ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

‘ঋণ খেলাপীর ৯ একরের ওপর বাগানবাড়ি’

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১১ আগস্ট ২০১৭

‘ঋণ খেলাপীর ৯ একরের ওপর বাগানবাড়ি’

তর তর করে বড় ব্যবসায়ী হয়েছেন এমন একজন ব্যক্তিকে আমি চিনি। তখন ইলেকট্রনিক ব্যবসা জমজমাট। সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ থেকে মাল এনে ভারতে চালান দেয়াই ছিল একটা বড় ব্যবসা। এরশাদের আমল থেকে ওই ভদ্রলোকও তাই করতেন। প্রায়ই একটা ব্যাংকে দেখা হতো। তখন ব্রিফকেসের বড় চল। সকল বড় কর্তার হাতেই থাকত ব্রিফকেস (এখন তা দেখি না)। মাঝে মাঝে এতে দেখতাম ‘ক্যাশ’ টাকা। বড় মজাদার লোক। কিছুদিন পর পরই শুনি ওই ভদ্রলোক এখানে দোকান নিয়েছেন, ওখানে দোকান নিয়েছেন। ব্যবসা বড় হচ্ছে। অকেদিন দেখা নেই। শোনা গেল তিনি ‘শিল্প’ করেছেন, গার্মেন্টস করেছেন, আরও কত কী! মাঝখানে একবার এক হোটেলে দেখা। আমাকে একটা ‘কার্ড’ দিলেন। বিশাল ব্যাপার। ছবিসহ ‘ভিজিটিং কার্ড’! তার পরিচয় তিনি ডজনখানেক কোম্পানির চেয়ারম্যান ও এমডি। এসব কোম্পানি আবার ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’- এর অন্তর্গত। ব্যাংক তাকে সমীহ করে চলে। দুই-তিনটি ব্যাংক তার ‘পকেটে’। মালিকদের সঙ্গে দহরম। এত প্রভাবশালী যে, তিনি অনেক অফিসারের পদোন্নতি এবং পদায়নও করাতে পারেন। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে বহুদিন দেখা নেই। গেল রোজার ঈদে একটি ক্লাবের ইফতার পার্টিতে দেখা। এগিয়ে গেলাম। হাত মেলালাম। ভদ্রলোকের সঙ্গে একসঙ্গে বসলাম। (জিজ্ঞেস করলাম ব্যবসার অবস্থা কী? হতাশা প্রকাশ করলেন। বললেন, খুব অসুবিধায় আছি। খেলাপী হয়ে গেছি। আমি বললাম, বলেন কী? এটা কী করে হলো? কথা বলে বুঝলাম তিনি ‘ওভার ট্রেডিং’ করে ফেলেছেন। যতটুকু সামলাতে পারবেন তার চেয়ে বেশি করে ফেলেছেন। আর করেছেন কী, করেছেন ‘ফান্ড’ ডাইভার্ট। খুবই সহজে প্রাপ্ত ঋণের টাকা যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছেন। কমপক্ষে তিনটি ব্যাংক তার আদরের ব্যাংক। বস্তুত বিনা হিসাবে তাকে দেদার ‘লোন’ দিয়েছে। সেই টাকায় ব্যবসায় কোন কিছু করেননি। আর অনেকের মতোই কিনেছেন জমি। যেখানে পেরেছেন সেখানেই। ঢাকা এবং গ্রামের বাড়িতে সুন্দর বাড়ি করেছেন। ঢাকার চারপাশে একরের পর একর জমি কিনেছেন। সস্তা ঋণের টাকা শেয়ার বাজারে ঢুকিয়ে বেশ মুনাফা করেছিলেন। সেই টাকাও বিনিয়োগ করেছেন জমিতে। এখন সর্বনাশ। জমির ক্রেতা নেই। থাকলেও দাম নেই। বেশি বেশি জমির ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। তার কথায় মনে হয় তিনি ব্যাংকের কিছু টাকা দিয়ে ঋণ খেলাপীর খাতা থেকে নাম কাটাতে চান। কিন্তু ব্যবসা যেমন ভাল না, তেমনি জমিও বিক্রি হচ্ছে না। ফলে বিশাল অঙ্কের দেনা নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবে দাপট কমেনি। ভাব খানা হচ্ছে- কী হবে? কথায় কথায় মন্ত্রী-মিনিস্টারের নাম। বড় বড় অফিসারের নাম। মনে হলো সবাই তার ‘ভাই’। এই সম্বোধনেই কথা বলেন। এই যে একটা উদাহরণ দিলাম তা কী কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মোটেই নয়। প্রায় বছরখানেক আগে একজন খুবই বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার জমি বাংলাদেশের সর্বত্র। কিছু জমির দলিল ঠিক আছে। কিছুর ঠিক নেই। জমির মধ্যে ‘শত্রু সম্পত্তি’ আছে, ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি’ আছে, সরকারের জমি আছে, খাল-বিল-নদী আছে। আর কিছু জমি কেনা। সব সম্পত্তির মূল্য তার হিসাবে ১০-১২ হাজার কোটি টাকা। এই সম্পত্তির দলিল ও মালিকানা ঠিক করার জন্য তার আলাদা একটা অফিস আছে। কিন্তু তার আফসোস, জমির ক্রেতা নেই। প্লট করে বিক্রির ব্যবস্থাও করা যাচ্ছে না। এই ভদ্রলোকও প্রকৃত পক্ষে ঋণখেলাপী। ‘কায়দা’ করে খেলাপীর তালিকা থেকে মুক্ত আছেন। এই যেমন আরেক কোম্পানি এবং তার মালিক। দুই দিন আগেও কত সুনাম শুনেছি লোকমুখে। শিক্ষিত ভদ্রলোক। উচ্চতম ডিগ্রীর মালিক। বিদেশে থাকতেন। ‘দেশমাতৃকার’ ডাকে দেশে এসেছেন মাতৃভূমির ‘সেবা’ করতে। ঢুকেছেন এমন ব্যবসায় যার ‘পাবলিসিটি’ মিডিয়াতে প্রচ- রকমের। এক সময় ‘মিডিয়া’ বলল, গার্মেন্টসের পর কোন খাতের ব্যবসার যদি আকাশচুম্বী সম্ভাবনা থাকে তা হলে তা হচ্ছে ‘শিপবিল্ডিং’। ‘শিপব্রেকিং’ নয়, কিন্তু ‘শিপব্রেকিং’-এর নামে একশ্রেণীর ব্যবসায়ীÑ যেমন উঠেছেন, তেমনি বিরাট অঙ্কের ব্যবসায়ী ব্যাংকগুলোকে ফতুর করেছেন। এই অভিজ্ঞতার পর সামনে আসে ‘শিপবিল্ডিং’। আমার একসময় মনে প্রশ্ন জাগে। আমরা ‘শিপবিল্ডিং’-এর দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছি তা হলো খোঁজ নিয়ে জানলাম এটা বিল্ডিং নয়। প্রকৃত পক্ষে আর একটা ‘গার্মেন্টস’ কারখানা। গার্মেন্টস কারখানা যেমন আমরা ‘শিল্প’ বলি, তেমনি শিপবিল্ডিংও তাই। সব মাল বিদেশের, টেকনিক্যাল ‘নো হাউ’ বিদেশের। আমাদের শুধু মিস্ত্রি। স্বচক্ষে একবার পদ্মার পাড়ে ‘শিপবিল্ডিং’ (!) দেখেছি। সে যাই হোক, এই শিল্পের’ এমন প্রচার দেখলাম যে, দেখতে দেখতে সকল ব্যাংক কামড়া কামড়ি করে এর ওপর পড়ল। ফল কী? সবার কথা কাগজে পেলাম না। তবে শিপবিল্ডিংয়ে নিয়োজিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে বড় একটা কোম্পানির ওপর দুই-তিন দিন আগে একটা স্টোরি ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি পাঁচটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫৭৭ কোটি, জনতা ব্যাংক থেকে ২৩৮ কোটি, ওয়ান ব্যাংক থেকে ২২৭ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে ২২৩ কোটি এবং এবি ব্যাংক থেকে ওই কোম্পানিটি নিয়েছে ১৮৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ১৪৫১ কোটি টাকা। ভদ্রলোক এখন ঋণখেলাপী। তিনি টাকা কি করেছেন? এই ভদ্রলোকও ও টাকা অপব্যবহার করেছেন। ঋণের টাকা ‘ডাইভার্ট’ করেছেন। একটি দৈনিকে এর বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয়েছে। ভদ্রলোক গাজীপুরের টঙ্গীতে যে প্রাসাদোপম ইমারত করেছেন তার ছবি ওই দৈনিকটিতে দেয়া হয়েছে। নয় একর জমির ওপর অট্টালিকাটি। নয় একর মানে ২৩ বিঘা জমি। ভাবা যায় একজন ব্যবসায়ী যিনি কীনা ঋণখেলাপী তিনি ৯ একর জমির ওপর বাড়ি করেছেন। ওই বাড়িতে হ্যালিপ্যাড আছে, সুইমিংপুল আছে, স্টিমবাথ আছে। আসবাবপত্র সব বিদেশী। রিপোর্ট অনুযায়ী এসব আসবাবপত্রের ওপর ধার্যকৃত কর এখনও পরিশোধ করা হয়নি। মজার ঘটনাÑ এই বাড়িতে তিনি থাকেন না। পরিবারের কেউ থাকেন না। চাকর বাকররা দেখাশোনা করে। নদীবেষ্টিত বাড়ি। বিদেশ থেকে কেউ এলে তাকে ওই বাড়িতে আপ্যায়ন করা হয়! শুধু তাই নয়, জামালপুরে তিনি ৮তলা বিশিষ্ট দুটি দালান করেছেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও বামনডাঙ্গায় প্রচুর জমি কিনেছেন। জমি কিনেছেন ভালুকায়। কী বোঝা গেল। আমি নিবন্ধের শুরুতে দুটো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছি যাতে বলেছি ঋণের টাকা অপব্যবহারের কথা। এবার উল্লেখ করলাম পত্রিকার একটি রিপোর্টের কথা যেখানে ‘শিপবিল্ডিং’-এর নামে টাকা নিয়ে তা ডাইভার্ট করে প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছে, জমি ক্রয় করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের বিরাট একটা অংশও একই কারবার করছেন। কিছু দিন আগে একই কাগজে চট্টগ্রামের একজন ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীর কথা ছাপা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক তার কাছে হাজার কোটি টাকা পাবে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ছিদ্দিক ট্রেডার্স’ নামীয় একটি ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ভোগ্যপণ্যের ব্যবসার নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা শেয়ার বাজারে খাটাচ্ছেন, জমি কিনেছেন এবং বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন ব্যক্তিগত ভোগবিলাসে। উদাহরণ আর বাড়াব না। সারাদেশে শত শত ব্যবসায়ী, শত শত বলি কেন, হাজার হাজার ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণের টাকা ‘ডাইভার্ট’ করে জমি কিনেছেন, ভোগবিলাসে মত্ত হয়েছেন, দেশের বাইরে টাকা পাঠিয়েছেন, শেয়ার ব্যবসা করছেন। এখানে প্রশ্ন, এসব ঘটনা কী ব্যাংকাররা জানে না? ব্যাংকারদের অজ্ঞাতে, অজান্তে কী এসব ঘটনা ঘটছে? আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারিÑ এসব ঘটনা ব্যাংকারদের অজান্তে হতে পারে না। হয় না। ‘ট্রাস্ট রিসিট’ বলে একটা ঋণ সুবিধা আছে। এর অধীনস্থ মাল বিক্রি করে ব্যাংকে সঙ্গে সঙ্গে জমা দিতে হয়। অথচ অনেক ক্ষেত্রে, প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে? মালের টাকা জমা না দিয়ে তাকে দীর্ঘমেয়াদী লোন করা হচ্ছে। এ সবই ব্যাংকারদের যোগসাজশে। বস্তুত ব্যাংকে এমন কিছু ঘটতে পারে না যা ব্যাংকারদের ‘নলেজের’ বাইরে। এই যে হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপীদের জমিতে আটকা পড়েছে তা উদ্ধারের ব্যবস্থা কী? যে টাকা তারা দেশের বাইরে নিয়ে গেছে তা উদ্ধারের ব্যবস্থা কী? ঢাকার আশপাশে, বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই যে শত শত, হাজার হাজার একর জমি ব্যবসায়ীরা ‘শিল্পের’ নামে বেড়া দিয়ে রেখেছে। তার ভবিষ্যত কী। ‘বাগান বাড়ি, নেই কার’Ñ এই প্রশ্নই এখন প্রবল। এক সময় বাঙালী বাগানবাড়িকে ঘৃণা করত। জমিদারদের কাজ এটা। এসব ভেঙ্গে চুরমার কর। এখন জমিদাররা নেই। সেই জায়গায় এখন কে? তাহলে কি বাগান বাড়িকে ঘৃণা করেছিলাম আমাদের বাগানবাড়ি নেই বলে? আসলে কথা হচ্ছে বাগানবাড়ি থাকবে, এতে থাকব আমরা, জমিদাররা থাকবে কেন? কিন্তু বড় প্রশ্ন, এসব বাগানবাড়ির বিরাট অংশ যে ব্যাংকের টাকা মেরে। এর কী হবে? ব্যাংকাররা কি সজাগ হবেন? কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি ‘শিপবিল্ডিংয়ের’ বাড়িটি একটু দেখতে আসবে? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×