ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে ষ দু’সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায় আমদানি মূল্য বাড়ার অজুহাত ব্যবসায়ীদের

পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়ছেই

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১২ আগস্ট ২০১৭

পেঁয়াজের ঝাঁজ বাড়ছেই

এম শাজাহান/হাসান নাসির ॥ কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পেঁয়াজের দাম বাড়ছেই। দ্বিগুণ দামে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। এ দামেও পেঁয়াজ মিলবে কি-না সে সংশয় খুচরা ব্যবসায়ীদের। আর দুই সপ্তাহে দাম দ্বিগুণ হওয়ায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার বাজার করতে এসে অনেক ভোক্তাই মাথা ঠুকেছেন। বলেছেন, দেশে এমন কী হলো যে দ্বিগুণ দামে পেঁয়াজ কিনতে হবে? কোরবানির ঈদ সামনে রেখে মজুদ বাড়িয়ে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্যা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় আমদানিমূল্য বেড়েছে। অপরদিকে ভোক্তাদের অভিযোগ, এটা স্রেফ অজুহাত। প্রতি ঈদেই তারা এভাবে মূল্য বাড়িয়ে থাকেন। তবে মিসরসহ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় দাম কমে আসবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। এদিকে, তরিতরকারির উচ্চমূল্যেও নাকাল ক্রেতাসাধারণ। বিশেষ করে স্বল্প আয় ও নিম্ন মধ্যবিত্ত লোকজনের ত্রাহী অবস্থা। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে বাড়ছে পেঁয়াজের মূল্য। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বন্যা, সড়ক যোগাযোগে বিপর্যস্ত অবস্থাসহ নানা কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় এবং মজুদ পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মূল্যের এ উর্ধগতি বলে জানাচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, এখন আমদানিতেই মূল্য বেশি পড়ে যাচ্ছে। ফলে একেবারে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজিতে যুক্ত হচ্ছে অতিরিক্ত অন্তত ১০ টাকা। তবে বাজারের এ উর্ধগতি থাকবে না জানিয়ে তারা বলেন, কোরবানির ঈদের আগেই বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে। তবে এমন আশ্বাস মানতে আপত্তি খুচরা পর্যায়ের দোকানিদের। কেননা, মিসর, তুরস্ক বা পাকিস্তান থেকে যে পেঁয়াজ আমদানির কথা বলা হচ্ছে তা এলসি হয়ে জাহাজীকরণের মাধ্যমে দেশে এসে পৌঁছতে সময় নেবে। আর এরই মধ্যে পাইকাররা পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছেন। খাতুনগঞ্জ ট্রেড এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমেদ জানান, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে প্রায় ১৮ লাখ টন উৎপাদন হয় দেশেই। বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় ছয় লাখ টন পেঁয়াজ। এর মধ্যে বেশিরভাগই আসে ভারত থেকে। মিয়ানমার থেকেও কিছু পেঁয়াজ আমদানি হয়। অতিসম্প্রতি বন্যায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য প্লাবিত হয়েছে। ভেঙ্গে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এতে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেশে প্রবল বর্ষণে সড়ক বিধ্বস্ত হওয়ায় অভ্যন্তরীণ বিপণন ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। তবে এ বৃদ্ধি সাময়িক। কারণ ভারত ছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পেঁয়াজ এমনই একটি পণ্য যার কৃত্রিম সঙ্কট ঘটিয়ে মুনাফা করা অত সহজ নয়। কারণ এ পণ্যটি বেশ দ্রুত পচে। তাই মজুদ করে রাখা যায় না। পেঁয়াজ এলে বাজারে ছেড়ে দিতে হয় বেশ দ্রুত। ফলে কোন অবস্থার পেক্ষিতে পেঁয়াজের দাম যে গতিতে উর্ধমুখী হয়, সে একই গতিতে আবার নিম্নমুখীও হয়। আবহাওয়ার উন্নতি হচ্ছে। ফলে কোরবানির ঈদের আগেই পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে জানাচ্ছেন তারা। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানিমূল্য বেড়ে যাওয়ায় এখন পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে মিসর এবং তুরস্ক থেকেও। এছাড়া পাকিস্তান থেকেও পেঁয়াজ আমদানির চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে আমদানিও যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু দাম পড়ে যাবে বলে মনে করেন তারা। এদিকে, কোরবানির ঈদ আসায় রসুন-আদার বাজারেও পরিলক্ষিত হচ্ছে উর্ধমুখিতার আলামত। এ দুটি পণ্যের মূল্য গত সপ্তাহের তুলনায় একটু বেশি। বাজারে চীনা রসুনের দাম উঠেছে ১১০ টাকায়। চীন থেকে আমদানি করা আদার মূল্য ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। তবে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হওয়া রসুন-আদার মানে তারতম্য থাকায় দামেরও হেরফের রয়েছে। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, জিরা, এলাচসহ বিভিন্ন মসলার দামের উর্ধমুখিতা এ দেশে বরাবরই হয়ে আসছে। এবারও যে তেমনই হবে তা ভোক্তাদের জানাই ছিল। সেক্ষেত্রে বন্যা এবং দুর্যোগকে তারা দেখছেন দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে। তবে পেঁয়াজের মূল্য নিয়ে হৈচৈ হলেও তরকারির উচ্চমূল্য নিয়ে ততটা কথা নেই বলে অভিমত ক্রেতাসাধারণের। শুক্রবার ছুটির দিনে সকাল বেলায় বৃষ্টি মাথায় করে বাজারে চলে আসেন ক্রেতারা। শ্রাবণ শেষে নদী ও সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। ওই ইলিশ রাজধানীর বাজারগুলোতে আসা শুরু হয়েছে। দাম না কমলেও মিলছে ইলিশ। ভোক্তাদের স্বস্তি এখানেই। চাল, ডাল, আটা, ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে আগের দামে। কমেছে শুধু চিনির দাম। দুই টাকা কমে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৬-৬০ টাকায়। তবে প্যাকেটকৃত চিনি আগের মতো বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে সবজির দাম। ৬০ টাকার নিচে কোন সবজি মিলছে না। বিক্রেতারা বলছেন, টানা বৃষ্টি ও বন্যার কারণে সবজিক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। সবজির সরবরাহ কমে গেছে। আর এ কারণে বাড়ছে দাম। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা দরে। এর আগে দুই সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল ২০ টাকা। অর্থাৎ তিন দফায় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা। এছাড়া আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। গত সপ্তাহের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে কাঁচামরিচ। বাজারে কাঁচামরিচ কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা দরে। এছাড়া কেজিপ্রতি দেশী রসুন ১০ টাকা বেড়ে ১১০ টাকা, ভারতীয় রসুন ১৩০ টাকা, আলু কেজিপ্রতি দুই টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৪ টাকা দরে। কাপ্তানবাজারের ক্রেতা জসিম জানালেন, পেঁয়াজের দাম বেড়েই যাচ্ছে। দেখার যেন কেউ নেই। ৩০ টাকার পেঁয়াজ এখন ৬০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এভাবে চললে কোরবানির আগে পেঁয়াজের পারদ কোথায় ঠেকে সেটাই দেখার বিষয়। তিনি বলেন, অন্যান্য জিনিসের দাম না কমলেও বাজারে ইলিশ দেখা যাচ্ছে। এটাই বাজারের স্বস্তি। এছাড়া সবজিসহ সব পণ্যের দাম বাড়তি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানা বৃষ্টির কারণে আড়তে পেঁয়াজ, রসুন ও আলু সংরক্ষণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উৎপাদন পর্যায়ের কৃষকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে এর প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচে। কাপ্তানবাজারের পেঁয়াজ, রসুন ও আদা বিক্রেতা মনির জানালেন, পাইকারি বাজারে হু হু করে দাম বাড়ছে। আর এ কারণে খুচরা বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, দাম কমাতে হলে বাজারে আমদানিকৃত ভারতীয় পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়াতে হবে। তা না হলে কোরবানি সামনে রেখে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ পেঁয়াজ আমদানি বাড়ানো হয়েছে বলে সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। তিনি বলেন, কোরবানি সামনে রেখে এবার ভারতের পাশাপাশি মিসর থেকেও পেঁয়াজ আমদানি করা হবে। সরকারী এসব উদ্যোগের ফলে পণ্যটির দাম আর বাড়বে না। এদিকে কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেগুন কেজিপ্রতি ৬০-৮০ টাকা, শিম ১২০ টাকা, হাইব্রিড টমেটো ১৬০ টাকা, দেশী টমেটো ১০০ টাকা, শসা ৬০ টাকা, চাল কুমড়া ৫০-৫৫ টাকা, কচুর লতি ৬০-৬৫ টাকা, পটল ৫০-৫৫ টাকা, ঢেঁড়স ৫০-৫৫ টাকা, ঝিঙে ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০-৫৫ টাকা, করলা ৫০-৫৫ টাকা, কাকরোল ৫০ টাকা, পেঁপে ৪০-৫০ টাকা, কচুর মুখী ৫০-৫৫ টাকা, আমড়া ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি ফুলকপি ৩৫ টাকা, বাঁধাকপি ৩০ টাকা এবং লেবু হালিপ্রতি ২০ থেকে ৪০ টাকা, পালংশাক আঁটি প্রতি ২০ টাকা, লালশাক ২০ টাকা, পুঁইশাক ৩০ টাকা এবং লাউশাক ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্যতেল আগের মতো বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে ব্র্যান্ডভেদে পাঁচ লিটারের বোতল ৫৩০-৫৪০ টাকা, প্রতি লিটারে ১-২ টাকা বেড়ে ১০৭ টাকা থেকে ১০৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চালের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মোটা স্বর্ণা চাল প্রতি কেজি ৪৩-৪৪ টাকা, পারিজা চাল ৪২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মিনিকেট (ভাল মানের) ৫৪-৫৬ টাকা, মিনিকেট (সাধারণ) ৫৩ টাকা, বিআর-২৮ ৪৮ টাকা, সাধারণ মানের নাজিরশাইল ৫০-৫৮ টাকা, পাইজাম চাল ৪৮ টাকা, পোলাও চাল (পুরাতন) ১০০ টাকা, (নতুন) ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
×