ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

হাজার বছরের বাঙালীর স্বাধীনতা রক্ষার কাহিনী গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১১ আগস্ট ২০১৭

হাজার বছরের বাঙালীর স্বাধীনতা রক্ষার কাহিনী গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ

নাট্যভাস্কর ড. মুকিদ চৌধুরীর ‘গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ’ প্রধানত একটি যুদ্ধবিরোধী নাট্যকবিতা। যুদ্ধপরবর্তী সময়ের বিভীষিকার এক নিপুণ চিত্রাঙ্কন যা মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে তোলে এবং যুদ্ধ-পরিহার করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এক তীব্র ভাবনার সৃষ্টি করে। হাজার বছরের বাঙালীর স্বাধীনতা রক্ষার একটি কাহিনীই হচ্ছে ‘গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ’ নাট্যকবিতা গ্রন্থটি। গাঙ্গেনগরির এক যুদ্ধে, বিজয়গর্বী আর্যসেনারা পরাজিত বাঙালী গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দকে বন্দী ক্রীতদাসী করে আর্যাবর্তে নিয়ে যেতে চায়। এই নাট্যকবিতায় হাজার বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও উপলব্ধি করা যায়, বাঙালীর এক অতীত দুর্ভাগ্যের ইতিহাস, যুদ্ধকালের কিছু অভিজ্ঞতা, হানাদার-বাহিনীর অত্যাচার, উৎপীড়ন এবং বঙ্গদেশের নারীবৃন্দের অবর্ণনীয় লাঞ্ছনার ভয়াবহ কাহিনী। তদুপরি, যে কোন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ার ফলে নাগরিক জীবনে যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে, বিশেষ করে নারী-জাতির ওপর, সেই উপলব্ধিতে এই নাট্যকবিতাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। নাট্যভাস্কর ড. মুকিদ চৌধুরীর ‘গঙ্গাঋদ্ধির নারী বৃন্দ’ নাট্যকবিতায় পরাজিত গাঙ্গেনগরির নারীবৃন্দকে যখন শক্তি প্রয়োগে বিজয়ী দেশ আর্যাবর্তে পাঠানো হচ্ছে ক্রীতদাসী হিসেবে, তখন এই নারী দলের মানসিক যন্ত্রণা ও যুদ্ধের ভয়াবহতা পরাজিত অগ্নিদগ্ধ গাঙ্গেনগরির ধূম্রকুণ্ডলির পটভূমিতে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বন্দী গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ-এর দৃষ্টির সম্মুখে আর্যদের লৌহ জলযানগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে, পালতোলা হচ্ছে ইত্যাদি। এই নাট্যকবিতায় গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ যে প্রাণে মারা যাবেন না, জীবিতই থাকবেন, তবে তার আর স্বাধীনতা থাকবে না, হবেন পরাধীন ক্রীতদাসী, এই ব্যক্তি স্বাধীনতার বিলুপ্তি যে মৃত্যুর সমতুল্য-তাই ফুটে উঠেছে। গাঙ্গেনগরির গণহত্যা ও বন্দী গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ-এর দুর্দশার কহিনী যে কোন বিবেকবান মানুষকে যুদ্ধের বিপক্ষে বিক্ষুব্ধ করে তোলার জন্য যথেষ্ট। নিয়াজ চৌধুরী তুলির প্রচ্ছদে সূচীপত্র প্রকাশনার থেকে সাড়ে তিনফর্মার ‘গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ’ গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশকাল এপ্রিল ২০১৭। সামান্য একশো টাকা মূল্যে অসামান্য এই নাট্যকবিতা গ্রন্থ পাঠক পেট পরিপুষ্টের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে এক অধিবিদ্যিক আরাধনাশৈলী হিসেবে সুসঞ্চিত হয়ে থাকবে এই আশা করা যায়। প্রবেশিকায় বারুণের সংলাপ- নাট্যকবিতার এক নতুন সৃজনী বারুণ : বঙ্গোপসাগরের ঊর্মিরাশি থেকে এখানে এসেছি আমি, সমুদ্রের বারুণ সুন্দরবনের লবণাক্ত জলে সুন্দরীরা নৃত্য করে ঘুরে-ফিরে গাঙ্গেনগরিকে আমি খুব ভালোবাসি ভালোবাসি গঙ্গাঋদ্ধির মানুষকেও ........................................ প্রথম সর্গে আর্যাবর্তের রাজকুল দেবরাজ ইন্দ্র এসে উপস্থিত হলেন সমুদ্রদেব বারুণমন্দিরে। বারুণ বসে আছেন তার দেবসিংহাসনে। বিষাদের লহরী বইছে চারদিকে। ইন্দ্র : সম্মানিত বান্ধব আমার, বারুণ অভিন্ন হৃদয়, মন্দিরে আছেন কী এখন মিনতি আমার, অতীতের বিবাদ-বিরোধ হোক অবসান, সবিনয় অনুরোধ জানাই এভাবে বারুণ ও ইন্দ্র চরিত্র কাব্যগাথায় সেতু ধরে এগিয়েছে। দ্বিতীয় সর্গে আর্য সেনা শিবিরে মহারাণী মুরু বন্দি, ক্রীতদাসীরূপে। মুরু : গঙ্গাঋদ্ধির বীর সেনা বিধবা বধূরা এসো এসো শোকাকূল জননীরা, ভয়াতুর দুহিতারা এসো আমাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করো তোমাদের অশ্রুবারি নিবারণ করুক এই জ্বলন্ত নগরিকে একে একে গঙ্গ্ঋাদ্ধির নারীবৃন্দ মুরুর পাশে এসে দাঁড়াল। এভাবে একে এক নারী ১, নারী ২, নারী ৩, নারী ৪, নারী ৫, নারী ৬, নারী ৭ হয়ে উঠেছে নারীবৃন্দ। নারীবৃন্দ : হায়, হায়, এ কেমন পরিণতি স্বদেশে যার ছিল সম্মান প্রতিপত্তি মূল্যহীন ছায়া, লাঞ্ছিত হবেন তিনি এখন পরদেশে পাষণ্ডের দুর্গগৃহে, ক্রীতদাসী রূপে আর্যদূত ভগ্নাচার্য বন্দীদের কাছে এসে উপস্থিত হলো। ভগ্নাচার্য :আর্য-সমরপতি ভূখ-র দূত হয়ে এসেছি এসেছি অনেকবার এই স্বর্ণ গাঙ্গেনগরি আমাকে চিনতে পেরেছেন সম্রাজ্ঞী মুরু দয়া করুন আমার প্রতি, ইম ভগ্নাচার্য তৃতীয় সর্গে ক্রোধভরে রাজমন্দিরে প্রবেশ করল অহল্যা। মহারাণী ও গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ এসে উপস্থিত হলেন সেইখানে। বিষাদের রব জেগে উঠেছে চতুর্দিকে। অহল্যা : মশাল উঁচু করে ধরো, সর্বশক্তিতে দপদপে আলো আর লেলিহান শিখা অন্ধকার আলোকিত হোক সর্বদিক অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ুক আলো গাঙ্গেনগরি পরিণত হোক উৎসবে ....................................... এমন সময় মহারাণী মুরু মহাকোলাহলে কেঁদে উঠলেন, সাগরের ঢেউয়ের গর্জনের মতো। এই সব চরিত্রের মধ্যে কাব্যসংলাপে এগিয়েছে ইতিহাস থেকে নেওয়া গল্পের নাট্যকবিতাখানি। এছাড়াও আরো চরিত্র তপতী, আর্যসেনাবৃন্দ, পুলোমা, ইন্দ্রাণী, মায়াদেবী, ভৃগু, মানুষ, চন্দ্রগুপ্ত এসব চরিত্রেরাও গুরুত্বপূর্ণ সংলাপসরণী বেয়ে গঙ্গাঋদ্ধির নাট্যকবিতা গ্রন্থখনিকে মহামূল্যবান করে তুলেছে। চন্দ্রগুপ্তের সংলাপে আমরা শুনি- চন্দ্রগুপ্ত : বিজয় এসেছে, ফিরে এসেছি আমি গাঙ্গেনগরিতে ফিরে যাও, ফিরে যাও গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ, দেবদুহিতারা আমরা আহত করেছি যত ছিল আর্যসেনা, তাদেরকে আর অহল্যা হত্যা করেছে আর্যসেনাপতি ভৃগুকে এইভাবেই পরিণতি হয় অসত্যের এইভাবেই অভিনীত হয় কলঙ্কের এইভাবেই অবিরাম চলে সময় আর ইতিহাস এইভাবেই অবিরাম চলে ইতিহাস আর সময় তবে নির্ণয় করে নিতে হয় শুভ আর অপশক্তির আমরাই, আমরাই বিজয়ী হলাম শেষপর্যন্ত জয় গঙ্গাঋদ্ধি, জয় গাঙ্গেনগরি জয় গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ পাঁচটি সর্গে গাঙ্গেনগরি নারীগণের প্রতি বিষম ব্যবহার ও আর্যঅত্যাচারের কাহিনী কাব্যময় সংলাপে মায়াঞ্জন হয়ে উঠেছে। চরিত্রেরা ছন্দময় সুরে তাদের শব্দকে সংলাপে পরিণত করে চিরবঞ্চিত শোষিত বাঙালী জাতির মুক্তির ভাষিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। ইতিহাসের এসকল চরিত্রকে কী দারুণ দ্রাক্ষারসে সংলাপ বুনেছেন নাট্যভাস্কর মুকিদ চৌধুরী। তার ঋদ্ধগবেষণার ফল এ ‘গঙ্গাঋদ্ধির নারীবৃন্দ’ গ্রন্থখানি। গ্রন্থটির সাফল্য শতভাগ সাহসিকতার সুরে আমরা তা নির্ণয় করতেই পারি।
×