ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টেকনাফের পাহাড়ী এলাকায় র‌্যাবের অভিযানে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার

মিয়ানমারের ‘জঞ্জাল’ এপারে সহিংসতা বিস্তারে তৎপর

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৯ আগস্ট ২০১৭

মিয়ানমারের ‘জঞ্জাল’ এপারে সহিংসতা বিস্তারে তৎপর

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ ওপারের ‘জঞ্জাল’ এপারে ঘাঁটি করতে চায়। আধিপত্য বিস্তার করতে চায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে। বিষয়টি মিয়ানমারের দরিদ্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ব্যানারে রেখে সে দেশের সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইন প্রদেশের গহীন অরণ্যের বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি গেড়েছে এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) ও উগ্র বৌদ্ধ মৌলবাদীদের প্রতিনিয়ত বর্বর কায়দায় অত্যাচারে টিকতে না পেরে লাখ লাখ নিরীহ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে। এ সুযোগে স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। যার মধ্যে আরএসও, এআরএনও, এআরইউ, এআরই, আরআইএফ, মাহাত, জেআরসিসহ ১২টিরও বেশি সংগঠনের নাম রয়েছে। এসব সশস্ত্র সংগঠনের দুর্ধর্ষ ক্যাডারদের নিয়ে বর্তমানে নতুন একটি গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে, যার নাম ‘আল ইয়াকিন।’ চুরি, ডাকাতি, লুটপাট, সে দেশের সেনা-পুলিশ ক্যাম্পে হানা দিয়ে অস্ত্র লুটপাটসহ বিভিন্ন অপকর্মে এ গোষ্ঠী জড়িত। এ সংগঠনেরই বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ধরা পড়েছে দুই ক্যাডার। র‌্যাব সেভেনের কক্সবাজার অঞ্চলে নিয়োজিত সদস্যরা অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আল ইয়াকিনের টিম লিডার ও রোহিঙ্গা ডাকাত গ্রুপের অন্যতম সদস্য আবদুল হাকিমের সহযোগী মোঃ ফরিদ আলম ও শামসুল আলম। সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত অবধি র‌্যাবের এ অভিযান চলে টেকনাফের গহীন অরণ্যে। গ্রেফতারের পর এদের তথ্যের ভিত্তিতে রাতেই উদ্ধার হয় বিভিন্ন জাতের ১৭টি ভারি অস্ত্র এবং ৪৪২ রাউন্ড গুলি। র‌্যাবের কক্সবাজার ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের মংডুর কাউয়ারবিলে সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর তিনটি চৌকিতে হামলা, অস্ত্র লুট ও বিজিপির ৯ সদস্যকে হত্যার নেপথ্যে রয়েছে আল ইয়াকিন। এ সংগঠনটি সশস্ত্র পন্থায় আরাকানকে মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন করার তৎপরতা চালিয়ে আসছে। এ ঘটনার আগেও এ সংগঠনের সদস্যরা উত্তর মংডু, সাইব বাজার কক্যদইংগা, বুচিদং, রাচিদংসহ বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। পরিণতিতে সাধারণ ও নিরীহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সদস্যদের ওপর নেমে এসেছে নির্বিচারে বর্বরতম নানা ঘটনা। সীমান্তের ওপার থেকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে তথ্য দেয়া হয়েছে, ২০১২ সালে আল ইয়াকিন নামের এ সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। রাখাইন রাজ্যের গহীন অরণ্যের বিভিন্ন স্থানে এদের একাধিক ঘাঁটি রয়েছে। আন্তর্জাতিক কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে রয়েছে এদের যোগাযোগ। অর্থ ও অস্ত্রের চালানও আসছে আন্তর্জাতিক ওসব সংগঠনের পক্ষ থেকে। বর্তমানে কক্সবাজার অঞ্চলে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আধিক্য হওয়ায় আল ইয়াকিনের বিভিন্ন ক্যাডাররা এদেশে নানামুখী আধিপত্য বিস্তারের তৎপরতায় রয়েছে। কিন্তু বিজিবিসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এদের সশস্ত্র তৎপরতা বন্ধে তৎপর থাকায় এখনও সুবিধা করতে পারছে না। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী আল ইয়াকিনের শীর্ষ পর্যায়ের ২০ ক্যাডার এদেশে আশ্রিত সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বিদেশ থেকে এদের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পৌঁছাচ্ছে। সে অর্থ পুনরায় সিঙ্গাপুর হয়ে মিয়ানমারে এ জঙ্গীগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এ পর্যন্তপ্রাপ্ত খবর অনুযায়ী আল ইয়াকিনকে শক্তিশালী করতে এদেশে অবস্থান করে যারা বিভিন্নভাবে নানা পথে সহযোগিতা দিচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা মাস্টার আয়ুব, মৌলভি সফিক, মৌলভি নুর হোসেন, মৌলভি সৈয়দ করিম, মৌলভি আজিজ, মৌলভি ইউনুস, ব্যবসায়ী নুর কামাল, মৌলভি জিয়াউল হক, আবদুল হামিদ, মৌলভি আবদুর রহমান প্রমুখ। এদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের এদেশে আসতে যেমন উদ্বুদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত, তেমনি ফিরে না যেতেও অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন পথে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে যে সাহায্য সহযোগিতা আসছে এর অধিকাংশ এসব আল ইয়াকিনের পৃষ্ঠপোষকদের মাধ্যমে আসছে। যার মধ্যে সাহায্যের বড় একটি অংশ তারা পকেটস্থ করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মংডু বলিবাজার এলাকার মৌলভি মৃত জাফর আলমের পুত্র কক্সবাজারে ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গী নেতা মৌলভি শফিকুর রহমানকে গেল বছর একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু বেশিদিন তাকে জেলে থাকতে হয়নি। ব্যাপক তৎপরতা চালানোর পর তার জেলমুক্তি ঘটে। মৌলভি শফিক নামের আল ইয়াকিনের এক পৃষ্ঠপোষক থাকেন ঢাকার উত্তরার ৪ নং সেক্টরে। একটি এনজিও সংস্থার কর্মকর্তা হিসেবে তার পরিচয়। এর আগে কক্সবাজারের ইসলামপুরে (বার্মাপাড়া) থাকতেন এ সফিক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে খবর রয়েছে এ সফিকই এ পারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের আল ইয়াকিনের সঙ্গে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করছেন। অর্থের লোভে ফেলে নানা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত করছেন। গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর সদস্যরা তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। অপরদিকে, মিয়ানমার থেকে বহু আগে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা আরএসও কমান্ডার হাফেজ ছলাহুল ইসলাম, রোহিঙ্গা মাস্টার আয়ুব, মৌলভি শফিক, মৌলভি নুর হোসেন, মৌলভি করিমুল্লাহ, মৌলভি আয়াছ ও হাফেজ ইয়াছিরসহ অনেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বসতি গেড়েছে। আরএসওর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডাঃ ইউনুছ রয়েছেন মালয়েশিয়ায়। তার নির্দেশ মতে রোহিঙ্গাদের কর্মকা- ও আরএসও’র যাবতীয় তৎপরতা চলে। ডাঃ ইউনুছ ও আয়ুব মাস্টারের স্থায়ী বসতঘর রয়েছে চট্টগ্রামের হালিশহরে। কক্সবাজার ও বান্দরবানে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনকে (আরএসও) সংগঠিত করছে দেশে ঘাপটি মেরে থাকা ও এদেশের নাগরিক দাবিদার কতিপয় ব্যবসায়ী রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তি। আরএসও’র অর্থ বিলিবণ্টন ও এদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে গোপনে সহযোগিতা দিয়ে একাধিক জনপ্রতিনিধি অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছে। তারা বর্তমানে উখিয়ার বালুখালী ও টেকনাফের শাপলাপুরে অবৈধ নতুন নতুন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে সেখানে অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গার আশ্রয়স্থল গড়েছে। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ নামে যারা স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি ব্যতিরেখে ক্যাম্পে যাওয়া-আসা করে, মূলত তারাই (মৌলবাদী গোষ্ঠী) রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। উখিয়ার বালুখালী ও টেকনাফের শামলাপুরে রোহিঙ্গা বস্তি গড়ার পেছনে নানা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সমুদ্র ঘেঁষা শাপলাপুরে প্রশাসনের নজর এড়িয়ে সাগর পথে অস্ত্রসহ বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী আনা নেয়া যায় বলে আরএসও ক্যাডাররা শাপলাপুরকে নিরাপদ স্থান মনে করে থাকে। মহেশখালীর পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র কারখানা ও মিয়ানমার থেকে সাগর পথে অস্ত্র এনে আরএসও ক্যাডাররা প্রথমে জমা করে শাপলাপুর বস্তিতে। অনেক সময় মাছধরার ইঞ্জিনচালিত বোটযোগে বিদেশী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম সারির জঙ্গী নেতা শাপলাপুরে এসে আরএসও নেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে থাকে বলেও তথ্য রয়েছে। টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন বস্তি ও ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা সদস্যদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কতিপয় সন্ত্রাসী রোহিঙ্গার কারণে মিয়ানমারে অমানবিক নির্যাতন ও বর্বরতায় শিকার সাধারণ রোহিঙ্গারা। সেখানে যুগের পর যুগ ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য দেশে স্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়ে থাকতে তাদের ইচ্ছে নেই। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাডারদের নানা অপকর্মের জের হিসাবে তাদের দেশছাড়া হতে হচ্ছে। সূত্র জানায়, নিজ দেশে বন্দী জীবনের মতো রোহিঙ্গা জাতি মিয়ানমারে বসবাস করলেও গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে নিশ্চয় কিছু একটা হবে- এমন আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করেছিল তারা। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নাগরিকত্ব না পেলেও মোটামুটি শান্তিতে ছিল মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা। যে ভাবে পারে আয়-রোজগার, চাষাবাদ, সীমান্ত বাণিজ্য ও স্বদেশে ব্যবসা করে জীবন অতিবাহিত করেছে। হঠাৎ করে গত বছরের ৯ অক্টোবর রাতে মংডুর তিনটি পুলিশ পোস্টে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা জঙ্গীরা হামলা চালিয়ে ফের উত্তপ্ত করে দেয় মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলকে। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে আরাকান অঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড়ী এলাকায় থাকা সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা এ কান্ড ঘটিয়েছে বলে সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সদস্যদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
×