ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

রবীন্দ্রনাথ ॥ ধর্ম সাধনা

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ১১ আগস্ট ২০১৭

রবীন্দ্রনাথ ॥ ধর্ম সাধনা

রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্র স্মারক গ্রন্থমালার একটি বিশিষ্ট আয়োজন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা রবীন্দ্রনাথ : ধর্ম সাধনা বের হয় ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে। প্রকাশ করেছে মর্ধূন্য। ১১ বছরের সিনথিয়া ইমাম গ্রন্থটির প্রচ্ছদশিল্পী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত: একজন কবি হলেও গদ্য সাহিত্যে তাঁর বিচরণ মননশীল চৈতন্যের এক সুসংবদ্ধ প্রয়াস। আলোচিত গ্রন্থটি সেই সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দেয়। একজন বিশিষ্ট প্রাজ্ঞজনের লেখায় রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনা যেভাবে বিধৃত হয়েছে সঙ্গত কারণেই তা আলোচনার দাবি রাখে। একদা আধ্যাত্মবাদের দেশ বলে খ্যাত ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ধর্মীয় অনুভূতির প্রভাব রবীন্দ্রনাথের উপর ছিল তা কম বেশি আলোচক, গবেষকের লেখায় স্পষ্টতই স্থান পায়। এমনও বলা হয় নোবেল বিজয়ও হয় সেই ধারাকে অনুসরণ করে। অর্থাৎ ঋষি রবীন্দ্রনাথ হিসেবেই কবির বিশ্বজয়। এসব স্পর্শকাতর অনুভবকে সরাসরি খ-ন না করে লেখক বিশেষ ব্যতিক্রমী মাত্রায় রবীন্দ্রনাথের শুদ্ধ চেতনায় আলোকপাতে সচেষ্ট হন। অনিবার্যভাবে এসে যায় উনিশ শতকীয় নবজাগরণের নতুন পর্যায়গুলো। সনাতন ধর্মকে অন্যমাত্রায় নিয়ে আসার প্রথম কৃতিত্ব রাজা রামমোহন রায়ের। যার অনুসারী ছিল পুরো ঠাকুর পরিবার। যা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের হাত দিয়ে শুরু হয়। ব্রাহ্ম ধর্মকে ধারণ করতে গিয়ে সনাতন ধর্মের সমস্ত আচার অনুষ্ঠানকে বর্জন করতে হয়েছিল। এমনকি পিতা প্রিন্স দ্বারকানাথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও সম্পাদন করেন প্রচলিত আচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচারণ করে। ফলে কলকাতার একটি বিশেষ সমাজ কর্তৃক ঠাকুর পরিবারকে বিচ্ছিন্ন ভাবা হতো। আর এ ধারার শুরু তো সেই পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন পীরালী ব্রাহ্মণ বলে স্বীকৃত ঠাকুর পরিবারের পূর্ববর্তী বংশধরদের একঘরে করা হয়েছিল। এসব বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। ফলে লেখক প্রথমেই এসবের একটি প্রাণালীবদ্ধ সারসংক্ষেপ পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। শুধু ধর্মীয় নবজাগরণই নয় সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আগে এক যুগান্তকারী রদবদল। যার মহানায়ক কথাশিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের উপর রামমোহন আর বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব লক্ষণীয় হলেও রবীন্দ্রনাথ বরাবরই স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে উজ্জীবিত। আর তাই তিনি সরাসরি ব্রাহ্ম ধর্মের কিনা কিংবা নিজের মতো করে বিশ্ব নিয়ন্তার এক পরাক্রম অস্তিত্বে সমর্পিত কিনা তা অবশ্যই বিশ্লেষণের দাবি রাখে। লেখকও সেই আলোচনার অবতারণ করে সরাসরি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বক্তব্য তুলে এনে বলতে চান আসলে কোন নির্দিষ্ট ধর্ম বলয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিমগ্ন না করলেও হিন্দু-মুসলমান এই দুই বিভাজিত ধর্ম সম্প্রদায়ের অনৈক্য, বিবাদ, বিভেদ তাঁকে মর্মাহত করে, ক্ষুব্ধ করে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ মিলনের পথে ধর্ম নামক এক পর্বতপ্রমাণ পাহাড় বিঘœ তৈরি করে, অন্তরায় হয় সেটা কখনও রবীন্দ্রনাথ মানতে পারেননি। উনবিংশ শতাব্দীর আশি আর নব্বই-এর দশকে কবি নিজেই আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ধর্মীয় সংস্কৃতির নানা আবর্তে নিজেকে জড়িয়ে নিতে বাধ্য হলেও চেতনাগত উৎকর্ষের কারণে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেও তাঁর সময় লাগেনি। কবির ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস সমাজ সংস্কার আর ধর্মীয় প্রথাসিদ্ধ বলয়ের এক বিমূর্ত প্রতিবাদ। ফলে প্রসঙ্গক্রমে জগমোহন আর শচীশের নতুন জীবন আর ধর্ম দর্শনও লেখকের সুচিন্তিত অভিব্যক্তিতে বলিষ্ঠ প্রত্যয় ব্যক্ত হয় সেখানে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ধর্ম দর্শন ও স্পষ্টতই উঠে আসে। রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় বোধ আর মানবিক চৈতন্য এক অবিচ্ছিন্ন সুতায় গাঁথা যা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের কাঠামো পর্যন্ত এগোয় না। মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদা, সম্মান আর অধিকারের বিবেচনায় এক অনন্ত, অসীম সৃষ্টিকর্তার সুবিশাল সৃষ্টি বলয়ে সমর্পিত হয়। প্রকৃতি, ঈশ্বর আর মানবপ্রেমের মধ্যে কবির সর্বস্ব নিবেদনের যে আকুতি সেখানেই তাঁর প্রকৃত ধর্মসাধনার সম্ভাবনাময় দিকনির্দেশনা। লেখক অত্যন্ত যুক্তিসম্মত উপায়ে যা যা বলেছেন সবটাতেই আছে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব বোধ, আদর্শ আর চিরন্তন ভাবনা। যেখানে কবিকেই সরাসরি হাজির করা হয়েছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্যের দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ এখানে নেই বললেই চলে। গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথের যথার্থ ধর্মীয় বোধ পাঠককে অত্যন্ত সহজভাবে চেনাতে সাহায্য করবে। তাঁর চেতনা অনুভূতি আর অভিব্যক্তির উপর সুস্পষ্ট ধারণাও দেবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার এবং সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করছি।
×