ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে আইন কমিশন ॥ জাজেস রিপাবলিক!

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১০ আগস্ট ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে আইন কমিশন ॥ জাজেস রিপাবলিক!

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আপীল বিভাগের রায় অপরিপক্ব, পূর্বপরিকল্পিত ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে আইন কমিশন। বুধবার আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এই রায়ের বিষয়ে কমিশনের প্রতিক্রিয়া জানান। সাবেক এই প্রধান বিচারপতি আক্ষেপ করে বলেন, ‘সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। কিন্তু এই রায় পড়ে মনে হয় দেশ জাজেস রিপাবলিক হয়ে গেছে।’ সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই তিনি বলেন, অন্যান্য সময় আমি নিজের মত দিয়ে থাকি। আজকে যা বলব সবই আইন কমিশনের পক্ষ থেকে। আমার একার মত নয়। এ সময় আইন কমিশনের সদস্য বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির এবং কমিশনের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা ফউজুল আজিম উপস্থিত ছিলেন। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান তার বক্তব্যে বলেন, সুপ্রীমকোর্ট জনগণের একটা প্রতিষ্ঠান, সুপ্রীমকোর্ট জনগণের টাকায়ই চলে। তাই রায় নিয়ে যে কোন ব্যক্তি যে কোন সময়ই আলোচনা-সমালোচনা করতে পারে। এজন্য এই রায় নিয়ে আইন কমিশনের একটা মতামত দেয়ার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করছি। তিনি বলেন, প্রথমে আমরা কিছু সাধারণ মতামত দিতে চাই। সাধারণ মতামত দিতে গিয়ে আমরা প্রধানত অথর জাজের (বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি, এই মামলায় প্রধান বিচারপতি বেঞ্চের নেতৃত্ব দিয়েছেন) লেখা রায় নিয়ে বলতে চাই। তিনি প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন। প্রধান বিচারপতির লেখা এই রায়ে ইস্যুকে বাইপাস করে এত অত্যধিক পর্যবেক্ষণ রয়েছে, পড়তে গিয়ে মনে হয় ইস্যুটাই যেন হারিয়ে গেছে। সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, রায়ের সাত নম্বর পৃষ্ঠায় গিয়ে ইস্যু খুঁজে পেয়েছি। সাত পৃষ্ঠা পর্যন্ত বোঝাই যাচ্ছিল না কোন মামলার রায় এটা। রায়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করা হয়েছে, যা বাঞ্ছনীয় নয়। তিনি আরও বলেন, আরেকটা জিনিস আমাদের অবাক লেগেছে, এটা কোন অরিজিনাল কেস নয়, এটা হচ্ছে হাইকোর্টের রায়ের ওপর আপীল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হাইকোর্টের রায়ের ওপর আলোচনা খুবই সামান্য। এখানে হাইকোর্টের রায় নিয়েই মূল আলোচনা থাকা দরকার ছিল। রায়ে সংসদ এবং নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অনেক মন্তব্য করা হয়েছে। অথচ এই মামলায় স্পীকার বা নির্বাচন কমিশনকে পক্ষ করা হয়নি। ফলে যাদের যাদের পক্ষ করা হয়নি, তাদের অবর্তমানে মন্তব্য করা অবাঞ্ছনীয়। তিনি আরও বলেন, রায়ে সংসদকে ইমম্যাচিউরড বলে মন্তব্য করা হয়েছে। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আরেকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে বা সংসদ সদস্যদের অপরিপক্ব বলবে এটা ঠিক না। বিশেষত হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে। ফলে প্রধান বিচারপতি যদি বলেন সংসদ সদস্যরা অপরিপক্ব, তাহলে তো আমাদের বলতে হবে সুপ্রীমকোর্টের বিচারকরাও অপরিপক্ব। তারাও তো তাদের রায়ের মধ্যে যেসব কথা বলার প্রয়োজন ছিল না, তাও বলেছেন। অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করেছেন। ওইসব কথা আবার আপীল বিভাগকে এক্সপাঞ্জ করতে হয়েছে। আপীল বিভাগের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতিও তার রায়ে সংসদ সদস্যদের ইমম্যাচিউর বলেছেন। এটাতো ঠিক বাঞ্ছনীয় নয়। এবিএম খায়রুল হক আরও বলেন, এই মামলা শুনানি শুরুর অনেক আগে থেকেই আমরা লক্ষ্য করেছি, অনেক বিচারপতি সেমিনারে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে অনেক বাজে মন্তব্য করেছেন। তাহলে আমরা ভাবব এটা আগে থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছিল। সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে আগে থেকেই নানা ধরনের মন্তব্য করার পর ওই সব মন্তব্য রায়েও থাকলে তো বোঝা যায়, আগে থেকেই চিন্তা ভাবনা করা ছিল। এ রায় দিতে তো তাহলে শুনানি করা লাগে না, ওনার মনের মধ্যেই তো এটা ছিল। তিনি আরও বলেন, রায়ে বার বার বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যরা স্বাধীন নয়, ৭০ অনুচ্ছেদ তাদের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। এবং এ কারণেই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে থাকা উচিত না। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তিনি বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোন সংসদ সদস্য দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। যদি দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন তাহলে ওনার সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু সংসদে কি যায়? আইনের খসড়া বিল আকারে যায়। এই বিলগুলো তো দল নয়, এই বিলগুলো বিরোধী দল আনতে পারে, যে কোন সংসদ সদস্য আনতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারী দলই বিলগুলো সংসদে আনে। ফলে ভোটাভুটিটা কিন্তু কোন দলের পক্ষে-বিপক্ষে হয় না। হয় বিলের পক্ষে-বিপক্ষে। একবারই মাত্র দলের বিরুদ্ধে ভোটাভুটি হতে পারে যদি অনাস্থা সংক্রান্ত বিষয় থাকে। সে ক্ষেত্রেই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বলবৎ হবে। এখানে কোন সংসদ সদস্য দলের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তার সদস্যপদ বাতিল হবে। অন্য কোন ক্ষেত্রে দলের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেয়ার কোন সুযোগই নেই। সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, রায়ে বলা হচ্ছে, সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল না থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে যাবে। এ কথার সঙ্গে আমি একমত নই। এর কারণ হচ্ছে ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান হলো, ওই সংবিধানের যখন ৯৬ অনুচ্ছেদ ছিল তখনও আমরা সবাই জানতাম, সুপ্রীমকোর্টও জানত বিচার বিভাগ স্বাধীন। সব সময়ই আমরা জেনে এসেছি বিচার বিভাগ স্বাধীন। ৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা চলে গেল রাষ্ট্রপতির কাছে। কাজেই চতুর্থ সংশোধনীর আগ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল না। ৯৬ অনুচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও তখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল। এখন বলা হচ্ছে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল না থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে না। তিনি বলেন, আমাদের বক্তব্য হচ্ছে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোন সম্পর্ক নেই। এটাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মোড়কে হাতিয়ার হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলে তো বটেই প্রত্যেকটা মানুষের যারা সরকার থেকে বেতন গ্রহণ করেন তাদের একটা দায়বদ্ধতা আছে। ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করার পর তো বিচারপতিদের দায়বদ্ধতাটা আর থাকছে না। খায়রুল হক বলেন, এটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। তবে এই রায়ের পড়ে আমাদের মনে হচ্ছে, আমরা আর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে নয়, বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে আছি। কারণ জনগণ তো সরে গেল এখান থেকে। জনগণের প্রতি বিচার বিভাগের যে দায়বদ্ধতাটা রয়েছে, তা মুছে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেন, সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল আজকে আছে, তাই ওনারা (সুপ্রীমকোর্ট) মনে করছেন আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। কালকে তো আরেক জন আরেকটা রিট করতে পারেন। সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে একজন বিচারপতি আরেকজন বিচারপতির কাছে দায়বদ্ধ থাকছে। এটাতো হতে পারে না। প্রধান বিচারপতি কি প্রধান শিক্ষক, আর অন্য বিচারপতিরা ছাত্র নাকি যে, সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তাকে (প্রধান বিচারপতি) অন্য বিচারপতিদের পরিচালনা করতে হবে? সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে তো বিচারপতিরা সবাই স্বাধীন। তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সংবিধানের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনতে হলে আবারও সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধানে যেহেতু সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ছিল না, সেহেতু এটা রাখা সংবিধান পরিপন্থী। রায়ের পর ইতোমধ্যে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে এবং কাউন্সিল মিটিংও করেছে এই মিটিংয়ের বৈধতা আছে কি-না, এমন প্রশ্নে জবাবে খায়রুল হক বলেন, বৈধ বা অবৈধ বিষয়টি দেখার দায়িত্ব আদালতের। তবে আমরা বলব এটা ঠিক হয়নি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় সম্পর্কে তিনি বলেন, আপীল বিভাগের রায়টি অপরিপক্ব, পূর্বপরিকল্পিত ও অগণতান্ত্রিক। এর মাধ্যমে মার্শাল ল’ আমলে চলে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি আরও বলেন, যেখানে দুদককে চিঠি দিয়ে সাবেক বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়া হয়, সেখানে তাদের ওপর (সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের সদস্য বিচারপতিদের) নির্ভর করব কিভাবে? আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, সংসদ সদস্যরা ভুল করলে সুপ্রীমকোর্ট দেখে সংশোধন করবেন। সেখানে সুপ্রীমকোর্ট (বিচারপতিরা) ভুল করলে আমরা যাব কোথায়? এই রায়ের মাধ্যমে জুজুর ভয় দেখানো হচ্ছে এবং সংসদ সদস্যদের হেয় করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
×