ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চাকা ঘোরে না কুমার পাড়ায়, মাটির কলসি ওঠে না কাঁখে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৯ আগস্ট ২০১৭

চাকা ঘোরে না কুমার পাড়ায়, মাটির কলসি ওঠে না কাঁখে

হাসান ইমাম সাগর ॥ কুমারপাড়ার চাকা আজ আর তেমন ঘোরে না। পল্লীবালা নদীর ঘাটে মাটির কলসি কাঁখে আসে না। মাটির পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল, সরা, বাসন, ঘড়া, কলসি, বদনা, ঠিলার কদর প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক-বাহক মৃৎশিল্প। এ দেশের কুমার সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে এ শিল্প টিকিয়ে রেখেছে। তবে চরম আর্থিক সঙ্কট আর নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বহুসংখ্যক কুমার এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কিছুসংখ্যক কুমার পরিবার পূর্বপুরুষের এ পেশা ছাড়তে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার আর প্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে এবং বাজারে প্লাস্টিকপণ্য আর নিত্যনতুন শিল্পসামগ্রীর প্রসারে এ শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। স্বাধীনতার প্রায় ৪৭ বছরে দেশের অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি মৃৎশিল্পের। হাজার বছরের এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সরকারীভাবেও কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আধুনিক মেশিন ও সরঞ্জামের অভাবে সনাতন পদ্ধতিতেই চলছে এ শিল্পের কার্যক্রম। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, ফাল্গুন ও চৈত্র- এ চার মাস মৃৎশিল্পের তৈরি পণ্যের চাহিদা একটু বেশি থাকলেও বাকি আট মাস চরম কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। এছাড়া চারদিকে বিজ্ঞান আর প্লাস্টিকপণ্যের জয়জয়াকার। মাটির তৈরি জিনিসপত্র ছেড়ে অতিমাত্রায় বাড়ছে প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবহার। দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুই এখন প্লাস্টিকের তৈরি পাওয়া যায়। এক টাকায় পাওয়া যায় ওয়ান টাইম গ্লাস, প্লেট, টিফিন বক্সসহ নানা ধরনের প্লাস্টিকের জিনিস। প্লাস্টিকের তৈরি পলিথিন ব্যাগের ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও তা থেমে নেই। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পূর্ণদমে চলছে এর ব্যবহার। বালতি, মগ, থালা, বাসন, বাটি, ঘটি, টিফিন বক্স, প্রিচ, গ্লাসসহ সবকিছুই প্লাস্টিকের। মূলত মাটির তৈরি জিনিসপত্রের জায়গাটা দখল করেছে প্লাস্টিক। এসব প্লাস্টিকপণ্য মানুষের স্বাস্থের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাছাড়া প্লাস্টিকের এমন যত্রতত্র ব্যবহার এ দেশের মৃৎশিল্পে ধস নামার অন্যতম কারণ। এছাড়া বর্তমান পরিবেশ দূষণের অন্যতম হাতিয়ার প্লাস্টিক বর্জ্য। এ প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম ক্ষতিসাধন করছে। একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় জলাবদ্ধতা ও প্রবল বৃষ্টিতে জলযটের অন্যতম কারণ প্লাস্টিক বর্জ্য। কুমারদের মাটি দিয়ে তৈরি নানা জিনিসের মধ্যে হাঁড়ি-পাতিল, পানি রাখার বড়-ছোট কোলা, কড়াই, কলসি, ভাড়, পসুরী, ফুলদানি, ছাইদানি, খেলনা, পুতুল, ঘরের ছাউনির টালি, ভাতের মাড় গালা নোংড়া, মাছ ধোয়া ঢোলা, চৌকির নিচের পায়াদানি, এছাড়া ছোট বাচ্চাদের বিভিন্ন প্রকার খেলনা যেমন- পুতুল, নৌকা, বালতি, গামলা, জগ, কড়াই, চুলা, টাকা জমানোর ব্যাংক ইত্যাদি বাংলার পুরনো ঐতিহ্য বহন করে। কুমারদের মাটি দিয়ে শৈল্পিক হাতে তৈরি এসব জিনিস বাড়িতে বাড়িতে ফেরি করে ও বিভিন্ন হাটে নিয়ে বিক্রি করতে দেখা যেত। এগুলো বিক্রি করে তারা তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করত। এখন সে দৃশ্য আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। কুমারদের পূর্বপুরুষরাও এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু এ পেশা দিয়ে এখন আর সংসার চালানো যায় না। তাদের তৈরি এসব জিনিস এখন আর তেমন একটা ব্যবহার করা হয় না। হিন্দুদের পূজা কিংবা বিয়েবাড়িতে মাটির তৈরি কলস, বাটি ইত্যাদির ব্যবহার হলেও সেটা অতিনগণ্য। বর্তমানে পহেলা বৈশাখসহ গ্রামীণ মেলায় মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা পুতুলসহ কিছু জিনিস বিক্রি করতে দেখা গেলেও ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। অনেকেই শখের বশে মাঝেমধ্যে কিছু জিনিস ক্রয় করে। এক সময় মাটির তৈরি গাছ রোপণের টবের বেশ চাহিদা থাকলেও এখন অনেকটাই কমে গেছে, যা দেশের নার্সারিসহ বিভিন্ন বাড়ির শোভাবর্ধনের কাজে ব্যবহৃত হতো। প্রতিটি টব তখন ১০-১৫ টাকায় বিক্রি করা হলেও বর্তমানে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় স্বল্পমূল্যে তা বিক্রি করতে পারছে না কুমাররা। মাটির তৈরি থালা আকৃতির বাসন যা আগে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হতো। কিন্তুমূল্য বেড়ে যাওয়ায় এখন আর তা ব্যবহার হচ্ছে না। গরমকালে দইয়ের মালসার চাহিদা একটু বেশি থাকলেও গরম চলে গেলে তা একেবারেই কমে যায়। এ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল মাটি। জমির মালিকরা এ মাটি ইটভাঁটিতে চড়াদামে বিক্রি করছে। ফলে ইটভাঁটির মালিকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ মাটি কেনা অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এসব কারণে প্রায় সারাবছরই কুমারদের বসে থাকতে হয়। এ বিষয়ে মোঃ তোফিকুল ইসলাম খালেক বলেন, মৃৎশিল্পের বাজর কমাতে এবং মাটির দাম বাড়াতে এ পেশায় নিয়োজিত অনেক প্রবীণ কারিগরও এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। আমাদের এলাকার মৃৎশিল্পের অনেক আগের কারিগররা কেউ দর্জি, কেউ কৃষিকাজ করছে আবার কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। মৃৎশিল্প প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মৃৎশিল্প শুধু বাংলাদেশের ঐতিহ্য নয়, এ শিল্পের ওপর আজও বহুসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। এটি একটি দেশীয় পণ্য। মাটির তৈরি যে কোন জিনিস পরিবেশবান্ধব এবং স্বাস্থ্যসম্মত। তাই সরকারী পৃষ্টপোষকতা প্রদান করে হলেও এ শিল্পটি চাঙ্গা করে তোলা অত্যন্ত জরুরী। জবি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জাকারিয়া মিয়া প্লাস্টিক বর্জ্যরে ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য আমাদের ইকোসিস্টেমে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। এটা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের অন্যতম কারণ। এ বর্জ্য কখনই মাটির সঙ্গে মেশে না। এটা আগুনে পোড়ালে এর থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মন অক্সাইড এবং ডাইঅক্সিন নামক গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা যে কোন মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এ ধরনের গ্যাসে গর্ভবতী মায়েদের গর্ভের বাচ্চার শরীর সঠিকভাবে পূর্ণতা পায় না। আমাদের শরীরের ক্যান্সারসহ নানা ধরনের সংক্রামক রোগের কারণ প্লাস্টিক দ্রব্য। তাছাড়া এ প্লাস্টিক বর্জ্য যে এলাকায় ফেলা হয় ওই এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং আমাদের মৃৎশিল্পের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে পারলে প্লাস্টিকপণ্যের ওপর নির্ভরতা কমবে।
×