ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী ॥ আইনগত মোকাবেলা

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১১ আগস্ট ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী ॥ আইনগত মোকাবেলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক প্রধান বিচারপতির আসনের মর্যাদা রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে প্রধান বিচারপতির আসন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং যে কোন ব্যক্তি সেই আসন অলঙ্কৃত করলে তাকেও আমরা সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক করে ফেলি। তাই আমাদের সকলের দায়িত্ব এই প্রাতিষ্ঠানিক আসনটির মর্যাদা রক্ষা করা। তিনি আরও বলেন, শুধু এটুকু বলতে চাই, আমার মনে হয় সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধান পরিপন্থী আখ্যায়িত করে প্রধান বিচারপতির যে রায় তা যুক্তি তাড়িত নয় বরং আবেগ ও বিদ্বেষ তাড়িত। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের প্রতি দ্বিমত থাকলেও আদালতের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। রায়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রধান বিচারপতি যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তাতে আমরা বিস্মিত হয়েছি। আমরা ধন্যবাদ জানাই চার বিচারপতিকে। তারা এ পর্যবেক্ষণে একমত হতে পারেননি। ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রধান বিচারপতির রায়ে যেসব আপত্তি ও অসঙ্গতি রয়েছে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ নেব। আইনমন্ত্রী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া জানাতে বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে নয়, আমরা আইনগতভাবে মোকাবেলা করব। রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। তবে রিভিউয়ের বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।’ কারণ, রায়ের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এখনও নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব নেই। বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদৃঢ় করার জন্য সংবিধান সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি সামরিক শাসকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত। এটি গঠনতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে যায় না। (উদাহরণ ১৯৬২ সালের আইয়ুব খানের সংবিধান)। আইনমন্ত্রী বলেন, রায়ের পর সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের তড়িঘড়ি করে ডাকা বৈঠক দুঃখজনক। প্রধান বিচারপতির বক্তব্য আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেনÑ আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মোঃ জহিরুল হক, লেজিসলেটিভ এবং সংসদবিষয়ক সিনিয়র সচিব মোঃ শহিদুল হক, আইন মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা ড. রেজাউল করিম। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা হচ্ছে, এটাকে অশনিসংকেত হিসেবে দেখছে বিএনপিÑ এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘দেখেন, আমি একটা কথা বলি। ওনারা কোর্ট মানেন না। বিচারককে ওনারা সম্মান দেখান না। একজন জামিনপ্রাপ্ত আসামি বিদেশ চলে যান। কোর্টের কোন পারমিশন নেন না। এভাবে কোর্টকে অবজ্ঞা করেন। সে ক্ষেত্রে ওনাদের মুখে আইনের শাসন, আর এসব কথা সাজে না। ওনারা আগে ওইসব ঠিক করে তারপর উপদেশ দিতে আসুক। তারপর আমি গ্রহণ করব।’ আপনারা কি এই রায় আইনগতভাবে নয় রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে চাচ্ছেনÑ জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এই রায় আইনগতভাবেই মোকাবেলা করব। আমাদের এমন কোন অভিপ্রায় নেই যে এটাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করব। এখানে (রায়ে) যেসব রাজনৈতিক বক্তব্য আনা হয়েছে, যেসব ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে, গঠনমূলক আলোচনার জন্য রাজনীতিবিদরা যদি তা ধরে কোন বক্তব্য দেন আমার মনে হয় না এটা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার শামিল।’ ‘প্রধান বিচারপতি কর্তৃক তড়িঘড়ি করে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা অত্যন্ত দুঃখজনক। অতীতে বিচারপতি কে এম সোবাহান, বিচারপতি আবদুর রহমানসহ তিনজনকে অপসারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের তোয়াক্কা করা হয়নি।’ একজন সিটিং জাজ হেফাজতের লিফলেট বিলি করেছিলেন। সে বিষয়টি সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলে গেল। কিন্ত কি কারণে তারেক খালাস দেয়া হলো তা আমাদের জানা নাই। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে যে মন্তব্য করা হয়েছে সেটা তথ্যনির্ভর নয় বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের যে পরিবর্তন ষোড়শ সংশোধনীতে আনা হয়েছিল, হাইকোর্ট গতবছর তা ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। আপীল বিভাগ গত ৩ জুলাই সরকারের আপীল খারিজ করে দিলে সামরিক সরকারের চালু করা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরে আসে। গত ১ আগস্ট প্রকাশিত আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী বলেন, মামলার ‘ফ্যাক্ট অব ইস্যুর’ সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন ‘অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা’ প্রধান বিচারপতি তার রায়ে বলেছেন। ‘তিনি জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানকে হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। আমি মনে করি, ওই সকল রাজনৈতিক প্রশ্ন আদালত কর্তৃক বিচার্য বিষয় হতে পারে না। আমরা তার ওই বক্তব্যে দুঃখিত।’ আইনমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা যেহেতু এই রায়ে সংক্ষুদ্ধ তাই আমরা নিশ্চয়ই চিন্তাভাবনা করছি যে এই রায়ের রিভিউ করা হবে কিনা? আমরা এখনও কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হই নাই। কারণ, রায়ের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এখনও নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এখন আমি প্রধান বিচারপতির রায়ে উল্লেখিত কিছু বক্তব্য সমন্ধে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভরে কিছু বলতে চাই। প্রধান বিচারপতি তার রায়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা যেটা এই মামলার যে ঋধপঃ রহ ওংংঁব-এর সঙ্গে একদমই সম্পর্কিত নাÑ সে রকম বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানকে হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। আমি মনে করি, ওই সকল রাজনৈতিক প্রশ্ন (চড়ষরঃরপধষ ছঁবংঃরড়হ) আদালত কর্তৃক বিচার্র্য বিষয় হতে পারে না। আমরা তার এই বক্তব্যে দুঃখিত। তিনি রায়ের আরেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোন একক ব্যক্তির কারণে হয় নাই। আমি তার এই বক্তব্যে মর্মাহত। আমরা স্মরণ করতে চাই, ইতিহাস বলে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যে আন্দোলনগুলো হয়েছে তারই ফলে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু হয়তো পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন কিন্তু তারই নেতৃত্বে তারই আদর্শে স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছিল। এটা ভুললে চলবে না, জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ছাড়া এ দেশের আর কেউ ১৩ বছরের অধিক কারাভোগ করেন নাই। তাই প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্য আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। ইতিহাস এ কথাও বলে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জনগণের দেয়া ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। আজ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এই বাস্তব সত্যকে পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে সেটাই আমার জন্য অনেক কষ্টের এবং লজ্জার। তাই আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি, আমাদের নিরীক্ষায় প্রধান বিচারপতির রায়ে যেসব আপত্তিকর এবং অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য আছে সেগুলো ঊীঢ়ঁহমব করার উদ্যোগও আমরা নেব। আইনমন্ত্রী বলেন, এখানে উল্লেখ করতে আমি বাধ্য হচ্ছি, দেশকে বিচারহীনতার সংস্কৃতির, অপরাধীদের নৈরাজ্যে, অপসংস্কৃতি এবং গণতন্ত্রকে ভুলুণ্ঠিত করা প্রথা থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারই মুক্ত করেছে। তাই রায়ে যখন উল্লেখ থাকে, আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করছি ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা, তখন ব্যথিত হওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না। আমি আর একটা কথা বলেই শেষ করছি, প্রধান বিচারপতি মামলার ঋধপঃ রহ ওংংঁব বাইরে গিয়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধান পরিপন্থী বলে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তাতে আমরা বিস্মিত হয়েছি। আমরা ধন্যবাদ জানাই, সেই চারজন বিচারপতিকে যারা তার ওই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। বাংলাদেশ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীতে কি ছিল? ‘৯৬। (১) এই অনুচ্ছেদের অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে কোন বিচারক সাতষট্টি বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। (২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না। (৩) এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন। (৪) কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন।’ ষোড়শ সংশোধনীর আগে বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ ছিল : ‘৯৬। (১) এই অনুচ্ছেদের অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে কোন বিচারক সাতষট্টি বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন। (২) এই অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ বিধানাবলী অনুযায়ী ব্যতীত কোন বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইবে না। (৩) একটি সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে ‘কাউন্সিল’ বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্র্তী যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে : তবে শর্ত থাকে যে, কাউন্সিল যদি কোন সময়ে কাউন্সিলের সদস্য এরূপ কোন বিচারকের সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করেন, অথবা কাউন্সিলের কোন সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন অথবা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন কারণে কার্য করিতে অসামর্থ্য হন তাহা হইলে কাউন্সিলের যাহারা সদস্য আছেন তাহাদের পরবর্তী যে বিচারক কর্মে প্রবীণ তিনিই অনুরূপ সদস্য হিসেবে কার্য করিবেন। (৪) কাউন্সিলের দায়িত্ব হইবেÑ (ক) বিচারকগণের জন্য পালনীয় আচরণ বিধি নির্ধারণ করা; এবং (খ) কোন বিচারকের অথবা কোন বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন সেরূপ পদ্ধতি ব্যতীত তাহার পদ হইতে অপসারণযোগ্য নহেন এরূপ অন্য কোন পদে আসীন ব্যক্তির সামর্থ্য বা আচরণ সম্পর্কে তদন্ত করা। (৫) যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোন সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে কোন বিচারকÑ (ক) শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা (খ) গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। (৬) কাউন্সিল তদন্ত করিবার পর রাষ্ট্রপতির কাছে যদি এরূপ রিপোর্ট করেন, উহার মতে ওই বিচারক তাহার পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে অযোগ্য হইয়া পড়িয়াছেন অথবা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইয়াছেন তাহা হইলে রাষ্ট্রপতির আদেশের দ্বারা ওই বিচারককে তাহার পদ হইতে অপসারিত করিবেন। (৭) এই অনুচ্ছেদে অধীনে তদন্তের উদ্দেশ্যে কাউন্সিল স্বীয় কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করিবেন এবং পরোয়ানা জারি ও নির্বাহের ব্যাপারে সুপ্রীমকোর্টের ন্যায় উহার একই ক্ষমতা থাকিবে। (৮) কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন। ষোড়শ সংশোধনীর আগের ১৯৭২ সালের সংবিধানে ৯৬ অনুচ্ছেদ হুবহু ষোড়শ সংশোধনীর মতোই ছিল। সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনীতে অনেক বিষয় ১৯৭২ সালের গণপরিষদ দ্বারা জাতির পিতার অংশগ্রহণসহ যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল বহুলাংশে সেই সংবিধানে ফিরে গিয়েছিল। বিচার বিভাগের সম্মান, স্বাধীনতা এবং বিচারক অপসারণের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার অভিপ্রায় নিয়ে এই সংশোধনী আনা হয়েছিল এবং তা জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছিল। আইনমন্ত্রী বলেন, আপনারা জানেন এই সংশোধনী পাস করা অব্যবহিত পরে একটি জনস্বার্থ মামলা (চওখ) দ্বারা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং হাইকোর্ট বিভাগ ৫ মে ২০১৬ তারিখে রায়ে এটাকে সংবিধান পরিপন্থী রায় দেয় তার পর আপীল বিভাগে আপীল করা হয়। আপীল বিভাগ পরে মূলত, ৩টি কারণে হাইকোর্টের রায় বলবৎ রাখেন যাহা ১. ষোড়শ সংশোধনী যেহেতু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ব্যাঘাত ঘটাবে সেই কারণে ইহা সংবিধানের ইধংরপ ঝঃৎঁপঃঁৎব-এর পরিপন্থী। রায়ে আরও বলা হয়, আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বঃপ. ঠঝ ইধহমষধফবংয ধহফ ড়ঃযবৎং, ইখউ ১৯৮৯(ঝচ-১)১ রায়ে স্বাধীন বিচার বিভাগ সংবিধানের ইধংরপ ঝঃৎঁপঃঁৎব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ২. সংসদের হাতে যদি বিচারপতিকে অপসারণের দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে বিচারকগণ স্বাধীনভাবে তাদের কাজ করতে পারবেন না কারণ তারা সব সময় ভয়ে থাকবেন যে সংসদ সদস্যদের বিপক্ষে রায় দিলেই তাদের অপসারিত করা হবে। ৩. যেহেতেু পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৯৬ অনুচ্ছেদকে ১৯৭৭ সালের মার্শাল ল’ প্রক্লামেশন দ্বারা সংশোধিত অবস্থা বহাল রাখা হয়েছিল। সেই জন্য এটা সংবিধানের ইধংরপ ঝঃৎঁপঃঁৎব-এ স্থান পায়। এটা দিবালোকের মতো সত্য যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন সে রায়ের সঙ্গে আমাদের দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে। আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে বলতে চাই, শ্রদ্বেয় আপীল বিভাগ যে যুক্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছেন সেসব যুক্তি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার এবং জাতীয় সংসদের কোন দিনই এই অভিপ্রায় ছিল না, কোন সংশোধনী দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ বা খর্ব করা হবে। আমাদের বিবেচনায় ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও সুদৃঢ় এবং স্বচ্ছ হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করার গণতন্ত্রের মৌলিক মন্ত্র চেক এ্যান্ড ব্যালেন্স পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে ষোড়শ সংশোধনী পাস করি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত গণপরিষদ দ্বারা পাসকৃত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুপ্রীমকোর্টের কোন বিচারককে অপসারণ করা হয় নাই। কিন্তু ১৯৭৭ সালের সামরিক শাসন দ্বারা সংশোধিত ৯৬ অনুচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও সুপ্রীমকোর্টের অনেক বিচারককে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলে না নিয়েও চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। আমি মনে করি, ১৯৭২ সালে গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত মূল সংবিধান যেটাকে বুকে ধারণ করে জন্ম নিয়েছে সেটা অসাংবিধানিক হতে পারে না। সংসদের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের বিধান ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্টেলিয়া, কানাডাসহ ৩৮% কমনওয়েলথভুক্ত দেশে বিদ্যমান রয়েছে। তবে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ নিজে তদন্ত করে না তৃতীয় কোন পক্ষের মাধ্যমে তদন্ত প্রমাণের দায়িত্ব প্রদান করে থাকে যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়। আমরাও অনুরূপ একটা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমি বলতে চাই, মূল সংবিধানের কোন বিধানের জুডিসিয়াল রিভিউ হয় কিনাÑ এ বিষয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। আমাদের কাছে সুপ্রীমকোর্টে বিচারকগণকে স্বেচ্ছাচারিতার (অৎনরঃৎধৎরষ) মাধ্যমে অপসারণ করাটা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের ব্যর্থতা বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আমরা মনে করেছি, সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি অত্যন্ত অস্বচ্ছ এবং নাজুক। তাই এর পরিবর্তনের মাধ্যমে সুপ্রীমকোর্টের বিচারকদের স্বাধীনতা এবং তাদের চাকরির নিশ্চয়তা রক্ষা করা হয়েছিল বলেই আমাদের বিশ্বাস।
×