাল বরফের গম্বুজ তৈরি হয়েছে যা দুই মাইলেরও বেশি পুরু। বেশিরভাগ গম্বুজ শত শত বছর ধরে নিরাপদেই ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক উড্ডয়নের কারণে বরফ জমাট এই মহাদেশের প্রান্ত ভাগগুলো ধসে পড়ছে। উপকূলীয় হিমবাহ ও ভাসমান আইস শেলফগুলো গলে যাচ্ছে। এন্টার্কটিকার বরফ গলার কারণে ২১০০ সাল নাগাদ সাগরের জলন্তর বেশ কয়েক ফুট বেড়ে উপকূলীয় অনেক নগরী গ্রাস করে নিতে পারে। এন্টার্কটিকার দুটি অংশÑ পূর্ব ও পশ্চিম। মাঝখানে পর্বতমালা। পশ্চিম এন্টার্কটিকার বরফের আস্তরণ আড়াই মাইল পুরু। এর আয়তনে টেক্সাসের দ্বিগুণ। এই বাঁকের চাদরের নিচে আছে বেশ কিছু দ্বীপ। তবে বেশিরভাগ বরফ আছে সাগর পৃষ্ঠের ৫ সহস্রাধিক ফুট নিচে একটি অববাহিকার বুকে। শুধু এই পশ্চিমাংশের বরফ গলে গেলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সাগরের জলন্তর ১০ ফুট বেড়ে যাবে এবং সারা বিশ্বের সাগর উপকূলগুলো তলিয়ে যাবে। পশ্চিম এন্টার্কটিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে সাগরমুখী বরফের প্রবাহ দ্রুততর হওয়ায় আইস শেলফগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং সেগুলোর পেছনের হিমবাহগুলোও গলছে। পাইন আইল্যান্ড আইস শেলফÑ যা কিনা বেশিরভাগ জায়গাজুড়ে প্রায় ১৩শ’ ফুট পুরু, এক্ষেত্রে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ১৯৯৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এটি গড়ে ১৫০ ফুট পাতলা হয়ে গেছে। কিন্তু এর চেয়েও উদ্বেগজনক অবস্থা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী সোসাইটেস গ্রেসিয়ারের। এই হিমবাহ ধসে পড়লে পশ্চিম এন্টার্কটিকার হরফের আস্তরণের বেশিরভাগের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। এগুলো হচ্ছে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে দ্রুত গলতে থাকা হিমবাহ। পশ্চিম এন্টার্কটিকা পূর্ব এন্টার্কটিকা থেকে ট্রান্সএন্টার্কটিক পর্বতমালা দিয়ে আলাদা করা। এই পশ্চিম এন্টার্কটিকা বছরে ৩০ ঘন মাইল করে বরফ হারাচ্ছে। এই বরফ গলার হার দ্রুত বেড়ে যেতে পারে। সাগরপৃষ্ঠ প্রতিবছরই বরফে জমাট বাঁধে। বরফের ব্যাপ্তি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল ২০১৪ সালে। আর ২০১৭ সালে তা রেকর্ড নিয়ে চলে এসেছে। ভাসমান বরফের তাকগুলো উপকূলীয় হিমবাহ ও সেগুলোর পেছনের বরফকে পিঠ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখে। উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বরফের তাকগুলো ভেঙ্গে গেলে হিমবাহও বিপন্ন হয় এবং স্থলভাগের বরফ দ্রুত সাগরের দিকে চলে আসতে থাকে। যে হিমবাহগুলোর কারণে পশ্চিম এন্টার্কটিকার অনেকটা জায়গা আমুন্দসেন সাগরে ব্যপ্ত সেগুলো পাতলা হয়ে আসছে এবং দ্রুত গলছে। মহাদেশের সিংহভাগ বরফ ধারণ করে আছে পূর্ব এন্টার্কটিকা। দীর্ঘদিন ধরে ভাবা হতো পূর্ব এন্টার্কটিকা স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। এমনকি ভারি তুষারপাতের কারণে আরও পুরু হয়ে উঠছে। কিন্তু উক্ত জলরাশির কারণে এখন এর বরফের তাকগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এন্টার্কটিকার সমস্ত বরফ যদি গলে যায় তাহলে সাগরের জলস্তর ১৮৯ ফুট বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তা হতে সম্ভবত সহস্র বছর লেগে যাবে। এর মিসবাহগুলো গললেই যে অবস্থা হবে তা সর্বনাশ ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়ার চেয়ে আয়তনে বড় হলো টোটেন হিমবাহ। এই হিমবাহ এত পানি ধারণ করে আছে যে এটি পুরোপুরি গলে গেলে সাগরের জলস্তর ১৩ ফুট বাড়বে। হিমবাহটি এখন দ্রুত বরফ হারাতে বসেছে। পশ্চিম এন্টার্কটিকার বরফের আস্তরণ নিঃশেষ হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ জন্য ৫শ’ বছর লাগবে, বাকি এক শ’ বছরের কম সময় লাগবে এবং মানবজাতি তার জন্য প্রস্তুত হওয়ার মতো সময় পাবে কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন। তবে বিপর্যয় যে ঘটছে নাসার বিভিন্ন উপগ্রহ ছবি থেকে তা স্পষ্ট। ভাসমান পাইন আইল্যান্ড আইস শেলসং এক বিশাল হিমবাহকে ঠেস দিয়ে ধরে রেখেছিল। এই আইস শেলফটি এখন ধসে পড়ছে। সাগরের উষ্ণ জলরাশি নিচ থেকে এটিকে দুর্বল করে ফেলছে। শেলফের নিচ দিয়ে আগের চেয়ে আরও বেশি করে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এতে আইস শেলফে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে সাগর থেকে প্রায় ১০ মাইল ভেতরে। এই ফাটলের কারণে শেলফের গ্রন্থের দিকের ২২৫ বর্গমাইল বরফ আলাদা হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। পরবর্তী চিরটাও ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এবং তা বাড়তে শুরু করেছে। স্যাটেলাইটের ছবি ও পর্যবেক্ষণ বিমানের তথ্যাদিতে থেকে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে পশ্চিম এন্টার্কটিকার বিশাল অংশ ইদানীং বরফ হারিয়ে বসছে এবং সেটা হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে। উষ্ণায়ন সবচেয়ে নাটকীয় রূপ ধারণ করেছে এন্টার্কটিক পেনিনসুলায়। এটি হলো বরফ ঢাকা পর্বতমালা যা উত্তর অর্থাৎ দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তের দিকে ৭শ’ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এন্টার্কটিকার চতুর্দিকে শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্রস্রোত নিরন্তর ঘূর্ণিপাক খায়। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও উত্তর দিক থেকে আসা উষ্ণ বায়ু ও জলরাশি সবেগে আঘাত হানে এন্টার্কটিক পেনিনসুলার গায়ে। পেনিনসুলারের পশ্চিম দিকে গড় বার্ষিক তাপমাত্রা ১৯৫০ সাল থেকে প্রায় ৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট বেড়ে গেছে যা কিনা এই গ্রহের বাকি অংশের তুলনায় অনেক গুণ বেশি দ্রুত। শীতকালীন তাপমাত্রাও বিস্ময়করভাবে প্রায় ৯ ডিগ্রী ফারেনহাইট বেড়েছে। আগে সাগরে বরফ জমত বছরে ৭ মাস। এখন জমছে ৪ মাস। আইস শেলফগুলো আগে থেকেই ভাসমান অবস্থায় থাকায় যখন গলে তখন সেই গলার কারণে সাগরের জলস্তর বাড়ে না। তবে ওগুলো থেকে একটা সঙ্কেত পাওয়া যায় যে এই স্তর বৃদ্ধি আসন্ন। কারণ এদের পেছনে যেসব হিমবাহ রয়েছে সেগুলোর বরফ ‘গলার হারও ত্বরান্বিত হয়ে যায়। গবেষকদের হিসাব থেকে দেখা গেছে যে শুধু এমুন্ডসেন সাগরের আইসশেলফ নয় বরং এন্টার্কটিকার সমস্ত আইস শেলফ থেকে ১৯৯৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বরফের পরিমাণ ১২ গুণ বেড়েছে। অর্থাৎ আগে সেখানে বছরে ৬ ঘন মাইল বরফ গলে যেত এখন গলছে ৭৪ ঘনমাইল। আইস শেলফগুলোর পেছনের হিমবাহগুলোর বরফ গলা ত্বরান্বিত হচ্ছে। আগামী ৩০ থেকে ৪০ বছর এভাবেই চলতে থাকবে। তবে ২০৫০ থেকে ২১০০ সাল পর্যন্ত বরফ গলা এতই আশঙ্কাজনক হবে যেÑ তা আর ভাবাই যায় না। জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে আটকে থাকা তাপ ঊনবিংশ শতকে শিল্প বিপ্লব শুরুর পর থেকে বেরিয়ে আসছে শুরু করে এবং এই তাপের বেশিরভাগই সাগরে চলে গেছে। অবশ্য এখন যে তাপ এন্টার্কটিকার আইস শেলফের গায়ে আঘাত হানছে তার বেশিরভাগই আসছে অন্য সূত্র থেকে। সেটা হচ্ছে জলবাহু পরিবর্তনের প্রভাব। সারকামপোলার বা অনস্তগ বায়ু প্রবাহ ও সমুদ্রস্রোত তীব্রতর গতি অর্জন করে উপকূল অদূরবর্তী সাগরের উচ্চতর জলরাশিকে জঙ্গী সোপানের ওপর ও ভাসমান বরফের নিচে ঠেলে দিয়েছে। আমরা যদি কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে শুরু করি তার পরও সাগরের জলরাশি আরও অনেক উষ্ণ হয়ে ওঠা এখনও বাকি আছে। তার মানে এন্টার্কটিকার দিকে আরও অনেক তাপ প্রবাহিত হবে। বিজ্ঞানীরা আপাতত হোয়াইটেস হিমবাহ নিয়ে বেশি চিন্তিত। শুধু এই একটি মিসবাহের বরফ গলে গেলেই বিশ্বজয় সাগরের জলস্তর ৪ ফুট বেড়ে যাবে। তবে আশাবাদীদের হিসাব একটু আলাদা। তারা মনে করেন মানবজাতি গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন কি পরিমাণে চালাবে তার ওপর নির্ভর করে বলা যায় যে এন্টার্কটিকার বরফ গলার কারণে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দেড় ফুট থেকে সাড়ে তিন ফুট বাড়বে। আর যদি গ্রীনল্যান্ড এবং বিশ্বব্যাপী অন্যান্য দ্রুত গলতে থাকা হিমবাহগুলোকে হিসাবে ধরা হয় তাহলে ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা সম্ভবত ৩ থেকে ৭ ফুট বাড়বে। তবে ওটাই যে সবচেয়ে খারাপ চিত্র তা নয়। সাগরের জলস্তর বৃদ্ধি ২১০০ সালে থেমে যাবে না। দূর ভবিষ্যত মানবজাতির জন্য কি করে আনতে পারে পৃথিবীর অতীত ইতিহাসের মধ্যে সেই সূত্র নিহিত আছে। বিজ্ঞানীরা প্রাচীন তটারেখাগুলো পরীক্ষা করে উপসংহারে পৌঁছেছেন যে সোয়া লাখ বছর আগে পৃথিবী যখন আজকের তুলনায় কিছুটা উষ্ণ ছিল তখন এই জলস্তর আজকের চেয়ে ২০ থেকে ৩০ ফুট বেশি ছিল। প্রায় ৩০ লাখ বছর আগে বায়ুম-লে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা সর্বশেষ যখন আজকের মতই বেশি ছিল এবং তাপমাত্রা ২০৫০ সালে যেমন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে সে রকমই ছিল তখন সাগরের জলস্তর আজকের তুলনায় ৭০ ফুট বেশি ছিল। অথচ গ্রীনল্যান্ড ও পশ্চিম এন্টার্কটিকার বাঁকের আস্তরণ গলে গেলে সাগরের জলস্তর বাড়বে মাত্র ৩৫ ফুট। আর সবচেয়ে খারাপ দৃশ্যপটটা ভাবলে পূর্ব এন্টার্কটিকাকে হিসাবে নিতে হবে। কারণ সেখানেই জমা হয়ে আছে পৃথিবীর সমস্ত বরফের চার ভাগের তিন ভাগেরও বেশি। এই সেদিন পর্যন্ত পূর্ব এন্টার্কটিকার বরফের আস্তরণ নিরাপদ বলে ভাবা হত। কিন্তু বরফ ভেদকারী বাড়ার চিত্রও বিভিন্ন উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে এর নিচু এলাকার উষ্ণ জলরাশি এসে ঢুকছে যা বরফের আস্তরণের প্রাণকেন্দ্রে চলে যেতে পারে। টোটেন হিমবাহ এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উপকূলীয় হিমবাহ। এই হিমবাহটি গলে গেলে বিশ্বময় জলস্তর ১৩ ফুট বেড়ে যাবে। পশ্চিম এন্টার্কটিকার সমস্ত বরফ গললে যা হবে শুধুমাত্র এই একটি হিমবাহের কারণেই মোটামুটি একই পরিণতি হবে। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার আইসব্রেকার আরোরা অস্ট্রালিস টোটেন হিমবাহের কাছে গিয়ে দেখতে পায় যে গভীর উষ্ণ জলরাশির এবং আইসশেলফের নিচ দিয়ে দিনে সাড়ে চার ঘন মাইল হারে প্রবাহিত হচ্ছে। হিমবাহটি ইতোমধ্যে বছরে দুয়েক ঘনমাইল বরফ হারিয়ে চলেছে। এন্টার্কটিকার হিসেবে এটা ছোট ছোট আলুর মতো। কিন্তু আশঙ্কা করা হচ্ছে এই বরফ গলে যাওয়া ত্বরান্বিত হবে। টোটেন হিমবাহ পশ্চিম এন্টার্কটিকার তুলনায় ধীরগতিতে বরফ হারাতে থাকবে। তাই এন্টার্কটিকার কারণে সবচেয়ে খারাপ চিত্রটা বেরিয়ে আসতে কয়েক শতাব্দী সময় লাগতে পারে। কিন্তু সেটাই যদি ঘটে তাহলে নিউইয়র্ক, লসএ্যাঞ্জেলেস, কোপেনগেহেন, সাংহাই এমনকি আরও কয়েক ডজন নগরীসহ পৃথিবীর বৃহত্তম অনেক নগরীই পরিত্যক্ত হবে। সেই দিনটির ক্ষণগণনা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×