ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার ইলিশ

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১০ আগস্ট ২০১৭

বাংলার ইলিশ

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চিরদিনের জন্য স্থান পেল বাংলার ইলিশ। এর আগে ঠাঁই হয়েছে ঐতিহ্যসম্মত জামদানি শাড়ির। ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই দুটো পণ্য, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এক সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক অর্জন। প্যাটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদফতর সূত্রের খবর, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডেক্স বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ইলিশ মাছের নাম নিবন্ধনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আগামী সপ্তাহে এ সংক্রান্ত সনদ তুলে দেয়া হবে মৎস্য অধিদফতরের হাতে। উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ও বিশ্ব মেধাস্বত্ব কর্তৃপক্ষের (ডব্লিউআইপিআরও) যৌথ সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় সব দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে। তদনুসারে ইলিশ এখন বাংলাদেশের পণ্য। দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে, এটি একটি সুসংবাদ বটে। ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে যেখানে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার টন সেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার টনে। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ২ লাখ টনের বেশি। সরকার তথা মৎস্য অধিদফতরের নেয়া নানামুখী পদক্ষেপের ফলেই ইলিশের এই উৎপাদন বৃদ্ধি। তবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি এখনও কাক্সিক্ষত উৎপাদন নয়। তা না হওয়ার প্রধান কারণ কারেন্ট ও বেহুন্দি জাল দিয়ে জাটকা আহরণ বন্ধ করতে না পারা। এ অবস্থায় ‘জাটকা ইলিশ ধরব না, দেশের ক্ষতি করব না’ প্রতিপাদ্য নিয়ে প্রতিবছর পালিত হয় ইলিশ রক্ষা সপ্তাহ। এর জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে ৯০০ কোটি টাকার প্রকল্প। এর মাধ্যমে সারাদেশে বিশেষ করে ইলিশ আহরণের স্থানগুলোতে সরেজমিন অভিযান চালিয়ে এসব জাল পুড়িয়ে ফেলা হবে। তাতে ইলিশ উৎপাদন আরও বাড়বে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে রোল মডেল, এমনকি মৎস্য উৎপাদনেও। চতুর্থ স্থান অধিকারী বাংলাদেশ তবুও তো সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণে অনেক পিছিয়ে আছে। সুবিশাল বঙ্গোপসাগরের বিপুল অর্থনৈতিক সীমানা থেকে এখন পর্যন্ত খুব কমই মৎস্য সম্পদ আহরিত হয়ে থাকে। আগামীতে এই অফুরান সম্পদ আহরণ করতে পারলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে মৎস্য সম্পদে। অবশ্য ইলিশও প্রধানত সামুদ্রিক ও সমুদ্র উপকূলীয় মাছ। মোহনার মাধ্যমে ইলিশ মিঠা পানির নদ-নদীতে প্রবেশ করে থাকে প্রজনন মৌসুমে। আর তখনই ধুম পড়ে যায় জাটকা তথা পোনা ইলিশ আহরণের। যে কোন মূল্যে এটা বন্ধ করতে পারলে ইলিশের উৎপাদন বহুগুণ বাড়বে নিঃসন্দেহে। মনে রাখতে হবে, জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে ইলিশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসে ইলিশ থেকে। আরও একটি শ্লাঘার বিষয় এই যে, ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যতিরেকে অন্য ১০টি দেশেই কমেছে ইলিশের উৎপাদন। একমাত্র বাংলাদেশেই প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে ৯-১০ শতাংশ হারে। বিশ্বের ৬৫ শতাংশ ইলিশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে পাওয়া যেত ইলিশ। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদী-নদীতে সন্ধান মিলেছে ইলিশের। এমনকি হাকালুকি ও মেদির হাওড়েও পাওয়া গেছে ইলিশ। সার্বিকভাবে নদ-নদী ও জলাশয় কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি ইতিবাচক দিক। দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১১ ভাগই ইলিশ। উপকূলীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের প্রায় পাঁচ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি জড়িত। এ ছাড়া ২০ থেকে ৯৫ লাখ লোক জড়িত পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রফতানি ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কাজে। ইলিশের উৎপাদন মৌসুমে পূর্ণিমা-অমাবস্যার জো’র সময় মা ইলিশ ও জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ সময়ের ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের ভিজিএফ কর্মসূচীর আওতায় চাল দেয়ার পাশাপাশি বিকল্প আয় ও কর্মসংস্থানের কথাও ভাবা হচ্ছে। তবে সবকিছুর ওপরে জনসচেতনতা। গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে, রাখছেও। সর্বস্তরের মানুষ যদি জাতীয় একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পণ্য ইলিশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন হয় তাহলেই এর উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব। বাঙালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম একটি অপরিহার্য উপাদান হলো ইলিশ। এর প্রযত্ন ও সুরক্ষার দায়িত্ব সকলের।
×