ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বাড়ার নেপথ্যে-

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১০ আগস্ট ২০১৭

গৃহকর্মী নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বাড়ার নেপথ্যে-

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ রাজধানীর বনশ্রীতে ৫ আগস্ট গৃহকর্মী লাইলীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গৃহকর্তা মইনুদ্দিনের মতে, লাইলী প্রতিদিনের মতো সেদিনও যথারীতি বাসায় কাজ করতে আসে এবং পরে বাড়ির একটি ঘরে ঢুকে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেন। কিছুক্ষণ পর দরজার ছিটকিনি ভেঙ্গে ঘরের ভেতরে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় লাইলীকে পাওয়া যায়। এ ঘটনায় বাড়ির মালিককে আটক করা হয়েছে। জানা গেছে, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়িয়া উপজেলার আজুয়াটালী গ্রামে লাইলীর বাড়ি। স্বামী নজরুল ইসলাম ভারতের কারাগারে বন্দী। পেটের দায়ে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাঁচতেই গৃহশ্রমিক হিসেবে রোজগার শুরু করেন লাইলী। তিনি বনশ্রীর পাশে হিন্দুপাড়া বস্তিতে থাকতেন। স¤প্রতি গৃহকর্মী হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে ঘটনাসমূহ আপোস করা এবং এসব ক্ষেত্রে বিচারহীনতাই এর পেছনে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে ৩১ জুলাই রাজধানীর কাঁঠালবাগান ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এলাকার একটি ভবনের ষষ্ঠ তলা থেকে লাকি আক্তার রাখি (১৪) নামের এক গৃহশ্রমিকের মরদেহ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। লাকী আক্তার নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার সোবহানপুর গ্রামের হালিম মিয়ার মেয়ে। সে গত ৮ মাস ধরে কাঁঠালবাগান ফ্রি স্কুল স্ট্রিট রোড এলাকায় ব্যবসায়ী হানিফ মিয়ার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত। গত ৩১ জুলাই সকাল ১০টার দিকে গৃহকর্মী লাকী আক্তারকে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের তথ্য মতে, চলতি বছরের বিগত ৬ মাসে গৃহকর্মে নিযুক্ত শ্রমিকদের নির্যাতন চিত্রে দেখা যায়, মোট ৫ জন আত্মহত্যা করেছেন এবং আরও ৫ জন শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া, আরও ১৬ জন গৃহশ্রমিক আহত হয়েছেন। ২০০১-১০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে গৃহকর্মে নিযুক্ত ৬২১ শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেছেন। সেইসঙ্গে প্রায় ২০০ নারী শ্রমিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং ১৮৪ গৃহশ্রমিক বিভিন্নভাবে নির্যাতনের ফলে আহত হয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গৃহকর্মে নিযুক্ত শ্রমিকের ওপর নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রভৃতি উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে এবং এ বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক এই গৃহশ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে আইনগত কোন স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশ শ্রম আইন ১১ অক্টোবর ২০০৬ পাস হয়েছে, তাতে গৃহ শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী জনকণ্ঠকে বলেন, চলতি বছরে ঘটা বেশ কয়েকটি গৃহশ্রমিক মৃত্যু ও নির্যাতনের চিত্র ভযাবহ আকার ধারণ করছে। সরকার ঘোষিত ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’ বাস্তবায়ন না হওয়ায় দেশে একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত কারণে গৃহশ্রমিকের মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি, লাইলী হত্যাকা- আরও একটি ঘটনার জন্ম দিল। তবে এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা তা এখনও পুলিশ নিশ্চিত নয়। তদন্ত চলছে এবং ইতোমধ্যেই পুলিশ গৃহকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। লাইলী হত্যার বিচার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এভাবে যদি প্রতিটি মামলা নিজ গতিতে এগিয়ে যেত তাহলে অনেক অপরাধী ধরা পড়ত এবং কঠিনতম সাজা পেত। যেমন গৃহকর্মী আদুরীকে নির্যাতনের মামলার রায়ে গৃহকর্ত্রী নদী যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হয়েছে।’ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিল্স) ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সহায়তায় ‘গৃহ শ্রমিকদের জীবনযাপন প্রল্ডিয়া ও প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা : একটি সামাজিক গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণায় উঠে আসে গৃহ শ্রমিকদের প্রতি বঞ্চনার করুণ চিত্র; তাদের নেই বিশ্রাম-বিনোদনের ন্যূনতম কোন সুযোগ। মুক্ত মানুষ হয়েও চার দেয়ালে তারা বন্দী; বন্দী তাদের শিক্ষা, সুকুমার বৃত্তি আর মানবাধিকার। দেশে বর্তমানে ২০ লাখের বেশি মানুষ গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিক রয়েছে যার ৮০ শতাংশই নারী। বিচারহীনতার কারণেই গৃহশ্রমিক নির্যাতন বাড়ছে বলে মনে করেন গৃহ শ্রমিক নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ও বিল্স- এর সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গৃহকর্মী হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে ঘটনাসমূহ আপোস করা এবং এসব ক্ষেত্রে বিচারহীনতার কারণেই। একমাত্র শিশু গৃহকর্মী আদুরি নির্যাতনের ঘটনায় অপরাধীর কঠিনতম শাস্তি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অথচ এমন অনেক মামলা আছে যেগুলো বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। এসব মামলার অনেকগুলো আবার উভয়পক্ষের মধ্যে আপোসের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে।’ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশু শ্রম জরিপ ২০০৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, গৃহকর্মে নিয়োজিত মোট শিশু শ্রমিক হচ্ছে (৫-১৭ বছর) ১ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ মেয়ে শিশু শ্রমিক। লেবার ফোর্স সার্ভে ২০০৬ এর তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে গৃহ কর্মে নিয়োজিত মোট শ্রমিক ৩,৩১,০০০ জন (১৫ বছরের ওপরে)। ধারণা করা হয়, ১০ বছর পর গৃহশ্রমিকদের এই সংখ্যাটা আরও বেড়ে প্রায় ২৫ লাখ ছাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও)- এর হিসাব মতে দেশে শিশু গৃহশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার এবং এদের মধ্যে ৮৩ শতাংশই মেয়ে শিশু। গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিকদের ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬’ এর আওতা বহির্ভূত রাখায় এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিককে মানবিক অধিকার, শোভন কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং শারীরিক-মানসিক হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গৃহশ্রমিক নীতিমালা ২০১৫ সালে সরকার গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি গ্রহণ করে। এতে গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই নীতিমালা অনুযায়ী ১২ বছরের নিচে কাউকে চাকরি দিলে তৃতীয় পক্ষের অনুমতি নিতে হবে। পরিশ্রমের পাশাপাশি বিনোদনের জন্য সময় দেয়ার কথাও বলা আছে নীতিমালায়। মাতৃত্বকালীন ছুটি হিসেবে চার মাসের বেতনসহ ছুটি দেয়ার কথাও আছে এতে। কোন কারণে গৃহকর্মী অসুস্থ হলে তার সুস্থতার জন্য সম্পূর্ণ খরচের ব্যয়ভার বহন করবে নিয়োগকর্তা। সেইসঙ্গে কোন গৃহকর্মী নিয়োগকারী, তার পরিবারের সদস্য বা অতিথিদের দ্বারা শারীরিক, মানসিক বা যৌন হয়বানির শিকার হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। গৃহকর্মী নির্যাতন বা হয়রানির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানা যেন দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে সেজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দাফতরিক নির্দেশনা জারি করতে হবে। কোন গৃহকর্মী যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করলে সরকারী খরচে সেই মামলা পরিচালিত হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ আছে।
×