ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা খেলাপী ঋণ

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৩ আগস্ট ২০১৭

মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা খেলাপী ঋণ

চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের জাতীয় মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারের মুদ্রানীতিতে ঋণপ্রবাহ কাটিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেয়া হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের এই মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারী খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনা হয়েছে, যা গত মুদ্রানীতির চেয়ে ৪ শতাংশ কম। ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সংকোচনমূলক’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করল কিনা এ বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। তবে গবর্নর বলেছেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে নতুন মুদ্রানীতির মাধ্যমে সেটা সম্ভব। মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি পরিমিত রাখার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা আশার কথা শুনিয়েছেন যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেছেন, দেশের উত্তর-পূর্ব হাওরাঞ্চলে বিগত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে আকস্মিক বন্যায় ফসলহানির কারণে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এখনও বিদ্যমান। পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি দুই শতাংশের নিচে নেমে আসায় এবং ২০১৭ সালের শুরু থেকে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য মুখ্য পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য নিম্নমুখী বা স্থিতিশীল থাকায় ঘোষিত মুদ্রানীতির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি পরিমিত রাখা যাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে দেশে শান্তি ও স্বস্তি স্থিতিশীল থাকবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ফলে, ঘোষিত নীতি অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখা গেলে পরিস্থিতি সুখকরই হবে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। দীর্ঘদিন ধরেই সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়ে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ছে। গত জুনে শেষ হওয়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১১ মাসেই প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে আড়াই গুণ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়েও ২ হাজার কোটি টাকা বেশি। এ পরিস্থিতিতে এর সুদহার কমিয়ে আনার পরমার্শ দিয়ে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। চলতি মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও একই সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে বলা হয়েছে অচিরেই সঞ্চয়পত্রগুলোর মুনাফার হার বিদ্যমান বাজার সুদহারের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে হবে। স্মর্তব্য যে, বাজেটের সমাপনী বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সুদের হার কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আর সংসদ সদস্যরা মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের এই মাধ্যমে সুদহার না কমানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য। তবে মুদ্রানীতিতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজার সুদহারের সঙ্গে সম্পর্কিত করার এই ইঙ্গিত অর্থবহ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগসংক্রান্ত নির্দেশনাও জরুরী। আমরা জানি, সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক। এরপরও বিনিয়োগ পরিস্থিতির বর্তমান সঙ্কট কাটাতে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের ঘোষিত আর্থিক নীতিকে ঠিক পথে পরিচালিত করতে প্রতি অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল গত বছরের ২৯ জানুয়ারি। আমরা মনে করি, ঘোষিত মুদ্রানীতির আলোকে আর্থিক খাতগুলোর অবস্থান ও মনোভাব পরিবর্তন করলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে। ঘোষিত মুদ্রানীতির আলোকে বাজেট বাস্তবায়িত হোক এবং লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হোক-এটিই আমাদের প্রত্যাশা। এটি ঠিক, মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা মোকাবেলা করা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের বসবাস, সেখানে খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্রব্যমূল্য ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে বিবেচনায় নিয়ে এবং সেই সঙ্গে ঋণদান ও মুদ্রা সরবরাহের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে ৬ মাসের জন্য মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়। তবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির স্বার্থে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক গত কয়েক বছর ধরে সংযত ও স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতি এবং সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করাকে মূল লক্ষ্য ধরে মুদ্রানীতি ঘোষণা করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি মনোযোগী বলে প্রতীয়মান হয়। নিম্ন মূল্যস্ফীতি ও স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পর্যায়ে মুদ্রানীতির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির মধ্যে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। মুদ্রানীতিকে হতে হবে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সহায়ক এবং সে লক্ষ্যেই অর্থনীতির বিভিন্ন চলকের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত। বস্তুত মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত বিনিয়োগ চাঙ্গা করা। ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদহারের কারণে ঋণের প্রবৃদ্ধি যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমন বিনিয়োগেও পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। ফলে বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় বাড়ছে না, সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থান। নয়ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হতে পারত সন্দেহ নেই। সরকার যখন বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সচেষ্ট, ঠিক সে মুহূর্তে ঋণের লাগাম টেনে ধরা কতটা সমীচীন হবে, তা চিন্তার বিষয়। এ কথাও সত্য, কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ না হওয়ায় আলোচ্য লক্ষ্যই অর্জন করা যাচ্ছে না। এছাড়া ঋণের একটি অংশ খেলাপী হচ্ছে। এ কারণে কোন ধরনের সংস্কার ছাড়া ঋণের লাগাম টেনে ধরা বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য যৌক্তিক হবে না। এতে বেসরকারী বিনিয়োগ আরও নিরুৎসাহিত হতে পারে, যা রাজস্বনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে এবারও মুদ্রানীতিতে পলিসি রেটের কোন পরিবর্তন না করে গত অর্ধের মতো একই ফলাফল আশা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা হলো খেলাপী ঋণের বৃদ্ধি। ঋণের লাগাম টানার মাধ্যমে এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে কিনা, তাও একটি প্রশ্ন। বড় প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন এবং এক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়িয়ে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রত্যাশা করেছিল সরকার। কিন্তু গত কয়েক বছরে এতে তেমন সুফল মেলেনি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম কাজ হওয়া উচিত আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করার মাধ্যমে অধিক প্রবৃদ্ধিবান্ধব বেসরকারী খাতকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। আর তা যদি করতে হয়, ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ রোধের উদ্যোগ নিতে হবে। মুদ্রানীতির সব লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব না হলেও যদি কাছাকাছি অর্জন হয়, সেটাও অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ধরে নেয়া যায়।
×