ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ণময় বোল্টের বিবর্ণ বিদায়

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৪ আগস্ট ২০১৭

বর্ণময় বোল্টের বিবর্ণ বিদায়

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ ট্র্যাকে পড়ে কাতরাচ্ছেন, আর বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে কোটি কোটি দর্শক-সমর্থকদের। এক কিংবদন্তি তারকা পায়ে খিচুনি ধরার কারণে পড়ে গেলেন। শেষটা তাই বিষাদ-গাঁথায় পূর্ণ হলো রূপকথার গতিসম্রাট উসাইন বোল্টের। সর্বকালের সবচেয়ে গতিধর মানব, তবু ব্যক্তিগত ১০০ মিটার স্প্রিন্টে এবারই প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপস আসরে হেরে গিয়েছিলেন জ্যামাইকার এ স্প্রিন্টার। এবার দলগত ৪ী১০০ মিটার রিলে ইভেন্টেও জ্যামাইকাকে কিছুই জেতাতে পারেননি মাঝপথে ইনজুরির কারণে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়াতে। ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপস তাই বিষাদ-বিধুরই হলো বোল্টের। আর কখনও কোন পর্যায়ের রেসে দেখা যাবে না তাকে। শেষ হয়েছে টানা ১০ বছর ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডে তার বিস্ময়কর অভিযানের। জ্যামাইকার এই দুঃসহ বেদনার দিনে হেসেছে গ্রেট ব্রিটেন স্বর্ণপদক জিতে। আর মহিলাদের একই ইভেন্টে অবশেষে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পড়তে পেরেছেন এ্যালিসন ফেলিক্স। যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েরা জিতেছে মহিলাদের ৪ী১০০ মিটার রিলের স্বর্ণপদক। জ্যামাইকা বেশ ভালভাবেই শুরু করেছিল। চারজনের সম্মিলিত লড়াইয়ে বোল্ট ছিলেন তৃতীয় ব্যক্তি। জ্যামাইকাও তিন নম্বরে ছিল তখন। কিন্তু বোল্টের হাতে ব্যাটন মানেই এবার দুর্ধর্ষ গতির খেলা। ভালভাবেই জুলিয়ান ফোরটির কাছ থেকে ব্যাটন নিয়ে নিজের কাজটুকু শুরু করেছিলেন বোল্ট। কিন্তু মাঝপথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। পুরো লন্ডন স্টেডিয়ামে আর্তনাদ এবং পরবর্তীতে স্তব্ধতা! ৬০ হাজার দর্শকের মনে আশঙ্কা কিংবদন্তিকে নিয়ে। বাঁ পায়ের উরুতে টান ধরার কারণে আর দৌড়াতে পারেননি, ট্র্যাকেই উপুড় হয়ে পড়ে কাতরাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বোল্ট আর ওঠেননি। ওমর ম্যাকলিওড, জুলিয়ান ফোরটি, বোল্ট ও ইয়োহান ব্লেকের জ্যামাইকা শেষ করতে পারেনি রিলে। ব্রিটেনের হয়ে চিজিন্দু উজাহ, এডাম জেমিলি, ড্যানিয়েল ট্যালবট ও নেথানিয়েল মিচেল-ব্লেকরা জিতে গেছেন স্বর্ণপদক ৩৭.৪৭ টাইমিং নিয়ে। ওয়ার্ল্ড লিডিংয়ে নৈপুণ্য মহাদেশীয় রেকর্ড। ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। মাইক রজার্স, জাস্টিন গ্যাটলিন, জেলেন ব্যাকন ও ক্রিশ্চিয়ান কোলম্যানরা ৩৭.৫২ সেকেন্ড সময় নিয়ে রৌপ্য এবং চমক দেখিয়ে জাপানের শুহেই টাডা, শোটা লিজুকা, ইয়োশোহিডে কিরইয়ু ও কেনজি ফুজিমিতসু ৩৮.০৪ সেকেন্ড টাইমিংয়ে ব্রোঞ্জ জয় করেন। জ্যামাইকার দলীয় ডাক্তার কেভিন জোন্স জানিয়েছেন বোল্টের হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি হয়েছে। কিন্তু তিনি বলেন, ‘ইনজুরি হয়েছে কিন্তু অনেক বেশি ব্যথা ও হতাশা তিনি পেয়েছেন রেস হারের মাধ্যমে। গত তিনটি সপ্তাহ তার জন্য অনেক কঠিন ছিল। আমরা তার ভাল কিছু প্রত্যাশা করি।’ দ্বিতীয় লেগের রানার জুলিয়ান এ বিষয়ে বলেন, ‘তিনি আমাদের বলেননি আসলে কি ঘটেছিল। কিন্তু দেখে মনে হয়েছে এটা কোন ধরনের খিচুনি বা টান লাগার মতো কিছু হবে। তিনি অনবরত আমাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছিলেন। কিন্তু আমরা তাকে বলেছি ক্ষমা প্রার্থনার কোন কারণ নেই। ইনজুরি সব ক্রীড়ারই অংশ।’ এবারই পুরুষদের ১১০ মিটার হার্ডলসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ম্যাকলিওড। তিনি বলেন, ‘সবাই উজ্জীবিত ছিল। কিন্তু তার ইনজুরি হঠাৎ এসে সব ভ-ুল করে দিয়েছে। কিন্তু এরপরও বোল্টের নাম সবসময়ই বেঁচে থাকবে।’ এ ফলাফল এখন নিশ্চিত করল যে বোল্ট ১৪ বিশ্ব আসর পদক নিয়ে শেষ করলেন। এ্যালিসন ফেলিক্স ৮ স্বর্ণ জিতে সবার ওপরে, আর বোল্ট জিতেছেন ৭ স্বর্ণ। বোল্টের বিষাদের দিনেই ফেলিক্স আরেকটি স্বর্ণপদক যোগ করেছেন তার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপস ক্যারিয়ারে। যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েরা ৪ী১০০ মিটার রিলেতে ৪১.৮২ সেকেন্ড টাইমিংয়ে স্বর্ণপদক জয় করে। ৪২.১২ সেকেন্ড সময় নিয়ে ব্রিটেন রৌপ্য এবং ৪২.১৯ সেকেন্ড টাইমিংয়ে জ্যামাইকার মেয়েরা ব্রোঞ্জ লাভ করেছে। ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকে ট্রিপল স্বর্ণপদক জিতে সবাইকে চমকে দেন বোল্ট। পরের বছরই বার্লিনে ১০০ মিটারে ৯.৫৮ সেকেন্ড টাইমিং নিয়ে বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করে হতবিহ্বল করে দেন সমগ্রবিশ্বকে। সেই বোল্ট ট্রিপলের ডাবল করেন ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে, গত বছর রিও অলিম্পিকে ম্যাজিক ফিগার ট্রিপল-ট্রিপল গড়েন সর্বকালের সবচেয়ে গতিধর এ মানব। কিন্তু বিশ্ব আসর দিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানতে গিয়ে এ ৩০ বছর বয়সী তারকার সঙ্গী হলো বিষাদ-ব্যথা। হারানোর হতাশা। ২০০ মিটারে আগেই নাম প্রত্যাহার করেছিলেন কিন্তু ১০০ মিটারে চরম প্রতিপক্ষ গ্যাটলিনের কাছে হেরে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। এবার দলগত ইভেন্টেও পারলেন না। কিন্তু এ বিষয়ে বোল্টের পূর্বসূরি স্প্রিন্ট সুপারস্টার মাইকেল জনসন বলেন, ‘এখনও বলব বিশ্বে এমন কোন এ্যাথলেট নেই যার পক্ষে তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়া সম্ভব। তিনি সারাবিশ্বের সুপারস্টার।’ জনসনের ২০০ মিটারে গড়া বিশ্বরেকর্ড ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন বোল্ট। তার বিষয়ে সাবেক আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি প্রেসিডেন্ট জ্যাকুয়েস রগ বলেন, ‘তিনি একজন আইকন। সর্বকালের সবচেয়ে সেরা স্প্রিন্টার তিনি।’ অবশ্য ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকেই তিনি বোল্টকে কিংবদন্তি মানতে রাজি হননি। কিন্তু সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও বোল্টে মুগ্ধ। তার বিষয়ে ওবামা বলেছেন, ‘কেউ কখনও তারচেয়ে গতিময় ছিল না। কোটি কোটি মানুষের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে দ্রুতগতির।’ জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী এ্যান্ড্রু হোলনেস বলেন, ‘উসাইন বোল্ট এখন জ্যামাইকার সবচেয়ে বড় এ্যাম্বাসেডর। তার ব্যক্তিত্ব, মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার ক্ষমতা, তার নিজেকে মেলে ধরার সামর্থ্য জ্যামাইকাকে বিশ্বব্যাপী একটা ব্র্যান্ডে পরিণত করেছে।’
×