ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাশেদ রউফ

তীর্থভূমি

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১২ আগস্ট ২০১৭

তীর্থভূমি

প্রতিদিনের মতো আজও নওশাদের ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। জানালার পাশে ব্যালকনির গ্রিলে বসে ডাকছে পাখি। পাখিটিকে খুব পছন্দ করে নওশাদ। তার নাম শালিক। তাকে নিয়ে কবিরা কবিতাও লিখেছেন। শালিক শালিক শালিক ওরা রোদে পোড়ে। ছায়ায় ঘোরে। ওরা রৌদ্র ছায়ার মালিক। আসলে তো! ওরা রোদ আর ছায়া- দুটোরই মালিক। পাখির ডাক সবার কানে পৌঁছলেও সবাই কিন্তু পাখির ভাষা বোঝে না। পাখির ভাষা বোঝে নওশাদ ও নওশাদের মা। প্রতিদিন ভোরে গ্রিলে বসে ডাক দেবে। আর অমনি নওশাদের মা পাখির জন্য নিয়ে যাবেন ভাত, চাল আর বিস্কুটের গুঁড়া। নওশাদও বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়ে। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। আজ কিন্তু পাখিটা কাউকে ডাকেনি। আজ সে গান ধরেছে। গান শুনছে নওশাদ ও তার মা: আমার খোকা চাঁদ হয়ে যায় আমার খোকা তারা আমার খোকা আকাশজুড়ে নামায় জোছনা ধারা। আমার খোকা ফুল হয়ে যায়, আমার খোকা পাখি ঘরে ঘরে সুবাস ছড়ায় করছে ডাকাডাকি। আমার খোকা গান হয়ে যায় আমার খোকা কবি আমার খোকার কথা নিয়ে শিল্পী আঁকেন ছবি আমার খোকা দেয় ধরা আজ হরেক রকম বেশে আমার খোকা মিশে আছে সারা বাংলাদেশ। বাহ! কী সুন্দর গান! পাখিটি বলল-এটি গান ছিল না, এটি ছিল একটি কবিতা। পাঠ্যপুস্তকে ছাপানোর কথা ছিল। কিন্তু কবিতাটি যাকে নিয়ে লেখা, তাকে তখনকার সরকারের পছন্দ ছিল না। পাখির কথাগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে শুনেছে নওশাদ। পাখিটি বলে : গ্রাম বাংলার এক আদুরে নাম খোকা। ভালবাসার খোকা। খোকা নদীর পাড়ে বেয়ে হাঁটত, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটত। গাছে চড়ত। পাখি দেখত। ফুটবল খেলত। গরিব-দুঃখীর পাশে দাঁড়াত। সেই খোকা একদিন বড় হয়। বাঙালী জাতিকে স্বপ্ন দেখায়। বুকে আশা জাগায়। সেই খোকা একসময় পরিণত হয় বাঙালীর আপনজনে। খোকা হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। হলেন জাতির পিতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাখিটি এবার নিশ্বাস নেয়। পাখির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নওশাদ। হা করে সে সব শুনছে। আজ স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই। স্কুল ছুটি। পাখির কথা শুনতে তার ভাল লাগছে। পাখিটি এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে : যে মানুষটি আজীবন সংগ্রাম করেছেন মানুষের জন্য, বিদেশী শাসন-শোষণের যাঁতাকল থেকে দেশকে মুক্ত করেছেন, দেশের মানুষের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হননি, জনগণকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, সেই মানুষটিকে মেরা ফেলা হলো? ওরা কি মানুষ? ওরা বেজন্মার দল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই খোকাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। তাঁকে হত্যার পর বাংলাদেশ চলছিল আবার পাকিস্তানী কায়দায়। একুশটি বছর যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা কেউ বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করত না। তাই ‘খোকা’ কবিতাটি তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে ধারণা করে পাঠ্যপুস্তকে প্রকাশ করতে চায়নি ওরা। সেটি সম্পাদনার টেবিল থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। ৪ তলা ভবনের কক্ষ থেকে এটি উড়তে উড়তে সৌভাগ্যক্রমে এসে পড়ে বিখ্যাত সুরকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠ সৈনিক শিল্পী অজিত রায়ের মাথায়। অজিত রায় মুচড়ানো কাগজটা হাতে নিলেন এবং কৌতূহলবশত তাতে কী লেখা আছে, তা দেখার চেষ্টা করলেন। দেখলেন- সুন্দর একটি মিল কাব্য। বাসায় গিয়ে দেরি না করে তিনি সেটাতে সুর দেন। আর এই সুরটাই এখন আমি করছি। যে গান এখন অনেকের মুখে মুখে। চমৎকার।- নওশাদ বলে উঠল। -এটি একটি ইতিহাস। পাখিটি আবার বলে : আজ ১৫ আগস্ট। খোকাকে হারানোর নৃশংসতম দিন। একুশ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতায় আসার পর এই দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হয়। আজ সেই শোকের দিন। কান্নার দিন। পাখির কথাগুলো কান্নার মতোই শোনাচ্ছে। নওশাদেরও কান্না পায়। যেই মানুষটি আপামর লোকজনের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন, সেই মানুষটিকে কেন মেরে ফেলা হলো? একা নয়, সপরিবারে? পাখিটি আবার বলে : আমি আজ খোকার সঙ্গে দেখা করতে যাব। টুঙ্গিপাড়ায়। যেখানে শায়িত আছেন বাঙালী এই মহানায়ক। তাঁকে তো আর দেখতে পাব না! তাঁর কবরটা দেখব। পাখি আরও বলে : জানো নওশাদ! তাঁর কবরের ওপর কোন ছাদ নেই। আকাশই ছাদ হয়ে ছেয়ে আছে খোকাকে। আমি সেই আকাশে উড়ে উড়ে তাঁকে দেখব, তাঁর সঙ্গে কথা বলব। এই বলে বাঙালীর তীর্থভূমি টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে ডানা মেলল পাখিটি। নওশাদের ইচ্ছে হয় যেতে। কিন্তু তার তো ডানা নেই। তখন সে প্রতিজ্ঞা করে, বড় হয়ে একদিন সেও তীর্থভূমিতে যাবে। অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×