ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লন্ডনী কবির ও তার স্বজনদের টিলার মাটির ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্ব

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১৪ আগস্ট ২০১৭

লন্ডনী কবির ও তার স্বজনদের টিলার মাটির ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্ব

রফিকুল হাসান চৌধুরী তুহিন, হবিগঞ্জ থেকে ॥ হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পল্লী মুগাকান্দিতে ভয়াবহ হতাহতের ঘটনার নেপথ্যে মসজিদ পরিচালনা কমিটি গঠন এবং ইমাম পরিবর্তনসংক্রান্ত বিষয়টিই মূল নয়। এই বিষয়টিই একটি মাত্র উসিলা এবং পূর্বপরিকল্পিত ইস্যু। তবে বিষয়টির নেপথ্যের কারণ জানা গেছে নিহত লন্ডন প্রবাসী কবির মিয়া এবং তার আত্মীয়স্বজনের কতিপয় বেপরোয়া সদস্যের সরকার নিয়ন্ত্রিত পাহাড় থেকে অবৈধভাবে সাদা মাটি উত্তোলন আর অন্যান্য সহায়-সম্পদসহ এলাকায় প্রভাব বিস্তারের মতো নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধু তাই নয়, অর্থের লোভে বশীভূত হয়ে এই লন্ডন প্রবাসী ও তার গোষ্ঠীগত আত্মীয়স্বজনকে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তার বেআইনী সহযোগিতার চিত্রও ফুটে উঠেছে। সূত্র জানায়, ওই গ্রামের বাসিন্দা লন্ডনী বাড়ির মালিক ছাবু মিয়ার ছেলে হলেন সংর্ঘষে নিহত কবির মিয়া। তার স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে জানতে গেলে এলাকার অনেকেই বলেন, এই কবির মিয়া নাকি ছিলেন রগচটা মেজাজী প্রকৃতির লোক। শুধু তিনি নন, তার বাড়ি ও গোষ্ঠীর অনেকেই নাকি এমন প্রকৃতির। ফলে তাদের সহায়-সম্পদসহ নানান বিষয় নিয়ে লন্ডনী বাড়ির কর্ণধার শুধু নন, কবির ও তার গোষ্ঠীগত আত্মীয়স্বজনদের মাঝে বিরোধ লেগেই আছে। কিছুদিন পূর্বেও একটি মাছ মারার খাঞ্জা নিয়েও নাকি গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটেছিল। আর এসব ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে কবির মিয়াসহ সবপক্ষই অবস্থান সংহত রাখতে এলাকার নিরীহ গ্রামবাসীদের ব্যবহার করে আসছে। শিক্ষার আলো থেকে এখনও অনেকটা দূরে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন ধর্মীয় নানা রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় ভরপুর অবহেলিত এ গ্রামে অবস্থানকারী কতিপয় লাঠিয়াল প্রকৃতির প্রভাবশালী লোকই শুধু নয়, এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাকর্মীকেও অর্থের বিনিময়ে এই লন্ডনী কবির এবং তার গোষ্ঠীর প্রতিপক্ষীয় সদস্যরা অবৈধ কর্মকা-ের অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থেই। জানা যায়, সম্প্রতি লন্ডনী কবির মিয়া ও তার প্রতিপক্ষীয় গোষ্ঠীগত আত্মীয় জনপ্রতিনিধি আব্দাল মিয়া, মতিন-শফিক মাস্টার গংরা অবৈধভাবে সাদা মাটির ব্যবসায় নেমে পড়েন এবং সেই সঙ্গে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। প্রায় দু’বছর আগে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার মধুপুর চা বাগানসংলগ্ন লাল টিলা পাহাড়ে আকস্মিক সাদা মাটির সন্ধান মিললে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি হয়। এই সাদা মাটিই সিরামিকজাতীয় সামগ্রী তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। জাতীয় বা স্থানীয়ভাবে থাকা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো অল্পমূল্যে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই সাদা মাটি কিনে নেয়। তবে স্থানীয় প্রশাসন এই সাদা মাটি কেটে নেয়া বন্ধ এবং সরকারী সম্পত্তি হিসেবে এই টিলা রক্ষণাবেক্ষণের তেমন উদ্যোগ নেয়া তো দূরের কথা বরং স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের টপ টু বটম পর্যন্ত কতিপয় কর্তাব্যক্তি আর্থিক স্বার্থেই এই অবৈধ মাটি-বালু উত্তোলনকারীদের সঙ্গে জড়িত। সাবেক এক ইউএনও এই অবৈধ বালু-মাটির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নানা সময়ে সংবাদপত্রের শিরোনামও হয়েছিলেন, যা থেকে পুলিশের এক শ্রেণীর স্থানীয় কর্তারাও দূরে নয়। তাদের সম্মুখেই লাল টিলা থেকে মাটি তুলে নেয়া অব্যাহত থাকলেও অজ্ঞাত কারণে বাধা দেয়া হচ্ছে না, যা সময়ে-অসময়ে নানাভাবে উর্ধতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টিতে এলাকাবাসী আনলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সরকারী কর্তাব্যক্তিদের জড়িত থাকার সুবাদেই প্রকাশ্যেই নাকি ওই টিলা থেকে সাদা মাটি কেটে নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করছেন লন্ডনী বাড়ি এবং তাদের গোষ্ঠীর কতিপয় ব্যক্তি। সেই সঙ্গে এসবে জড়িত রয়েছেন এলাকার কতিপয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মীও। সূত্রমতে, প্রায় দেড় মাস আগে লন্ডনী কবির মিয়া তার স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে দেশে আসেন। পরবর্তীতে অর্থ ও বিত্ত-বৈভবের এই কবির তার মুগাকান্দি গ্রামের বাড়িতে উঠেই ওই সাদা মাটির ব্যবসার ভাগ-বাটোয়ারা এবং এলাকা ও লাল টিলার আধিপত্য নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন গোষ্ঠীগত আত্মীয় সোহেল-মতিন-শফিক গংদের সঙ্গে। এ নিয়ে পরবর্তীতে উভয়পক্ষই প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়। এমতাবস্থায় স্থানীয় মসজিদের ইমাম মোঃ ফরিদ আখঞ্জিকে লন্ডনী বাড়ির কবির মিয়ার পক্ষে অবস্থান নিতে এক পক্ষ আহ্বান জানায়। কিন্তু তিনি তা না করার কারণেই নাকি অপর পক্ষ বেজায় নাখোশ হন। আর লন্ডনী বাড়ির কর্ণধার জনৈক ছাবু মিয়ার ছেলে লন্ডনী কবির ও তাদের গোষ্ঠীগত চরম বিরোধের বলির পাঁঠা হন মসজিদের ইমাম ফরিদ গাজী। সুযোগ বুঝে উভয়পক্ষই ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব নিয়ে যায় মসজিদ পর্যন্ত। একপর্যায়ে নানা অজুহাত তুলে মসজিদ পরিচালনা কমিটি গঠন এবং ইমাম পরিবর্তনের সুর তোলে এক পক্ষ। অন্য পক্ষ তাতে অনীহা প্রকাশ করলে ওই ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত গ্রামে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে রূপ নেয়, যা নিয়ে গত ১১ এবং ১২ আগস্ট দু’দফা সংর্ঘষে মেতে উঠে উভয়পক্ষ। এতে লন্ডনী কবির মিয়াসহ অন্তত দুজন নিহত এবং আহত হয় প্রায় পৌনে দু’শতাধিক লোক। আর এ সংর্ঘষ থামাতে গিয়ে পুলিশকে ছুড়তে হয় শত শত রাউন্ড শটগানের গুলি ও টিয়ারশেল। যদিও নিহত লন্ডনীর ২৭ আগস্ট লন্ডনে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। এদিকে নবাগত এসপি বিধান ত্রিপুরা জনকণ্ঠকে বলেছেন, বাহুবলের ওই ঘটনার নেপথ্যে সাদা মাটি ব্যবসার বিষয়টি কাজ করেছে বলে তার দৃষ্টিতে এসেছে। তবে তিনি জানান, আমি মাত্র কয়েকদিন হলো যোগদান করায় এবং বিষয়টি এখন তদন্তে থাকায় এ নিয়ে কোন মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে এলাকার ওসি মাজহারুল হকের নিকট মুগাকান্দি গ্রামে সৃষ্ট ওই হতাহতের নেপথ্যে সাদা মাটির ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয় কাজ করেছে কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি তা জানেন না বলে এড়িয়ে যান। তিনি জানান, ঘটনাস্থল এখন শান্ত রয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। এদিকে ওই সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় ইতোমধ্যে ৭৭ জনের নামোল্লেখপূর্বক অজ্ঞাতনামা অন্তত ৩শ’ লোকের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করার পর ব্যাপক ধরপাকড়ের আতঙ্কে গ্রাম এখন মানুষশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে লন্ডনী বাড়ি ও অন্য পক্ষের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে স্ব স্ব পক্ষের বক্তব্য নিতে এসব বাড়িঘরে গিয়ে তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি।
×