ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১১ আগস্ট ২০১৭

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

(পূর্ব প্রকাশের পর) রকি মাউন্টেন আমার সহধর্মিণী ডাঃ প্রীতিলতা তখন জাতি সংঘের ডাক্তার। একদিন সকালে সেই সুদূর সুদানের দারফুর জাতি সংঘের অফিস থেকে ফোন করে আমাকে বলে-’জান আজ ওয়েভ সাইডে একটা সুন্দর তথ্য দেখলাম।’ জানতে চাওয়াতে তিনি জানালেন মৃত্যুর পূর্বে পৃথিবীর দশটা প্রাকৃতিক আশ্চর্যজনক স্থান দর্শন করে মরা উচিত। এই দশটা প্রাকৃকিত সৌন্দের্যের মধ্যে রকি মাউনন্টেনও একটা স্থান দখল করে বসে আছে। বললাম ভয় নেই মৃত্যুটাকে যদি আটকেও রাখতে হয় তাও রাখব তবুও সেই দশটা আশ্চর্যজনক স্থান পরিদর্শন না করে নিজে মরব না কাউকে মরতেও দেব না। কি দুঃসাহস স্বয়ং ঈশ্বরের সঙ্গে টেক্কা দেয়া। টেক্কা না দিয়ে কি করব তখন থেকেই পরিকল্পনা করছি কিভাবে রকি মাউন্টেনের চুড়ায় উঠে মনোবাসনা পূর্ণ করব। খোঁজখবর করতে করতে বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই সন্ধান পাওয়া গেল যারা রকি মাউন্টেন সংলগ্ন বিভিন্ন কানাডীয় শহর ও শহর তলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করে দিলাম। স্বপন চৌধুরী আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। বাড়ি সাতক্ষীরা, ওই সাতক্ষীরা কলেজেই তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের ছাত্র হওয়ার পরও একসঙ্গে ওঠাবসা, আড্ডা মারার একপর্যায়ে তার অন্যান্য ভাই বোনদের সঙ্গেও পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমার বোনদের সঙ্গে ওর বোনদের বন্ধুত্ব আমাদের এই বন্ধনটাকে আরও সুদৃঢ় অবস্থানে নিয়ে যায়। একসময় পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে যে যার মতো কর্মজীবনে এদিক ওদিক চলে যাওয়াতে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেকটা শীথিলতা নেমে আসে। একসময় খবর পেলাম স্বপন বাংলাদেশ সরকারের ক্যাডার সার্ভিসের ম্যাজিট্রেটের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে কানাডা চলে গেছে। এরপর দীর্ঘ সময় স্বপন ও তার বোনদের সঙ্গে যোগাযোগে একেবারে ভাটা পড়ে যায়। পুনরায় তৎপর হয়ে উঠলাম স্বপনকে খুঁজে বের করার, যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম রকি মাউন্টেন দেখতে যাব। খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি। বন্ধুবর স্বপন চৌধুরীর বড় দাদা, তপন চৌধুরী আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তার নামে ওয়েভ সার্স দিতেই পেয়ে গেলাম তাঁর ইমেল ঠিকানা। অধ্যাপক তপন দাদাকে আমার পরিচয় দিয়ে ইমেল দিতেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। প্রথমে ঠিক করেছিলাম জুলাই মাসের মাঝামাঝি কোন এক সুবিধামতো সময়ে আমরা হোয়াটহর্স, যেখানে স্বপনের আপাতত নিবাস ভূমি এবং যেখান থেকে রকি মাউন্টেনের শুরু সেখানে গিয়ে হাজির হব তার পরের দায়িত্ব বন্ধুবরের। এরই মাঝে আমার চাকরি জীবনের আর এক বন্ধু শৈলেন দাসের সন্ধান মিলে গেল ফেসবুকের কল্যাণে যে কিনা খোদ রকি মাউন্টেনের কেন্দ্রস্থল ক্যালগেরিতে বউ ছেলেসহ সুখের সংসার নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। একে একে কেমন করে সব বন্ধুদের পেয়ে গেলাম। এদিকে প্রীতিলতাও বসে নেই সেও খোঁজ করেছে তার অতি আদরের ছোট ভাই প্রকৌশলী রানা দে কে। যাকে আবিষ্কার করা হয়েছিল দারফুর থেকে, সেও যখন ইউএনের প্রকৌশলী। সৌভাগ্যক্রমে রানাও থাকে ক্যালগেরি। সব মিলিয়ে বন্ধুদের একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়ে গেল। এখন যাত্রার আয়োজনের পালা। অনেক ঘাটাঘাঁটি করে সস্তায় ওয়েস্টজেট এয়ার লাইন্সের একটা রিটার্ন টিকেট কেটে ফেললাম। পরিকল্পনা অনুসারে প্রথমে আমাদের স্বপনের ওখানে ওঠার কথা। কিন্তু সকল বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম ভ্যানকুভার থেকে বাসে করে আমরা প্রথমেই ক্যালগেরি যাব এবং সেখানকার দর্শনপর্ব সমাপান্তে হোয়াটহর্স ফিরব, সেই মতো হোটেল বুকিং শেষে বাসের টিকেট কাটতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। ল-ন বসে ভ্যানকুভার বাস কাউন্টারের ভদ্র মহিলার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম হোটেল থেকে বাস টারমিনালের দুরুত্ব মাত্র ৭৭ কিলোমিটার তাই বাসে করে ক্যালগেরি আসার পরিকল্পনা বাতিল। অবশেষে ভ্যানকুভার ক্যালগেরি বিমান ভ্রমণ অপরিহার্য হয়ে পড়ল। যদিও ল-ন থেকে সরাসরি ক্যালগেরি আসা যেত কিন্তু সেটাও আর সম্ভব ছিল না অগ্রিম বুকিং দেয়া ও টিকেট কেটে ফেলার কারণে। অগত্যা ২৬ আগস্ট ২০১৬ যেদিন আমাদের ভ্যানকুভার পৌঁছানোর কথা সেই দিনই ক্যালগেরির টিকেটও অগ্রিম কেটে নিলাম। যাওয়ার পথে ভ্যানকুভার যাত্রাবিরতির কোন সম্ভাবনা আর থাকল না। সকল আয়োজন সমাপ্ত এখন অভিযান শুরুর অপেক্ষা মাত্র। আমাদের লন্ডনের বাড়ি থেকে গ্যাটউইক এয়ারপোর্টের দুরুত্ব পঞ্চাশ মাইলেরও বেশি। এমন কাউকে পাওয়া গেল না যিনি আমাদের এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিতে পারেন। যদিও যোগাযোগের দিক থেকে লন্ডন পৃথিবীর সব থেকে উন্নত শহর তাতে কোন সন্দেহ নেই। এত সুন্দর পাবলিক সার্বিস খুব কম শহরে আছে। আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে যথা সময়ের অনেকটা আগেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেলাম। কিন্তু প্রথম চোটেই ধাক্কা খেলাম এই সংবাদ শুনে যে আমাদের ওয়েস্টজেটের নির্ধারিত ফ্লাইট মাত্র এক ঘণ্টা তিরিশ মিনিট বিলম্বে ছাড়বে। কি আর করা সকালে ব্রেকফাস্ট করে আসতে পারিনি তাই এই সুযোগে বিমানে ওঠার সমস্ত কিছু সেরে ভারি একটা ভোজনের আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন করে ফেললাম। এবারের নির্ধারিত সময়ে যাত্রা শুরু হলো। দশ ঘণ্টা দশ মিনিটে আমাদের ভ্যানকুভারে অবতরণ করার নির্দিষ্ট সময়। তবে বিমানে চড়েই অবহিত হলাম বাতাস অনুকূল থাকার কারণে ফ্লাইট টাইম এক ঘণ্টা কমে পূর্ব নির্ধারিত সময়েই অর্থাৎ স্থানীয় সময় একটা বেজে পাঁচ মিনিটেই ওয়েস্টজেটের ফ্লাইটটি ভ্যানকুভারের পবিত্র মাটি স্পর্শ করবে। আমার এই দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ জীবনে এবারই প্রথম একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম। এতবড় একটা লম্বা ভ্রমণে কোন খাবার সরবরাহ হলো না। শুধু পানীয় দেয়া হলো বাকি খাবার পয়সার বিনিময়ে পাওয়া গেল। অগত্যা মধুসুদন, সস্তার তিন অবস্থা। তার এক অবস্থা এইটি। এবারের অভিযানের প্রথম দিকের অবস্থাটা মোটেও সুখকর ছিল না। যদিও শেষের দিকটাতে ভালমতো চমক লাগার মতো ঘটনা ঘটে গেল, যেটা কোনক্রমেই তালিকায় ছিল না। আর এটা সম্ভব হয়েছিল বন্ধুবর স্বপনের ছোট ভাই মি. তাপোস চৌধুরীর কল্যাণে। চলবে...
×