ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চারদিকে ষড়যন্ত্র- অরক্ষিত রাষ্ট্রপতি

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৪ আগস্ট ২০১৭

চারদিকে ষড়যন্ত্র- অরক্ষিত রাষ্ট্রপতি

রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি ৩২নং সড়কে কার বাড়ি? দেশের যে কোন শিক্ষিত, রাজনীতি সচেতন, ঢাকার যে কোন ট্যাক্সি-ক্যাব অথবা আশপাশ এলাকার রিক্সাচালককে প্রশ্ন করলে উত্তর দেবে- কেন, শেখ সাহেবের! পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত কত লাখ কোটি পাহাড় পর্বতই তো বুক টান করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সর্বোচ্চ চূড়া হয়ে কেবল দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়ের এভারেস্ট। বাংলাদেশ এবং বিশ্বে শেখ পদবি নিয়ে তেমনি অনেকে আছেন ঠিকই কিন্তু শেখ সাহেব বলতে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় কৃতজ্ঞ বাঙালীর মাথা যার প্রতি নত হয়ে আসে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালীদের অধিকারের দাবি তোলায় কারাগার হয়েছিল তার স্থায়ী ঠিকানা। ফলে পারিবারিক জীবনে বিপর্যস্ত বেগম মুজিব ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্বশুরের হাত ধরে ১৯৬১ সালের প্রথম দিকে ৩২নং রোড ধানম-ির অসমাপ্ত, নির্মাণাধীন ৬৭৭নং বাড়িতে এসে ওঠেন। শেখ সাহেব সেই আইয়ুবের সামরিক শাসন শুরু হওয়া থেকে, তখনও কারাগারে। হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পেয়ে সর্বপ্রথম এই বাড়িতে ওঠেন। কিছুদিন পর সাংগঠনিক কর্মকা- থেকে দূরে রাখার জন্য আইয়ুব সরকার পুনরায় তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। ১৯৬৩ সালে সামরিক শাসন প্রত্যাহার হলে আবার তিনি মুক্তি পান এবং তখন থেকে এই বাড়ি আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় পার্টি অফিস হয়ে যায়। ১৯৬৪-এর মাঝামাঝি সময় থেকে শেখ সাহেব অধিকাংশ সময় কারাগারে ছিলেন। কিন্তু জনতার মিছিল ৩২নং রোডে উপস্থিত হয়ে সর্বদা সেøাগান তুলত ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ তারা ঠিকই মুজিবকে মুক্ত করেছিল। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা পেশের পর গ্রেফতার এবং ৬৮ সালে আগরতলা মামলা রুজু হলে কারাবন্দী মুজিবের ধানম-ির এই বাড়ি বাঙালী জাতির আশা-আকাক্সক্ষার ঠিকানা হয়ে যায়। ১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক এক গণঅভ্যুথানের মাধ্যমে শেখ সাহেবকে মুক্ত ও বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর থেকে ’৭০ এর নির্বাচন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, জকিগঞ্জ-গোয়াইঘাট থেকে শ্যামনগর-কলাপাড়া পর্যন্ত চষে বেড়ান। বাঙালীদের তিনি ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেন। তাদের ভিন্ন জাতিসত্তা বোধ ও আত্মপরিচয় বাতলে দেন। তাদের ভেতর সাহস সঞ্চারিত করেন। এরই চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ডাক দিলে আজন্ম ভীরু এই বাঙালী সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হিংস্রতা নিয়ে ‘জয়বাংলা’ সেøাগান তুলে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করে। এই যুদ্ধে যে কেবল পাকিস্তানের লজ্জাজনক পরাজয় ঘটেছে তা নয় তাদের সহযোগী মার্কিন বলয়, চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের হার হয়। ফলে তখন থেকেই প্রতিশোধের লক্ষ্য নিয়ে তারা বঙ্গবন্ধু ও বাঙালীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে ধানম-ি ৩২নং রোডের বাড়িতেই ওঠেন। কোন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধান ছাড়া অতি সাধারণ মানের নির্মিত এটি একটি দোতলা বাড়ি। নিচে ছোটবড় সব মিলিয়ে পাঁচটি এবং উপরে ড্রইং, ডাইনিংসহ পাঁচটি কক্ষ। সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পর নিচতলার পুরোটাই রিসিপশন, প্রটোকল-প্রটেকশন ও দেশী-বিদেশী অতিথিদের সাক্ষাত কিংবা দলীয় মিটিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। দোতলায় পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতেন বঙ্গবন্ধু। বাড়ির পেছনে উত্তর দিকে মূল ভবন থেকে আলাদা বেগম মুজিবের ছোট্ট রান্নাঘর। একই লাইনে মুরগি ও কবুতরের খোপ এবং পাশে গোয়ালঘর। যাকে বলা চলে ঢাকার বুকে সৌখিন একটি খাঁটি বাঙালী পরিবার। স্বাধীনতার পর বড় ছেলে শেখ কামালের জন্য তিন তলায় দুটি নতুন কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছিল। সরকারপ্রধানের এই বাড়ির সম্মুখের দেয়ালের পর রাস্তা পার হলেই ধানম-ি লেক। লেকের ওপার থেকে শত্রুর যে কোন ভাড়ি অস্ত্র এই বাড়ির নিরাপত্তা ল-ভ- করে দিতে পারে। দুই পাশে এবং পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ অট্টালিকাগুলো এই বাড়ির ওপর কর্তৃত্ব করছে। ওই সকল বাড়ির জানালা কিংবা ছাদ থেকে সরকারপ্রধানের বাড়ি লক্ষ্য করে ক্ষুদ্রাস্ত্রের ফায়ার কিংবা গ্রেনেড ছুড়ে মারলে ফলাফল হবে মারাত্মক। দীর্ঘ সংগ্রাম ও লড়াই করে যে মানুষটি বিশ্বের মুরব্বিদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছিলেন, দুর্ভাগ্য যে তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক। রাষ্ট্রপতির বাড়িতে প্রবেশাধিকারের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত এখানে তা ছিল না। কেননা তিনি ছিলেন কারও কাছে মজিবর, কারও কাছে মুজিব ভাই, মুজিব কাকু, বাকি সবার বঙ্গবন্ধু-জাতির পিতা। তার সরকারী অফিস গণভবন ও বাসভবনে ছিল সব মিলিয়ে তিন শিফটের জন্য দুই শ’র কম পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ এবং যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী যতই পারদর্শী হোক না কেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের (ভিআইপি) নিরাপত্তা হ্যান্ডল করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এর জন্য বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনের নিরাপত্তার অংশ হিসেবে চারদিকে সাতটি সেন্ট্রি পোস্ট তৈরি করা হয়েছিল। এর চারটিতে সেনাবাহিনী এবং তিনটিতে সর্বদা পুলিশ প্রহরী দায়িত্বে ছিল। সেনাবাহিনী থেকে বাস ভবনের জন্য মাত্র ২৫ সেনাসদস্য নিয়োগ দেয়া হয়। বাস ভবন চত্বরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ৩১নং রোডে অন্য একটি বাড়িতে এই সৈন্যদলের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। ওখান থেকে প্রতি শিফটে একজন দলনেতার নেতৃত্বে ৭/৮ সৈনিক এসে দায়িত্ব পালন করত। ব্যাটারি কমান্ডার তৎকালীন ক্যাপ্টেন আঃ বাসার আজিমপুরে অবস্থান করতেন বিধায় বিকেল থেকে এদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ডিএসপি পদের একজন পুলিশ অফিসার নিচ তলায় অবস্থান করতেন। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্ব ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির নিরাপত্তার দায়িত্বে যে সকল সেনা ও পুলিশ সদস্য নিয়োজিত ছিল তাদের কোন ভেরিফিকেশন হয়েছিল কিনা সন্দেহ রয়েছে। সেনাবাহিনীতে চাকরিরত, অবসরপ্রাপ্ত/চাকরিচ্যুত বেশকিছু সদস্যের সরকারবিরোধী কার্যকলাপের তথ্যও গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল। এরা প্রকাশ্যে অথবা গোপনে সরকার উৎখাতের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মেজর ফারুক, তার ভায়রাভাই মেজর রশীদ, মেজর ডালিম, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এদের অন্যতম। এমনকি সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান এদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তারপরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ৩১ জুলাই ৭৫ পর্যন্ত সেই মেজর ফারুক, মেজর মহিউদ্দিন ল্যান্সারের ১ বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিটকে গণভবন ও বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনের নিরাপত্তায় রাখা হয়েছিল। ফলে ওই সময়ে গার্ডদের ডিউটি পরিদর্শনের অজুহাতে উপরোক্ত অফিসারগণ ও সহযোগীরা রাষ্ট্রপতির বাস ভবনের সম্পূর্ণ চিত্র পেয়ে যায়। ১ আগস্ট ’৭৫ তারিখে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আগত ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ইউনিটের একটি ব্যাটারি/কোম্পানি ১ বেঙ্গল ল্যান্সারের কাছ থেকে গণভবন ও রাষ্ট্রপতির বাস ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগে এই ইউনিটের অন্যতম অফিসার মেজর ডালিমকে সরকার ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকা-ের অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়। চাকরি হারানোর পরও এই অফিসার বিভিন্ন সেনানিবাসে এমনকি ১ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ইউনিটে নিয়মিত যাতায়াত অব্যাহত রাখে। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা তৎপর না থাকলেও মেজর ডালিম ও অন্য ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের মিশন নিয়ে ঠিকই তৎপর ছিল। ’৭৫-এর জানুয়ারি থেকে মূলত ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের জাল বিস্তার শুরু করে। এই সময়ে সেনাবাহিনীর ভেতরে পাকিস্তান প্রত্যাগত বনাম মুক্তিযোদ্ধা, সেনাপ্রধান বনাম উপ-প্রধানের অনুসারী, রক্ষীবাহিনী গঠন নিয়ে মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে কোন কোন ইউনিটে সরকারবিরোধী ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছড়িয়ে দেয়া হয়। মোটিভেটেড এই সকল সেনাসদস্য ষড়যন্ত্রের ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুরতার পথে হাঁটতে শুরু করে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা পাকিস্তান-মার্কিনীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং বিদেশী প্রভুদের পরামর্শে মোশতাক-তাহের ঠাকুর-মাহবুব চাষীদেরও এক ছাতার নিচে নিয়ে আসে। ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিনটিকে আঘাত হানার উত্তম দিন হিসেবে তারা বেছে নেয়। তাদের যথার্থ ধারণা ছিল যে, নিজ দেশের স্বাধীনতা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ভারতের গোয়েন্দাদের নজর নিজ দেশের দিকেই নিবিষ্ট থাকবে। ১৪ আগস্ট ’৭৫ রাষ্ট্রপতির পরিদর্শনের একদিন পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একাধিক শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এইরূপ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানসূচী ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ করার জন্য ঢাকার অধিকাংশ গোয়েন্দা মাঠ কর্মী ওই এলাকায় অবস্থান নেয়। একই দিন দুপুরে একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার যেটি পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাজে নিয়োজিত ছিল সেটি ফেনী এলাকায় বিধ্বস্ত হয় এবং এর সকল যাত্রী ঘটনাস্থলে নিহত হয়। তাদের মৃতদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা ও আনুষঙ্গিক কার্যাদি নিয়ে সেনাপ্রধান, সিজিএস, ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেড কমান্ডার, ডিজিএফআই প্রধানসহ সেনাবাহিনীর নিজস্ব গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দারা গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকেন। অতঃপর ক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে যান। কিন্তু পরদিনের সূর্যোদয়ের পূর্বে যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা জাতির ইতিহাসে ঘটেছিল, তা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ধূর্ত ষড়যন্ত্রকারীরা পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ ও হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের মতো ঘটনা ঘটিয়ে গোয়েন্দাদের নজর ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের ব্যস্ত রেখেছিল যেন তাদের মূল অভিযান পরিচালনার পূর্ব পর্যন্ত গোপনীয়তা বজায় থাকে। মূলত তাদের সেই পরিকল্পনাই সফল হয়েছিল। লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা
×