ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

পাপের ধন যায় প্রায়শ্চিত্তে!

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ১৩ আগস্ট ২০১৭

পাপের ধন যায় প্রায়শ্চিত্তে!

ফোরকান সাহেবের কান মোটেও চারখানা নয়। আমার আপনার মতো সেও জন্মসূত্রে কান পেয়েছে দুটো। তবে কান থাকলেই শোনা হয় না, ঠিক যেমন চেয়ে থাকার নাম দেখা নয়। এই দুনিয়ার রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করতে চাইলে দেখার মতো চোখ চাই। ফোরকান সাহেব মানুষ ভাল। বেকার হলেও তার কাজের অভাব নেই। কোন কারণ ছাড়াই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। নিজের জন্য না হোক, পরের উপকারে তার বিন্দুমাত্র আলস্য বা অনীহা নেই। নিন্দুকেরা বলেন, ফোরকান সাহেব বড্ড ওপরপড়া স্বভাবের মানুষ। কিন্তু আমি জানি, এটা ওর দোষ নয়, মানুষের উপকার করা বরং ভাল। উত্তম চরিত্রের পরিচয়। তবে একখানা দোষ তার আছে বটে। মস্ত দোষ বলতে পারেন। ফোরকান বড্ড বেশি শোনেন। কানাঘুষা, ফিসফাস, কানাকানি, চাপাস্বর কিছুই তার কান এড়ায় না। এমন কি যে কথা এখনও বলা হয়নি, ভবিষ্যতে বলা হতে পারে, তাও নিমিষে বুঝে ফেলেন ফোরকান। শুধু কানের ফুটো নয়, ওর পঞ্চেন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটি যেন বড্ড বেশি এ্যাকটিভ! মানুষের চোখমুখ দেখেই দিব্যি তার মনের কথা বুঝে ফেলেন আমাদের ফোরকান সাহেব। সেই গানের মতো, চোখ যে মনের কথা বলে। দুষ্টু ছেলের ডেপোমি বোঝানোর জন্য যেমন বলা হয়, এইটুকুন বাচ্চা, দেখো কেমন চোখেমুখে কথা বলে। আগেই বলেছি ফোরকান সাহেব কিঞ্চিত ওপরপড়া, তবে ওপর দালাল নয়। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তার ভিতরে কোন তাগিদ নেই। কারও মনে দুঃখ দেবার এতটুকু বাসনা নেই তার। কিন্তু একটাই সমস্যাÑ কানে বড্ড বেশি শোনেন ফোরকান। পাড়ার কেষ্টবিষ্টু সেফায়েত সাত সকালে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছে! দেখে মনের ভিতর কেমন যেন খটকা লাগল ফোরকানের। কানাঘুষায় শুনেছে সেফায়েত মোল্লার সংসারে ধোঁয়া দেখা গেছে। তার মানে আগুন জ্বলতে আর দেরি নেই। কানাঘুষা মানে স্রেফ গুজব। এর সত্যতা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। ফোরকান সাহেবও ব্যাপারটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। কিন্তু না নিলে কী হবে, অন্ধ হলে কি আর প্রলয় বন্ধ থাকে! স্রেফ গুজব হলে এই সাত সকালে সেফায়েত মোল্লা কোথায় চলেছেন? ব্যাপার কী ভায়া, এই কাকভোরে চলেছেন কোথায়? ঠোঁটের কোণে মোলায়েম হাসি মেখে নিয়ে বললেন ফোরকান সাহেব। জাহান্নামে? তাতে তোমার কী? অমনি ঘাউ করে উঠলেন সেফায়েত মোল্লা। ফোরকান সাহেব সাদাসিধে মানুষ। অতসব ঘোরপ্যাঁচ বোঝেন না। বললেন, তা জায়গাটা কোথায় শুনি! কেনই বা যাচ্ছেন? বেড়াতে! তোমার পিণ্ডি চটকাতে! এবার বুঝেছ! সেফায়েতের কণ্ঠে মৌসুমী পেঁয়াজের ঝাঁজ। সামনে বড় ঈদ আসছে। পেঁয়াজের ঝাঁজ এমনিতেই বেশি। সঙ্গে যোগ হয়েছে গরম মশলার আগুন। রীতিমতো তাণ্ডব শুরু“ হতে যাচ্ছে। সেফায়েতের কণ্ঠে বাড়তি উষ্মা ওর কান এড়াল না। কারণ ফোরকান সাহেব প্রয়োজনের চেয়ে কানে বেশি শোনেন। কিন্তু তিনি মানুষ ভাল, তাই খোঁচাটা একদম গায়ে মাখলেন না। মোলায়েম স্বরে পুনরায় শুধালেন, তা ভায়া কবে ফিরবেন শুনি! নাকি আর ফিরবেন না! বলা বাহুল্য, তার এই শেষের কথাটা যে কোন মানুষকে খেপিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। জাহান্নামে যাচ্ছে, সেখান থেকে ফিরবে কিনা সে নিশ্চয়তা কে দিতে পারে! কথাটা যে স্রেফ কথার কথা সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি নিশ্চয়ই ফোরকানের আছে। তার মানে ফোরকান ঠিক ততটা সরল সোজা নয় যেমনটি পাড়াত দাদারা তাকে মনে করে! কান চারখানা না হলেও তার মগজে প্যাঁচ আছে। অথচ চোখমুখ দেখে কিচ্ছুটি টের পাবার উপায় নেই। যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না! সেফায়েত সাহেব হাঁটছেন, তার পেছন পেছন লেঙুরের মতো চলছেন ফোরকান সাহেব। বললেন, তা ভায়া সমস্যাটা কী একটু খুলে বলবেন! পারিবারিক নাকি অর্থকড়ি সংক্রান্ত! নাছোড়বান্দা ফোরকান। তোমার মাথা! অর্থই যত অনর্থের মূল! টাকা পয়সার কথা একদম বলবে না, বলে দিলুম। রামঝাড়ি কষালেন সেফায়েত মোল্লা। আহা হা চটছেন কেন! আমি আপনার উপকার করতে চাই। বলুন না কী হয়েছে! কষ্ট করে জাহান্নামে যাবেন! ওখানে কি উকিল-ব্যারিস্টার আছে! কে বুদ্ধি দেবে! তারচে বরং চলুন না মোড়ের ওই চায়ের দোকানটায় গিয়ে বসি। মাথা ঠাণ্ডা করে সব বলুন আমাকে। দেখি, মুশকিল আসানের কোন উপায় বের করতে পারি কি না। সেফায়েত সাহেব নিমরাজি হলেন। সহসাই ব্রেক কষে পদদ্বয়ের গতি কমালেন। সত্যি বলছেন! শুনেছি আপনি নাকি ওপরপড়া হয়ে মানুষের উপকার করেন। তা চলুন না, চায়ের দামটা না হয় আমিই দিলুম। সাগ্রহে বললেন সেফায়েত মোল্লা। চায়ের দোকানে পা ছড়িয়ে বসলেন মধ্যবয়সী দুজন। ফোরকান হাঁক দিলেন, এই কে আছিস, ঠাণ্ডা পানি দে। তারপর চা-আন। চায়ের সঙ্গে টাও দিস কিন্তু। অমনি অর্ডার দিয়ে ফেললেন ফোরকান। টাকা দেবে গৌরী সেন, তার তো কোন সমস্যা নেই। উঁহু, চায়ের সঙ্গে আবার টা কেন! মিছেমিছি অসময়ে বাড়তি খরচ। অসময় বলছেন কি ভায়া, এটাই তো চা-নাশতার সময়! কিচ্ছু ভাববেন না, টায়ের পয়সাটা না হয় আমিই দিলুম। ফোরকানের কথা শুনে একটু ধাতস্থ হলেন হাড়কেপ্পন সেফায়েত মোল্লা। চা এলো, সঙ্গে টাও। পুরি-সমুচা। কলিজার সমুচায় কামড় দিয়ে সেফায়েত বললেন, আর বলবেন না ভায়া, পায়ের ঘাম মাথায়, সরি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুটো পয়সা করেছিলুম। সুযোগ বুঝে দুদক, আয়কর, ট্রুথ কমিশন একেবারে ছেঁকে ধরেছে। দুদিন বাদে বাদে এসে দরজায় কড়া নাড়ে। প্রাইভেসি নষ্ট করে। সম্পত্তির হিসেব চায়। সম্পত্তি কি ওর বাপের যে কোথায় কী রেখেছি সব খোলসা করে দেব! যত্তো সব উটকো ঝামেলা! এই কথা! তা ভায়া, টাকা কামালে তো আয়কর দিতে হয়। কাগজ-পাতি সব ঠিক রাখতে হয়। রাতের আঁধারে জাল ফেলে টাকা ধরে হাঁড়িতে পুরে রাখলে তো চলবে না। রাষ্ট্রকে তার হিসেব দিতে হয়! এটাই নিয়ম। নিয়ম! যত নিয়ম কেবল এই অধমের বেলায়। রুই-কাতলারা সব দেশটাকে শেষ করে মুড়োসুদ্ধ সাবড়ে দিচ্ছে তাতে কোন দোষ নেই। জেলে গিয়ে দুদিন ভালমন্দ খেয়ে আবার টপাটপ সব বেরিয়ে আসছে। আইন তাদের টিকিটিও ছুঁতে পরাছে না! আমি এর কিছু একটা বিহিত চাই। আমার কামানো টাকায় রাষ্ট্র কেন ভাগ বসাবে! দেখি কি করা যায়! এবার বলুন, কালরাতে আপনার ঘরে চিল-চিৎকার শুনলাম। কাপ-পিরিচ ভাঙার শব্দ! বিষয়টা কী! আপনি তাও শুনেছেন! বলিহারি যাই আপনার কানের। এতকিছু টের পান কি করে! চারখানা কান আছে তাই! নাকি লুকিয়ে আড়ি পেতেছিলেন! ভুলেও ওকাজ করবেন না। নিক্সন সাহেবের মতো দিনেদুপুরে ফেঁসে যাবেন! তবে শুনুন, আমার স্ত্রী আর সাধের শ্যালিকার এ্যাকাউন্টে কিছু টাকা রেখেছিলুম। কথা ছিল দরকার হলে তুলে নেব। কিন্তু এখন এই চরম বিপদের দিনে বেঁকে বসেছে ওরা। কেউ আর চেকে স্বাক্ষর দিতে রাজি হচ্ছে না। বুঝুন ঠেলা! যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! দুবোন মিলে আমার সঙ্গে বিট্রে করল! আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। কোর্টে যাব, মামলা করব! সহসাই উত্তেজিত হয়ে পড়লেন সেফায়েত সাহেব। কোর্টে গিয়ে কী আর হবে ভায়া! মামলা লড়বেন! কিন্তু কোন আইনে! কিসের অভিযোগ তুলবেন! কিছু বলতে গেলে তো আপনি নিজেই ফাঁসবেন ভায়া! তারচে আমি বলি কি ভায়া, ছেড়ে দিন। কষ্ট করে আর দুর্গন্ধ ঘাঁটবন না। যা গেছে যাক। এবার বরং নতুন করে শুরু“ করুন। হকের কামাই নিজের নামে রাখুন। পাপের টাকা এভাবেই বেহাত হয়! আপনার কাঁধে বন্দুক রেখে দিব্যি আপনার স্ত্রী আর তার বোন পাখি শিকার করে খাচ্ছে। এজন্যই বোধ হয় বলে পাপের ধন যায় প্রায়শ্চিত্তে! লেখক : রম্যলেখক, কথাসাহিত্যিক
×