ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ শোক দিবসের অধ্যাস

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১১ আগস্ট ২০১৭

গল্প ॥ শোক দিবসের অধ্যাস

বউ সাথে করে বাইরে যাবার সময় রায়হান বাবাকে বলল, তুমি বাসাতেই থাকো, আমরা একটু ঘুরে আসছি। রায়হানের বাবা জলিল মাস্টার গ্রাম থেকে এসেছেন দু’দিন হলো। ছেলের বাসায় আগে কখনও আসা হয়নি। কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে অনেক খুঁজে পেয়ে শুক্রাবাদের এই বাসায় উঠেছেন। শুক্রাবাদ হাই স্কুলের পেছনের এই এলাকাকে যে পান্থপথও বলা হয়, এখানে আসার পর সেটা জেনেছেন। আসার পর ছেলে আর বউমার কা-কীর্তি দেখছেন। দু’জনেই চাকরি করে। কী চাকরি সে খবর খুব স্পষ্ট করে জানা নেই জলিল মাস্টারের। সকালবেলা দুজনেই বেরিয়ে যায় বাসা থেকে, ফিরে আসে সন্ধ্যার পর। দু’দিন তো তা-ই দেখছেন জলিল মাস্টার। আজ একটা বাড়তি ছুটির দিন। এ সরকার বিদায় নিলে এ ছুটি আর মিলবে! তো এই ছুটির দিনেও তাদের বাইরে কত কাজ! সারাদিন বুকে কালো ব্যাজ সেঁটে ঘুরে এলো রায়হান, এখন আবার বউ সঙ্গে করে বেরুচ্ছে, কখন যে ফিরবে আল্লা মালুম! বেরুনোর ঠিক পূর্বমুহূর্তে রায়হান বলল, রাতের বেলা তুমি তো আর বাইরে যাচ্ছ না, দরজাটা বাইরে থেকে লক করে যাচ্ছি। ঘরে বসে কাগজ পড়, টিভি দ্যাখ। আমরা আসছি। জলিল মাস্টার একবার চোখ তুলে তাকাতেই রায়হান দরজার মুখ থেকে ব্যাখ্যা দেয়Ñ এটা ঢাকা শহর। দরজা খোলা থাকলেই বিপদ। জলিল মাস্টার কিছুই বলেন না। দরজায় তালা লাগিয়ে ওরা গটগট করে সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে যায়। ওদের পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। তিনি উঠে ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে এসে চেয়ার টেনে বসতেই বন্ধ দরজায় দৃষ্টি আছড়ে পড়ে, নিজেকে ভয়ানক বন্দী মনে হয়। না, ড্রইংরুম গেস্টরুম বেডরুম কোনটাই বন্ধ নয়। ইচ্ছে করলে এ-ঘর থেকে ও-ঘর যেতে কোন বাধা নেই। বাধা কেবল বাইরে বেরোতে। মেইনগেট লক করা। তা এই রাতের বেলা তিনি যাবেনই বা কোথায়! দিনের বেলাতেই পথঘাট ভুলভাল হয়ে যায়। আর রাতের বেলা তো কথাই নেই। কোথায় কোন গলি ঘুপচির মধ্যে পথ হারিয়ে তালকানা হয়ে ঘুরতে হবে তার ঠিক আছে! কিন্তু সন্ধ্যার পর জলিল মাস্টারের এক খিলি পান মুখে দিতে ইচ্ছে করছে যে! পান-তামাকে তিনি যে প্রবল নেশাগ্রস্ত এমন নয়। ধূমপানের তীব্র নেশা চাপা দিতে গিয়ে সারাদিনে দু’চার খিলি পানের অভ্যেস হয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা অন্তত দু’খিলি পান না হলে বেশ অস্বস্তি হয়। সব দিকে কড়া নজর রায়হানের। বাসার নিচে গলির মুখের দোকান থেকে বেশ ক’টা স্পেশাল অর্ডারের পানের খিলি কাগজে মুড়ে নর্মাল ফ্রিজের ডালায় রেখে বউকে বলেছে, চায়ের পরে বাবাকে দিও। ব্যস্ততার মধ্যে বউমা এত্ত কথা মনে রাখে কী করে! এই যে সন্ধ্যার পর বাইরে বেরুনোর তাড়াহুড়োর মধ্যেও শ্বশুরকে নুডুলসের সঙ্গে চা দিয়েছে ঠিকই, পানের কথাটা আর মনে পড়েনি। এমন তো হতেই পারে! চায়ের স্বাদটা এখন তিতকুটে বিস্বাদ হয়ে জিহ্বায় ছড়িয়ে পড়লে জলিল মাস্টার কী করবেন? অগত্যা পায়ে পায়ে চলে আসেন ডাইনিংরুমে। ফ্রিজের ডালা মেলে ধরেনÑ নাহ্, পান কই! ভেজা ন্যাকড়ায় জড়িয়ে পানি ছিটিয়ে রাখা পান আজ সকালেও একটা খেয়েছেন। তবে কি স্টক ফুরিয়ে গেল! মনটা ভারি ব্যাজার হয়ে গেল। মুখভরা তিতকুটে বিস্বাদ নিয়ে ড্রইংরুমে এসে টিভি ছেড়ে দিলেন। কী আশ্চর্য! রিমোটে কাজ করছে না। পাওয়ারই অন হচ্ছে না, তো টিভি চলবে কী! অথচ আজ সকালেও তিনি একা একা টিভি চালিয়ে বিভিন্ন চ্যানেলে শোক দিবসের অনুষ্ঠান দেখেছেন। আবার নিজে হাতে রিমোটের বোতাম টিপে বন্ধও করেছেন টিভি। হঠাৎ সেই রিমোটের হলোটা কী! বাঁ হাতের তালুতে দুবার ধাক্কাধাক্কি করে তিনি রিমোট ছুড়ে দিলেন ডানদিকের সোফার উপরে। পিঠ এলিয়ে দিলেন বিরক্তিতে। তখনই নজরে পড়ে বামদিকের ছোট্ট টি-টেবিলের উপরে সাদা ধবধবে পিরিচে পড়ে আছে একখিলি পান। অবাক কা-, এখানে পান এলো কোত্থেকে! বাব্বা! রাংতা কাগজে মোড়া! দেখে মনে হবে বুঝিবা এক্ষুণি দোকান থেকে সাজিয়ে এনে রাখা হয়েছে। বউমা পারেও বটে। অত্যন্ত হৃষ্টচিত্তে পানের খিলি মুখে পুরতেই চমকে ওঠেন জলিল মাস্টার, হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর মতো করে টেলিভিশন চালু হয়ে গেল, কোন চ্যানেলে যেন বঙ্গবন্ধু তখন আঙ্গুল উঁচিয়ে সেই অমর ঘোষণা দিচ্ছেনÑ এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। সারাদিন ধরে সব চ্যানেলে যেন বা একই অনুষ্ঠান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রচার হচ্ছেÑ বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে যত কথা যত গান যত কবিতা। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিয়ে কত যে পা-িত্যপূর্ণ ক্যাদ্দানি চলছে, ওসব আর শুনতে ইচ্ছে করে না। নতুন কথা কিছু নেই। কী সেই নতুন কথা! বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে আসবেন! সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আবারও গণসংবর্ধনা হবে! তাঁর চতুর্পাশে আবারও ঘিরে থাকবেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর, কামরুজ্জামান! কোথায় নতুন স্বপ্ন! এসব কথা ভাবতেই জলিল মাস্টারের বুকে হিক্কা উঠে পড়ে। কী জানি পানের ভেতরে জর্দার পরিমাণ বেশি ছিল কিনা! হঠাৎ তাঁর মনে হয় টেলিভিশনের চ্যানেলটা বদলে দিতে পারলে হিক্কা থেমে যেত! রিমোট কাজ করছে না, তবে কি সোফা থেকে উঠে গিয়ে ম্যানুয়ালি চেঞ্জ করবেন চ্যানেল! নাহ, তাতেও আলস্য। সকালের বাসি কাগজটা হাতে নিয়ে আনমনে পাতা ওল্টান। ছবি দেখেন। মোটা অক্ষরের শিরোনাম-উপশিরোনাম দেখেন। কোথাও নতুন খবর নেই। কখন, কী কী পদক্ষেপ নিলে ১৫ আগস্টের এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি এড়ানো যেত, সেই বিশ্লেষণও কোথাও নেই। খবরের কাগজ টেবিলে ছুড়ে দিয়ে টিভির সামনে আঙ্গুল উঁচু করতেই সহসা চ্যানেল চেঞ্জ হয়ে গেল। জলিল মাস্টার ভীষণ অবাক! অবিশ্বাসের চোখে তাকান পাশে পড়ে থাকা নির্বোধ রিমোটটির দিকে। তারপর আবার আঙ্গুল উঁচু করেন। আবারও পাল্টে যায় চ্যানেল। না, ভারতীয় চ্যানেলের রংবাহারি ড্যান্স তাঁর ভালো লাগে না। আঙ্গুল তুলে আবার চ্যানেল চেঞ্জ করেন। ফিরে আসেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের এটা কোন চ্যানেল কী অনুষ্ঠান হচ্ছে সেদিকে মনোযোগ দেবেন কিনা, জলিল মাস্টারের বিস্ময়-বিস্ফোরিত দৃষ্টি পড়ে থাকে নিজেরই ডানহাতের শাহাদৎ আঙ্গুলের প্রতি। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন নাÑ তাঁর সামান্য এই আঙ্গুল এমন অসামান্য ক্ষমতা কী করে পেল! আবার আঙ্গুল তুলে চ্যানেল বদলাতেই দৃষ্টি চলে যায় বঙ্গবন্ধুর সেই আকাশছোঁয়া আঙ্গুলের দিকে। ভাল করে তাকিয়ে দেখেন তিনিÑ বঙ্গবন্ধুর কোন হাত ওটা, কোন হাতের কোন আঙ্গুল? জলিল মাস্টারের সারা গায়ে কাঁটা দেয়, লোম শিউরে ওঠে এবং অবশেষে টের পানÑ নিজের ওই বিশেষ আঙ্গুলটি শিরশির করে কেঁপে উঠছে, আঙ্গুলের ভেতরে কী এক অনন্য সাধারণ বোধ সঞ্চারিত হচ্ছে। একবার নিজের উপরেই অবিশ্বাস হয়, এ আ আঙ্গুল কি তবে তার নয়, বঙ্গবন্ধুর সেই সাতই মার্চের জদুকরী আঙ্গুল, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পথনির্দেশ দিয়েছে যে আঙ্গুল! এতক্ষণ আঙ্গুলের আস্ফালন দেখতে গিয়ে জলিল মাস্টার ভুলেই গিয়েছিলেন তার গালের মধ্যে জর্দামাখা পান ঠাসা আছে দাঁতের হামানদিস্তায় সেটা পিষতে হবে, রস নিংড়ে নিতে হবে। দু’চারবার চিবোতেই সারা মুখ তিতকুটে বিস্বাদে ভরে যায়, গলার কাছে বুনো কচুর তরকারির মতো কিটকিট করে এবং আবারও হিক্কা উঠতে চায়। জলিল মাস্টার এদিক ওদিক তাকিয়ে পিকদানিটা খোঁজে, বাবার অসুবিধার কথা ভেবে রায়হান প্রথম দিনেই পিকদানি এনে দিয়েছিল; কিন্তু সেটা গেল কোথায় গালের ভেতরে জমা পিক সামলাতে না পেরে তিনি দ্রুত উঠে যান বেসিনের কাছে। ওয়াক করে পিক ঢেলে দেন বেসিনে। পানের পিক নয় যেনবা লাল টকটকে রক্তে ভরে যায় সাদা বেসিন। ট্যাপ ঘুরিয়ে সর্বোচ্চ বেগে পানি ছেড়ে দেন। পানিতে ভরে ওঠে বেসিন। কিন্তু পানি কই, বেসিনভরা রক্ত যে! জলিল মাস্টারের চোখের মনি ফেটে বেরোয়Ñ রক্ত এত লাল! কার রক্ত! ড্রইংরুমে ফিরে আসতেই নজরে পড়ে সোফার পাশে ছোট্ট সাইড টেবিলের নিচে রুপালি পিকদানি তাঁকে দেখে হাসছে। আবার বিভ্রম হয়, পিকদানিটি কি কিছুক্ষণ আগেও ওইখানে ছিল! নাহ, মনে পড়ে না সে কথা। ওটা কি গত দুদিনের ব্যবহৃত পিকদানি, নাকি রক্ত গোলাপে ঠাসা ফুলদানি! মনের ভেতরের ঘোর কাটে না নিঃসংশয়ে, ভয়ানক ক্লান্তিতে তিনি শরীর এলিয়ে দেন সোফাতে। এদিকে টেলিভিশন চলছে। মানুষ ইচ্ছে করলেই চোখ বুজতে পারে, কান বন্ধ করবে কী করে! জলিল মাস্টার সোফাতে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করেছেন, তবু চোখের ক্যানভাস থেকে রক্তভরা বেসিন এবং রক্তাক্ত পিকদানির ছবি কিছুতেই সরাতে পারছেন না; এরই মাঝে টিভি চ্যানেলে কে যেন প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে গেয়ে ওঠেÑ যদি রাত পোহালেই শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই। গানটির অবশিষ্ট কথা শ্রবণেন্দ্রিয় গ্রহণ করে কিনা বোঝা যায় না, কানের দরজায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েÑ ‘বঙ্গবন্ধু মরে নাই’ এই বাক্যবন্ধটুকু। জলিল মাস্টার হঠাৎ খাড়া হয়ে উঠে বসেন, নিজেকেই প্রশ্ন করেন, বঙ্গবন্ধু মরে নাই? টিভির পর্দায় চোখ পড়তেই দেখতে পানÑ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের প্রতিটি কক্ষের দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র, জামাকাপড়, পাইপ, চশমা, কলম, বইপত্র, উপহার সামগ্রী, বুলেটবিদ্ধ ঘরের দেয়াল, রক্তাক্ত সিঁড়িÑ খুঁটিনাটি সব কিছু। গতকাল একা একাই জাদুঘরে গিয়ে এসব দেখে এসেছেন জলিল মাস্টার। এখান থেকে কতই বা দূর। বড় রাস্তাটা পেরোলেই হলো, তারপর জনতার স্রোত ঠিকই নিয়ে যাবে বত্রিশ নম্বর। সেই স্রোতে মিশেই তিনি গিয়েছিলেন। সারাদিন ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখেছেন। আজ দেখছেন টেলিভিশনের পর্দায়। বঙ্গবন্ধুর বুলেটবিদ্ধ ছবিটি দেখে তিনি সহসা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, মুখে বিড়বিড় করেনÑ বঙ্গবন্ধু মরে নাই। সোফার হাতলে দু’হাতের ভর রেখে সটান উঠে দাঁড়ালেন জলিল মাস্টার। এই বন্দিত্ব থেকে বেরিয়ে তিনি নিচে যাবেন। রাজপথের মিছিল দেখবেন। সেøাগান শুনবেন। তারপর ফেরার পথে গলির মাথার দোকান থেকে চমনবাহার দিয়ে এক খিলি পান খাবেন। মেইনগেটে পৌঁছানোর পর তাঁর মনে পড়ে যায়, রায়হান বাইরে থেকে লক এঁটে রেখে গেছে। এখন উপায়! অসহায় ভঙ্গিতে দরজার হাতলে হাত রাখতেই অবাকÑ দরজার দুই পাল্লা হা হয়ে খুলে গেল। তবে কি ওরা যাবার আগে তালা না লাগিয়ে বাবাকে মিছেমিছি ভয় দেখিয়েছে! নাকি সত্যি সত্যি আজ তার ডানহাতের তর্জনিতে সাতই মার্চের অলৌকিক আঙ্গুলের সম্মোহনি শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে! কিন্তু এ কী! মেইনগেট পেরিয়ে সিঁড়ির মুখে আসতেই বিদ্যুত চলে গেল যে! সঙ্গে সঙ্গে নিকষ কালো অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বত্র। তখন কী করবেন জলিল মাস্টার? সামনে নাকি পেছনে যাবেন! সিঁড়ির দিকেই তাকিয়ে থাকেন আকুল হয়ে। প্রগাঢ় অন্ধকার সামান্য একটু চোখ সওয়া হয়ে আসতেই তিনি অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেনÑ অন্ধকার ফুঁড়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে উপরে উঠছেন বঙ্গবন্ধু। চোখে সেই চশমা, চুলে সেই ব্যাক ব্রাশ, সাদা ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবির উপরে কালো মুজবিকোট; ঠোঁটে ঝুলছে টোবাকো পাইপ। তিনি উঠছেন, অন্ধকার পথ কেটে দিচ্ছে। আলোর দেবতা আলো ছড়াতে ছড়াতে উপরে উঠছেন। উপরে মানে যে কোথায়, কত উপরে সে সবের কোন ধারণাই নেই তাঁর। যতদূর দৃষ্টি যায় জলিল মাস্টার উপরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সিঁড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আলোর দূত উপরে উঠে যান। এই বিল্ডিং তো সাততলা, এরপর তিনি আর কত উপরে যাবেন। ভেবে পান নাÑ এখানে কেন এসেছেন তিনি, এখানে কী কাজ! জলিল মাস্টার সিঁড়ি ভঙ্গে উপরে যেতে সাহস পান না, পা ওঠে না; তিনি নিচেই নামবেন। কিন্তু এদিকে যে নিরেট অন্ধকার! অগত্যা ডান দিকের দেয়ালে হাত রাখেন, দেয়ালঘেঁষে অনুমাননির্ভর পা ফেলে ধীরে ধীরে ঠিক নেমে যাবেন, এমনই ভাবছেন। হঠাৎ ডানহাতের তর্জনিতে ছোট্ট একটা সুইচ বোর্ডের নাগাল পান। আর তক্ষুণি সিঁড়িজুড়ে আলো জ্বলে ওঠে ফকফকা। তিনি কি সুইচ টিপেছিলেন! নাকি ওই শাহাদৎ আঙ্গুলের ছোঁয়া লেগে এ রক আলাউদ্দীনের চেরাগ জ্বলে উঠল এবং তিনি চমকে উঠলেন! জলিল মাস্টার গলির মুখে এসে দেখেন পানের দোকান খোলা আছে ঠিকই, অন্ধকারে ঢেকে আছে সারা এলাকা। অধিকাংশ দোকানে জ্বলছে টিমটিমে কুপির আলো। দু’-একটা দোকানে চার্জার লাইট জ্বলছে। তবু গা-ছমছমে ভৌতিক পরিবেশ যেন চেপে বসে আছে। এর মধ্যেই পানের অর্ডার দেবেন? নাহ্ মন সরে না। ভুতুড়ে অন্ধকারে কি ঠিকমতো পান বানাতে পারবে! চুনের অনুপাতে একটুখানি তারতম্য হলেই তো গালমুখ জ্বলেপুড়ে ঝালাপালা। থাক, সামনের রাস্তা পর্যন্ত একটু হাঁটাহাঁটি করে ফেরার পথে পান মুখে দেবেন। ততক্ষণে বিদ্যুত চলে এলে তো কথাই নেই। দেখেশুনে চমনবাহার দিয়ে পান সাজিয়ে নেয়া যাবে। ঢাকা শহরে গাড়ি ঘোড়ার যে উৎপাত, ফুটপাথেও কি নিরাপদে পা ফেলার উপায় আছে! হরেক রকম যানবাহন আর মানুষে গিজগিজ করছে দিনরাত। কে যে কখন কার গায়ের উপরে হুমড়ি কেয়ে পড়বে বলা মুশকিল। অতি সাবধানে গা বাঁচিয়ে চলার পরও জলিল মাস্টার নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না। চট্টগ্রাম অভিমুখী গ্রিনলাইনের কাউন্টারের সামনে থেকে বদরাগী এক মোটরসাইকেল তেড়ে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল রাস্তয়। মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবক আর পেছনে তাকায়নি, সঙ্গে সঙ্গে ফুলস্পিডে কেটে পড়ে নিরুদ্দেশে। স্থানীয় কেউ একজন জলিল মাস্টারকে পাঁজাকোলে তুলে নিরাপদে নিয়ে আসে এক ওষুধের দোকানের সামনে। বড় কোন অঘটন ঘটেনি বটে, তবে হাঁটু এবং কনুইয়ের কাছে থেঁতলে রক্তাক্ত হয়েছে জামা-পাজামা। খানিকটা স্বাভাবিক হবার পর জলিল মাস্টার জানান, তিনি নিজেই বাসায় যেতে পারবেন, এই তো শুক্রাবাদে ছেলের বাসা। জামার পকেট হাতড়ে রায়হানের বাসার ঠিকানা বের করে দেখান। পরোপকারী লোকটি তবু বগলের তলে হাত লাগিয়ে টেনেটুনে বাসার কাছে পৌঁছে দিয়ে গেলে কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে আসে তাঁর। সারা দেহের সমস্ত শক্তি পায়ের পাতায় এনে জড়ো করে জলিল মাস্টার সিঁড়িতে পা রাখেন। ভাগ্যিস রায়হানের বাসা দোতলায়, আরও উপরে হলে কী যে হতো! দোতলা পর্যন্ত উঠতে সিঁড়ির প্রথম প্যাঁচ ঘুরতেই তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন, এখানে রক্তের ধারা এলো কোত্থেকে! আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় গলা শুকিয়ে কাঠ। উদ্বিগ্ন চোখে উপরের দিকে তাকাতেই আর্তনাদ করে ওঠেন। সিঁড়িতে পড়ে আছে বঙ্গবন্ধুর বুলেট ঝাঁজরা নিথর দেহ। রক্তের আল্পনা এঁকেবেঁকে নেমে গেছে নিচে, দক্ষিণে একেবারে বঙ্গোপসাগরে। জলিল মাস্টার এখন এই রক্তপ্রবাহ এই প্রাণহীন দেহ অতিক্রম করে কীভাবে উপরে উঠবেন! বউমাকে সঙ্গে নিয়ে রায়হান কি এতক্ষণে ফিরে এসেছে! এই রক্তাপ্লুত সিঁড়ি মাড়িয়ে ওরা বাসায় ঢুকল কী করে! ভেবে পান নাÑ এ কী করে সম্ভব? বঙ্গবন্ধুর মরদেহ এখানে এলো কেমন করে? হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন জলিল মাস্টার। রক্তাক্ত সিঁড়ির উপরে পাছা লেপ্টে বসে বঙ্গবন্ধুর ঝুলে পড়া মাথাটা দু’হাতে কোলের উপরে তুলে নেন। নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন অপলক। হঠাৎ চমকে ওঠেন, বঙ্গবন্ধুর ঠোঁটজোড়া কি একটু নড়ে উঠল? কী যেন বলতে চান মনে হয়। কী বলবেন নেতা? আবার কি বলবেনÑ আর যদি একটা গুলি চলে...। যদি চলেই গুলি তাহলে কী করতে হবে সে নির্দেশ আর শোনা হয়। পিতৃহারা পুত্রের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন জলিল মাস্টার। বঙ্গবন্ধুর স্পন্দনহীন বুকের উপরে আকুল হয়ে লুটিয়ে পড়েন এবং বিরামহীন কাঁপতেই থাকেন। কখন যেন রায়হান এসে বাবার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, তার কণ্ঠে মৃদু ভর্ৎসনা ফুটে বেরোয়Ñ বিছানায় গিয়ে ঘুমুলেই তো পারতে বাবা। সোফাতে বসে ঘুম হয়! আমি ঘুমুচ্ছিলাম! জলিল মাস্টারের চোখে বিস্ময় উদ্বেগ আর আতঙ্কের মাখামাখি। ঘুমের মধ্যে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন বাবা। তুমি কি কাঁদছিলে? ধসমস করে উঠে বসেন জলিল মাস্টার। হাতের তেলোয় চোখ রগড়ে বলেন, কই নাতো! মুখে অস্বীকার করলেও তিনি সোফা ছেড়ে উঠে পড়েন। চোখ মুখ থেকে দুঃস্বপ্নের ছায়া মুছে ফেলতে দ্রুত পায়ে চলে যান বেসিনের কাছে। ট্যাপ ছেড়ে পানির ছিঁটা দেন মুখম-লে। আর ঠিক তখনই বেসিনের উপরে দেয়ালে সাঁটা আয়নায় বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে আর্তনাদ করে ওঠেনÑ ক্ষমা কর পিতা, আমরা প্রতিবাদ করতে পারিনি। রায়হান ছুটে আসে এঘরে। বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে জানতে চায়, কী বলছ বাবা! তোমার কি শরীর খারাপ করছে? আতঙ্কে বিস্ফারিত চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকান জলিল মাস্টার। ছেলের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, ওই যে আয়নার ভেতর থেকে বঙ্গবন্ধু কী যেন বলছেন। সঙ্কটটা ধরতে পারে রায়হান। বাবার হাত ধরে সে বোঝাতে চেষ্টা করে, আয়নার ভেতরে বঙ্গবন্ধু কোথায়! বঙ্গবন্ধু আছেন তোমার পেছনে। এই যে বাবা, তুমি তাকাও পেছনে। পেছনের দেয়ালে সত্যি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙানো আছে। জলিল মাস্টার পেছনে ঘুরে অবিশ্বাসের চোখে তাকান সেই ছবির দিকে। রায়হান বুঝিয়ে বলে- দেয়ালের এই ছবিটার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে আয়নায়। জলিল মাস্টার অবাক হন, আজ দু’দিনে কই নজরে পড়েনি তো এই অবিস্মরণীয় ছবিটি। এ ছবি কি এখানেই ছিল! না বাবা, আজই এটা টানিয়েছি এখানে। ছবির দিক থেকে চোখ নামিয়ে রায়হান বাবাকে আশ্বস্ত করে ঘরে বঙ্গবন্ধুর ছবি থাকলে সাহস বাড়ে বুকে।
×