ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রুততম সময়ে সড়ক মহাসড়ক বেহাল যে কারণে-

বিদেশ থেকে আনা নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১০ আগস্ট ২০১৭

বিদেশ থেকে আনা নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ আমদানি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কোন নিয়মনীতি ও তদারকি না থাকায় নিম্নমানের বিটুমিন আসছে বিদেশ থেকে। আর অতি মুনাফা লাভের অসৎ উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ওই বিটুমিন ব্যবহার করছে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার কাজে। ফলে দ্রুততম সময়ে এ জাতীয় বিটুমিন দিয়ে নির্মিত ও সংস্কারকৃত সড়কের বেহাল হচ্ছে। এ নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। এরপরও এ নিয়ে কার্যকর কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান বর্ষা মৌসুমে অতি ভারি বর্ষণে দেশের বিভিন্ন স্থানে জলজটসহ বিভিন্ন কারণে নতুন ও পুরনো রাস্তাঘাটের যে দুর্দশা তার নেপথ্যের বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানির নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় শহরে এবং বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেনের মহাসড়কে বর্তমানে যে সৃষ্ট খানাখন্দকে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এর মূল কারণ হিসেবে বিদেশ থেকে আমদানির অতি নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারই দায়ী বলে অভিযোগ উঠেছে। সূত্র জানায়, দেশে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিটুমিনের চাহিদা বছরে ৮০ হাজার টনের সামান্য বেশি। অথচ চাহিদার অনুরূপ বিটুমিন দেশে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে উৎপাদিত হচ্ছে। বিশেষ করে সরকার নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি এককভাবে বছরে ৭০ হাজার টন বিটুমিন উৎপাদন করে থাকে। অবশিষ্ট চাহিদার বিটুমিন উৎপাদিত হয় বেসরকারী মালিকানার একটি প্রতিষ্ঠানে। বিদেশ থেকে দুই শ্রেণীর বিটুমিন আমদানি হয়ে আসছে এবং এর অধিকাংশই আসছে ইরান থেকে। যে কোন আমদানিকারক বিটুমিন আমদানি করতে পারে। দেশে যখন বিটুমিনের চাহিদা সৃষ্টি হয় তখন একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী রীতিমতো প্রতিযোগিতামূলকভাবে নিম্নমানের (১০০/৮০ গ্রেড) বিটুমিন আমদানি করে থাকে। অথচ চাহিদার পুরোটাই এবং ভাল গ্রেডের অর্থাৎ ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন দেশে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে উৎপাদিত হচ্ছে। সূত্র জানায়, ৬০-৭০ গ্রেড বিটুমিনের মূল্য ড্রামপ্রতি বর্তমানে ৬ হাজার ৫শ’ টাকা। পক্ষান্তরে ১০০/৮০ গ্রেডের আমদানি বিটুমিনের মূল্য ড্রামপ্রতি ৫ হাজার ২শ’ টাকা। মূল্যের ব্যাপক তারতম্যের কারণে ঠিকাদাররা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গোপন যোগসাজশের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আমদানির নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করছে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার কাজে। এর পরবর্তীতে দ্রুততম সময়েই এ জাতীয় বিটুমিন বিভিন্ন সড়ককে বেহাল রূপ দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন, উন্নয়ন সংস্থা, সড়ক ও জনপথসহ যারা সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার কাজে জড়িত এদের কাছে অসাধু ঠিকাদাররা গোপন আঁতাতের মাধ্যমে বিদেশী আমদানির নিম্নমানের বিটুমিন সরবরাহ করে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার কাজে ব্যবহার করছে। বিষয়টি দেখভাল বা তদারকির ক্ষেত্রে যেন কেউ নেই। বর্তমান বর্ষা মৌসুমে দেশজুড়ে সড়কসমূহের বেহাল দশার জন্য বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো দায়ী করছে নিম্নমানের বিদেশ থেকে আমদানির বিটুমিনকে। এর সঙ্গে নিম্নমানের সিমেন্ট, বালি, ইটসহ অন্যান্য সামগ্রী তো রয়েছেই। প্রশ্ন উঠেছে, দেশের চাহিদা মেটাতে যেখানে দেশে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিটুমিন উৎপাদিত হচ্ছে সরকারের নীতি নির্ধারক মহল এ ব্যাপারে মনোযোগী না হয়ে যত্রতত্র বিদেশ থেকে বিটুমিন আমদানির বিষয়ে কোন নিয়মনীতি আরোপ করছে না কেন। এর নেপথ্যের রহস্য কি? সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার কাজে জড়িত সংস্থাগুলো এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থের যে ক্ষতি ডেকে আনছে এ নিয়ে যেন কোন জবাবদিহিতাও নেই। সূত্র জানায়, বিটুমিনের প্রধান শত্রু একদিকে পানি, অপরদিকে অতিরিক্ত তাপমাত্রা। অতিরিক্ত তাপে সড়কে ব্যবহৃত বিটুমিন ফুলে ওঠে এবং ক্ষেত্রবিশেষে গলেও যায়। এর ওপর অতিবর্ষণে বিটুমিনের তলদেশে পানি প্রবেশের সুবিধা পেলে তা সড়ক থেকে উঠে যায়। আর যখন এর ওপর দিয়ে যানবাহন চলে তখন তা যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে সড়ক পরিণত হয় খানাখন্দকে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার এমন দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে দেশজুড়ে। দেশের প্রধান দুই বৃহৎ শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিস্থিতি যখন অনুরূপ তখন স্বাভাবিকভাবে অন্যান্য শহর ও স্থানের অবস্থা কি তা সহজেই অনুমেয়। সঙ্গত কারণে দাবি উঠেছে, বিটুমিন ব্যবহারের নিয়মনীতি নিয়ে। বিদেশ থেকে বিটুমিন আমদানিতে কারও বাধা নেই। কিন্তু নিয়মনীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিশ্চয় নয়। সস্তামূল্যে নিম্নমানের বিটুমিন আমদানি করে তা সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার কাজে অবাধে ব্যবহার হওয়ার কারণে বর্তমানে রাস্তাঘাটের যে বেহাল দশা তা নিয়ে এককভাবে সরকারই সমালোচনার মুখে পড়ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা অসাধু ঠিকাদারের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে আমদানির নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার করেই চলেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণেও অনুরূপ বিটুমিন ব্যবহার হওয়ার ঘটনা রয়েছে। গত বছর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই সরেজমিনে পরিদর্শনকালে এ ধরনের বিটুমিন ব্যবহারের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এবং অতি দ্রুত এ জাতীয় বিটুমিন সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর এ নির্দেশ সর্বত্র আদৌ পালিত হয়েছে কিনা তা জানা না গেলেও বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণ করছে নিম্নমানের আমদানির বিদেশী বিটুমিন দেশের নতুন ও পুরাতন সড়কগুলোকে রীতিমতো গ্রাস করেছে। এতে করে জনদুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন যানবাহনের যন্ত্রাংশের ব্যাপক ক্ষতি ডেকে আনছে।
×