ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ॥ নিভৃতে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহযোগী

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১১ আগস্ট ২০১৭

ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ॥ নিভৃতে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহযোগী

কোন কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষ্মী নারী। নারীকে নিয়ে বিদ্রোহী কবির এই নারী। বোধ আর অভিব্যক্তিই বলে দেয় যুগে যগে কিভাবে আন্দোলনে, সংগ্রামে, অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তাদের যুগান্তকারী ভূমিকা সমাজ-সংস্কারের ভিত্তিকে মজবুত করেছে, উদ্দীপ্ত চেতনায় অলঙ্ঘনীয় সমস্যার সহজ সমাধানও এসেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বিশ্ববরেণ্য নেতা, যাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আজও সারা দুনিয়াকে বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়, যাঁর লড়াকু আর তেজোদ্দীপ্ত বলিষ্ঠতায় বাঙালী মুগ্ধ, হতবাক এবং শ্রদ্ধায় অবনত তাঁর গুরুত্বপূর্ণ জীবন প্রবাহে সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছাকে বলা যায় সব সময়ই স্বামীর পাশে থাকা এক দৃঢ় চিত্তের নারী শক্তি। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সিংহভাগ কেটেছে সাধারণ মানুষের জীবন যুদ্ধের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন থেকে অধিকার এবং স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে এক সংগ্রামী সৈনিকের ভূমিকায়। আর সেখানে আড়ালে, আবডালে একান্ত সান্নিধ্য দিয়ে যান স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা যাঁকে বঙ্গবন্ধু রেণু বলে ডাকতেন। এতই নিভৃত চারিণী ছিলেন তিনি জনসমক্ষে এই নিবেদিত নারীর কোন আলাপ- আলোচনাও সেভাবে শোনা যায়নি। বিদেশ সফর, রাষ্ট্রীয় কর্মযোগ, কোন উৎসব আয়োজন কিংবা জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতেও তাঁকে সেবাবে বঙ্গবন্ধুর পাশে দেখাও যেত না। সুতরাং একটি স্বাধীন জাতির স্থপতি কিংবা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিপতির স্ত্রী হিসেবেও তাঁর কোন বিশেষ পরিচিতি ছিল না। কিন্তু দুঃসময়ে, মহাসঙ্কটে, আন্দোলন সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলোতে তাঁর সার্বক্ষণিক অবদান এবং বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে থেকে তাঁকে উৎসাহিত, উদ্দীপ্ত করা আর সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণে নির্দেশিকার ভূমিকা পালন করা এই দৃঢ় চেতানারী ব্যক্তিত্ব আজও লোকচক্ষুর অন্তরালে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনে বিশ্বের ইতিহাসে যে কলঙ্কময় রক্তাক্ত ঘটনার অবতারণা করা হয় তার নির্মম বলিও এই অসামান্য নারী। সাধারণ এক বালিকা থেকে অসাধারণ নারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে তৈরি করা বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক লড়াইয়ের এক উল্লেখযোগ্য আখ্যান। ১৯২০ সালে জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অতি বাল্যকালেই ফজিলাতুন্নেছার বিয়ে হয়। গোপালগঞ্জের মিশনারী স্কুলে পড়া পিতৃ-মাতৃহীন রেণু বিয়ের পর শাশুড়ির স্নেহ ছায়ায় বড় হতে থাকেন। লেখা-পড়ার প্রতি আগ্রহ থাকার কারণেই সুযোগ হয় বিয়ের পরও বাংলা, ইংরেজী এবং আরবীর ওপর জ্ঞান লাভ করার। বাসায় শিক্ষক রেখে তাঁকে অনেকটাই স্বামীর উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করা হয়। বঙ্গবন্ধু তখন শিক্ষার্থী হিসেবে কলকাতায় অধ্যনরত। পাশাপাশি রাজনীতিতেও হাতেখড়ি চলছে। ফলে স্ত্রীর অফুরন্ত সময় কাটে গান শুনে আর গল্পের বই পড়ে। কালে ভদ্রে স্বামী আসেন নিজ পিতৃভবন টুঙ্গিপাড়ায়। বঙ্গবন্ধুর চেয়ে প্রায়ই দশ বছরের ছোট স্ত্রী সংসার পরিচালনায় ক্রমেই দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন। ইতোমধ্যে ১৯৪৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে দেশ বিভাগের মাত্র এক মাস পরে প্রথম সন্তান শেখ হাসিনার জন্ম। ২৭ বছরের যুবক বঙ্গবন্ধু তখন রাজনীতির অঙ্গনে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছেন। ফলে সেভাবে সংসার ধর্মপালন কখনও হয়ে ওঠেনি। এক হাতে স্ত্রীকেই সব সামলাতে হয়েছে। শুধু তাই নয় চরম বিপর্যয়ের সন্ধিক্ষণে স্বামীর পাশে পরামর্শকের ভূমিকায়ও দাঁড়াতে কার্পণ্য করেননি। আমরা জানি ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ্র উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপ্ত, দুঃসাহসিক ভূমিকার কথা। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনে একাত্ম হয়ে যায় আবহমান বাংলা ও বাঙালীর চিরায়ত সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। একইভাবে সাধারণ মানুষের অধিকার এবং দাবি আদায়ের অকুতভয় সৈনিক জাতির জনকের রাজনৈতিক পালাক্রমের যে অনিশ্চিত জীবন সেখানেও স্ত্রীর অনুক্ষণ সাহায্য সহযোগিতা বঙ্গবন্ধুকে কতখানি এগিয়ে দিয়েছিল সেটা জানতেও জাতিকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। পঁচাত্তর পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছরে জাতির জনকের নাম যখন প্রায়ই মুছে যাওয়ার অপেক্ষায় ঠিক সেই যুগসন্ধিক্ষণে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন বাঙালীর জাতীয় জীবনের এক অবিস্মরণীয় দিন। এর পর থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর আপন চেতনা আর বৈশিষ্ট্যে নিজের প্রাপ্য আসনটি ফিরে পেতে থাকেন। পাঁচ সন্তান নিয়ে বেগম মুজিবের সাংসারিক আঙিনা বৃহৎ বলা চলে। কারণ স্বামীর রাজনৈতিক আড়ম্বর আর আপ্যায়ন ও পারিবারিক আবহে বেগম মুজিবকেই সামলাতে হয়েছে সব সময়ই। গ্রামের আত্মীয় স্বজন, অভাবি লোকজনের চাহিদা মেটানোর দায়ভাগও নিজের কাঁধেই নিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে কখনও এই বিষয়গুলো ভাবতেও হয়নি। জাতির সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় ও অনেক স্বাধীন এবং মুক্তচিত্তে রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ-আলোচনায় তাঁকে বিব্রত হতে হয়নি, সহধর্মিণীর সার্বক্ষণিক ছায়ার কারণে। বরং যথাযথ উপদেশ আর পরামর্শ দিয়ে স্বামীর বিপন্ন অবস্থার অংশীদার হতেন। এ প্রসঙ্গে শেখ রেহানার স্মৃতিচারণ উল্লেখযোগ্য- ‘কত অল্প বয়সে এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁকে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছিল। আব্বা আগের দিন মন্ত্রী পরের দিন জেলখানায় বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সরকারী বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে। গ্রামে জন্ম হওয়া একজন সাধারণ নারী আমার মা, ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন মিশনারি স্কুলে। কিন্তু কি প্রজ্ঞা, কি যে তাঁর ধৈর্য। আমার মায়ের কাছ থেকে আমাদের যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য আর সাহস।’ ধৈর্য আর সাহসের সঙ্গে ছিল সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোর এক অদ্ভুত দূরদর্শিতা। আর সেভাবেই ছেলেমেয়েদের গড়ে তুলতে ও নিজের সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী ক্ষমতার সঙ্গে মায়ের অসাধারণ গুণাবলীর অপূর্ব সমন্বয়ই আজকে তাঁর এই অবস্থানে জোরালোভাবে জায়গা তৈরি করার এক অভিনব বলিষ্ঠ প্রত্যয়। যা তাঁর কন্যারা স্বীকার করতে এতটুকু দ্বিধা করেন না। ছেলেমেয়েদের কাপড় কখনও দর্জির দোকান অবধি যেত না। ঘরে মেশিন ছিল। মা-ই তাদের জামা বানিয়ে দিতেন। সব সময় গান শোনা বেগম মুজিবের পছন্দের শিল্পীর তালিকায় থাকতেন জগম্ময় মিত্র, শচীন দেব বর্মণ, সন্ধ্যা-লতা, সরাইয়া আর আব্বাস উদ্দিন। শেখ হাসিনার লেখায় জানা যায়। বার্র্ট্যান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রিয় সাথী রেণুকে রাসেলের বই পড়ে ব্যাখ্যা করতেন। এক সময় বেগম মুজিবও রাসেলের ভক্ত হয়ে যান। যার ছাপ রেখে যান কনিষ্ঠ সন্তান রাসেলের নামের মধ্যে। ১৯৬৯ সালের সেই সাড়া জাগানো গণঅভ্যুত্থান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে তখন বঙ্গবন্ধু কারাবন্দী। বাংলাদেশে তখন বিক্ষোভ আর আন্দোলনের দাবানল জ্বলছে। এমন দেশ কাঁপানো প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে নেয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। সেখানে গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে বসানো হবে। পাকিস্তান সরকারের এই হঠকারী সিদ্ধান্তে বিচলিত ফজিলাতুন্নেছার বিরুদ্ধে তীব্র অসম্মতি জানালেন। এই এক ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণ যা বাঙালী জাতির ভাগ্য নির্ধারণে এক সময়োপযোগী পদক্ষেপের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কালপর্ব। শেখ হাসিনার জবানিতে জানা যায় সেই বিস্ময়কর আর সুচিন্তিত মতামতের এক অভূতপূর্ব সমাধান যা বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ধারাকে আরও গতিশীল করে। ‘ওই সময় প্লেন রেডি, তখন তেজগাঁও এয়ারপোর্টে আব্বাকে উঠায়ে নিয়ে যাবে... আওয়ামী লীগ নেতারাও নেমে পড়েছে। সব চলে গেছে ক্যান্টনমেন্টে যেখানে আব্বাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।’ কালবিলম্ব না করে তিনি শেখ হাসিনা এবং ওয়াজেদ মিঞাকে পাঠালেন সেনানিবাসে। জোর প্রত্যয়ে ব্যক্ত করলেন নিজের সিদ্ধান্ত। কিছুতেই প্যারোলে মুক্তি নেয়া যাবে না। বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বের হয়ে আসতে হবে। জনগণের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেটাই করেছিলেন। সময়ই বলে দেয় স্ত্রীই সঠিক ছিলেন। কারণ এক সময় সামরিক শাসক বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আজও বিশ্বব্যাপী আলোড়িত এক অসাধারণ বক্তব্য যা পৃথিবীর আর কোন নেতার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল কিনা এখনও অবধি জানা যায়নি। সেই ভাষণে বেগম মুজিবের সাবধান এবং সতর্কবাণী বঙ্গবন্ধুকে উদ্দীপ্ত করে। বেসামাল পরিস্থিতি, সামরিক শাসক বেপরোয়া জনগণের জান মাল অনিশ্চয়তার শেষ ধাপে। বঙ্গবন্ধু নিজেও অস্থির, বিব্রত এবং উৎকণ্ঠিতও। এমন বিপন্ন পরিস্থিতিতে স্ত্রী এসে দাঁড়ান পাশে। সাহস দেন, ভরসায় বঙ্গবন্ধুকে আশ্বস্ত করেন। সব সময়ই যেন নজরে থাকে সাত কোটি অসহায়, বিপর্যস্ত বাঙালীর কথা। সারা জীবন দেশের মানুষের জন্য লড়াই করেছেন সেই উদ্দীনায় আজও সেই মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ভেতরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দেশ ও জাতির ভবিষ্যত তৈরি করতে হবে নিজের বক্তৃতায়। যা মনে আসবে তাই স্বচ্ছন্দে নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করে অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নির্ণয় করা এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি জরুরী। বেগম ফজিলাতুন্নেছা সব সময় দেশ ও মানুষের কথা ভেবেছেন। কোন স্বার্থান্ধ বুদ্ধি বিবেচনায় নিজেকে কখনও জড়াননি। এক সময় দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে জামাতা ওয়াজেদ মিঞাকে সংগঠনে পদ দেয়ার। সেই খানেও অবিচলিত চিত্তে অপ্রতিরোধ্য হয়েছিলেন। কোনভাবেই তা হতে দেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগের দিনগুলোতে বেগম মুজিব কেমন ছিলেন? তিনি কি আঁচ করতে পেরেছিলেন কোন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ কিংবা নৃশংস হত্যাকা-ের? এমনই ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও তার সত্যতা যাচাই করার ক্ষমতা কারও নেই। ১৫ আগস্টের সেই বিষণœ অনুভবকে স্মরণ করে বেগম মুজিবের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে মূল্যায়ন করা সত্যিই অত্যন্ত প্রয়োজন। সারা জীবন বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের একান্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী যিনি ছায়ার মতো পাশে পাশে থাকতেনÑ মরণের কালেও স্বামীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে চির বিদায় নিলেন। তাঁকে স্মরণ করতে না পারলে জাতির ঋণ কোনদিন শোধ হবে না। আবারও নজরুলকে স্মরণ করছি- কোন রণে কতখুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে, কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নেই তার পাশে।
×