ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাত না কেটে সফল অস্ত্রোপচার করায় ডাক্তারদের ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীর

মুক্তামণির হাতে সফল অস্ত্রোপচার, আরও অপারেশন লাগবে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৩ আগস্ট ২০১৭

মুক্তামণির হাতে সফল অস্ত্রোপচার, আরও অপারেশন লাগবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ১২ বছরের মুক্তামণির ডান হাতের অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। তবে এখনও সে ঝুঁকিমুক্ত নয়, আরও অন্তত ছয়টি অপারেশন করা লাগবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ড. সামন্ত লাল সেন। শনিবার সকাল আটটা ৫০ মিনিটের দিকে মুক্তামণির হাতের অস্ত্রোপচার শুরু হয়, শেষ হয় দুই ঘণ্টা পর। ১১ চিকিৎসকের একটি দল এই জটিল অস্ত্রোপচার করেন। মুক্তামণির ডান হাতটি কেটে ফেলার আশঙ্কা থাকলেও তার হাতটি রক্ষা করেই অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেছেন ডাক্তাররা। হাত না কেটে অস্ত্রোপচার করা যায় না- ডাক্তারদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কথাটা মাথায় রেখেই বোধকরি ডাক্তাররা অপারেশনে অংশ নেন। অস্ত্রোপচারে তার হাত থেকে তিন কেজি গাছের বাকলের ন্যায় মাংসপিন্ড কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে। এবং এগুলো পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। অস্ত্রোপচার সম্পর্কে ডাঃ সামন্ত লাল সেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘অপারেশন সফল হয়েছে। অপারেশনে ৬ ব্যাগ রক্ত লেগেছে। মুক্তামণি ভাল আছে। তার হাতের রোগাক্রান্ত অংশটুকু আমরা কেটে ফেলেছি। তবে এক অপারেশনেই এটা শেষ হবে না। আরও অন্তত ছয়টি অপারেশন লাগবে। ওটি (অপারেশন থিয়েটার) থেকে বের করার কিছুক্ষণের মধ্যেই মুক্তার জ্ঞান ফিরেছে, কথা বলেছে। বর্তমানে সে আইসিইউতে রয়েছে। এখানেই দু’তিন দিন তাকে রাখা হবে।’ মুক্তামণির হাত না কেটে সফল অস্ত্রোপচার করার পরে ডাক্তারদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডাঃ সামন্ত লাল বলেন, ‘আমরা যতটা প্রত্যাশা করেছিলাম মুক্তামণি তার থেকেও ভাল আছে। তবে সে ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ, তার ফুসফুসের সমস্যাসহ অন্যান্য জটিলতা রয়েছে। অন্তত ৫-৬ সপ্তাহ সে আমাদের অবজারভেশনে থাকবে। এ সাফল্য আমাদের একার নয়। বার্ন ইউনিটসহ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের (এনআইসিভিডি) সমন্বিত সফলতা এটা। তার হাত ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে মনে করছি।’ মুক্তামণির শারীরিক ঝুঁকি ও রক্তক্ষরণের আশঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিমুক্ত কখনই বলা যাবে না। তবে ঝুঁকি অনেকটাই কমে এসেছে। আমরা তার হাতের বেশিরভাগ অংশ ফেলে দিয়েছি। ওর শরীরের বেশ কিছু অংশে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। সেগুলো আমরা রিমুভ করব। আমরা এটুকু বলতে পারি, হাতের রোগাক্রান্ত যেটুকু অংশ ফেলে দিয়েছি সেখানে আর এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা নেই।’ পরবর্তী অস্ত্রোপচার কবে হবে-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একেক মানুষের শরীরের মেকানিজম একেক রকম। ওর একটা অপারেশন হয়েছে। শরীরের কিছু ডিএ্যারেজমেন্ট আছে। ওর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করবে পরবর্তী অপারেশন কবে করা হবে।’ শনিবার সকালে অস্ত্রোপচার শেষে দুপুর পৌনে বারোটার পর পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন চিকিৎসকরা। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক ড. জুলফিকার লেনিন। এ সময় লেনিন বলেন, ‘মুক্তামণির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সব সময় খোঁজখবর রেখেছেন। অপারেশনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল খবরাখবর জেনেছেন। আমাদের দিক থেকে যতদিন প্রয়োজন হবে ততদিন সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে।’ এদিকে মেয়ের সফল অস্ত্রোপচারে খুশি মুক্তামণির বাবা-মা। তার বাবা সাতক্ষীরার ইব্রাহীম হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ডাক্তার বলেছে মুক্তার অপারেশন ভাল হয়েছে। এখানকার চিকিৎসা নিয়ে আমরা খুব সন্তুষ্ট। এখানে অনেক বেশি যতœ নেয়া হচ্ছে যা আগে কোথাও নেয়া হয়নি। ডাক্তারদের ওপর আমাদের ভরসা আছে। জীবন রক্ষার জন্য তারা যা করতে চান এতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমরা শুধু আমাদের মেয়েকে চাই।’ বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ৬ তলায় শনিবার সকাল পৌনে আটটার সময় মুক্তামণিকে ওটিতে নেয়া হয়। সেসময় তার পাশে ছিলেন মা আসমা খাতুন ও বাবা ইব্রাহিম হোসেন। ট্রলিতে শুয়ে ওটির দরজা পর্যন্ত মায়ের হাত ধরে ছিল মুক্তামণি। ওটির দরজা পার করার পরপর আর যেতে পারেননি তারা। ওটির বাইরে বসেই মেয়ের জন্য দোয়া করেছেন তারা। অস্ত্রোপচার শুরুর আগে বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন মুক্তামণির বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। আল্লাহকে ডাকুন। আমরা কাল নির্ঘুম কাটিয়েছি। কিভাবে অপারেশন হবে তা নিয়ে আমরা সবাই কথা বলেছি। পুরো দেশের মানুষের দৃষ্টি মুক্তামণির দিকে। সবাই তার জন্য দোয়া করছে।’ ঢামেক বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন, বর্তমান পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, অধ্যাপক সাজ্জাদ খোন্দকার, অধ্যাপক রায়হানা আউয়াল, দুই সহযোগী অধ্যাপক, সাত সহকারী অধ্যাপকসহ অন্যান্য চিকিৎসক এবং ঢামেক হাসপাতালের এ্যানেস্থেশিয়া বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ মোজাফফর হোসেন বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের এ্যানেস্থেশিয়া বিভাগের চার চিকিৎসকসহ মোট ১১ চিকিৎসক এই অস্ত্রোপচারে অংশ নেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মুক্তামণির অস্ত্রোপচারের জন্য সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার কথা হয়েছিল। তবে সেখানকার চিকিৎসকেরা ভিডিও কনফারেন্স করে ও বিভিন্ন রিপোর্ট দেখে জানিয়ে দিয়েছেন, তারা মুক্তামণির অস্ত্রোপচার করতে পারবেন না। কিন্তু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বিশেষ করে বার্ন ইউনিটের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবুল কালামসহ অন্যরা হাল ছাড়েননি। তারা সাহস করে এগিয়ে এসেছেন। গত ১২ জুলাই ঢামেক হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয় মুক্তামণিকে। এতদিন মুক্তামণির রোগটিকে বিরল রোগ বলা হলেও ৫ আগস্ট তার বায়োপসি শেষে জানা গেছে, মুক্তামণির রক্তনালীতে টিউমার হয়েছে যেটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘ হেমানজিওমা’ বলা হয়ে থাকে।
×