ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর টানাপোড়েনে পাকিস্তান

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৯ আগস্ট ২০১৭

রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর টানাপোড়েনে পাকিস্তান

পানামা পেপার্সকে কেন্দ্র করে সুপ্রীম কোর্টে ইমরান খানের রিট মামলার রায়ে অযোগ্য ঘোষিত হয়ে পদত্যাগ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। তবে তার দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ক্ষমতায় টিকে আছে এবং পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত থেকে যাবে বলে ধারণা করা যায়। নওয়াজের পদত্যাগের ঘটনার নেপথ্যে সেনাবাহিনীরও একটা হাত আছে বলে মনে করার কারণ আছে। নওয়াজ শরীফের ভারতের প্রতি নমনীয় ও সমঝোতামূলক ভূমিকা সেনাবাহিনীর হয়ত পছন্দ হচ্ছিল না। তাছাড়া ইতিহাসগতভাবে দেখা গেছে যে দেশটিতে রাজনীতিকরা চলেন একদিকে আর সেনাবাহিনী চলে অন্যদিকে। দেশটির রাজনীতিতে এই সেনাবাহিনী সর্বদা কোন না কোন মাত্রায় ছায়া বিস্তার করে থাকে এবং দরকার হলে সরাসরি হস্তক্ষেপও করে বসে। সেনাবাহিনী পাকিস্তানের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে অন্যতম এক শক্তি। সরকারী হিসেবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা খাতে বার্ষিক ব্যয় ৮শ’ কোটি ডলার বা জিডিপির ২.৬ শতাংশ। তবে এর মধ্যে অফিসারদের মোটা পেনশনের অঙ্ক ধরা হলে তা ৪ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়াবে। এর বাইরেও আছে আপৎকালীন দায়দায়িত্বের জন্য বাজেটে বিশাল অঙ্কের বরাদ্দ। সেনাবাহিনী বেশ কিছু শিল্পের মালিক। ফৌজি ফাউন্ডেশন নামে সেনা পরিচালিত একটি হোল্ডিং কোম্পানি আছে যার ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ ২০১৫ সালে ছিল ৩৩০ কোটি ডলার। এটাও বাজেটের বাইরে পড়ে। সেনাবাহিনীর দেশের বৃহত্তম প্রপার্টি ডেভেলপারও বটে। এর ডিফেন্স হাউজিং অথরিটিজের মালিকানায় আছে প্রতিটি নগরীর বিশাল বিশাল অতি দামী জমি। করাচীর সাগরতীর বরাবর ৩৫ বর্গকিলোমিটার জমি, লাহোরের পূর্ব উপকণ্ঠে নগরীর এক- চতুর্থাংশ এলাকার সমান জমিও আছে এই হাউজিং অথরিটির হাতে। এসব সুযোগ-সুবিধার কারণেই একটা হুমকির অনুভূতি বজায় রেখে দেশের রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সেনাবাহিনীর স্বার্থেরই সহায়ক। সে কাজটা করার নানা উপায় আছে। সেনাবাহিনর দালালি করার প্রবণতা অনেক রাজনেতিক দলেরই আছে। বেশ কিছু দলের জন্ম সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে। পুলিশ বাহিনী ও আদালত সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে চলে। সাংবাদিক সমাজের ওপর শক্তিশালী প্রভাব খাটিয়ে থাকে সেনাবাহিনীর মিডিয়া শাখা। কিছু কিছু প্রাইভেট টিভি চ্যানেল উৎসাহী মুখপাত্রের ভূমিকা নেয়। অন্যরা থাকে চাপে। তাদের টেলিফোনে তিরস্কার থেকে শুরু করে হুমকি-ধমকি এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার শিকার হতে হয়। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এই ‘গভীর রাষ্ট্রের’ অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কারণে অনেক পাকিস্তানী চরমপন্থী ধর্মীয় সংগঠনগুলোর বিস্তারের পেছনে সেনাবাহিনীর হাত দেখতে পায়। রাষ্ট্রের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ান জঙ্গী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী উত্তরোত্তর আক্রমণাত্মক অভিযান চালাচ্ছে সত্য। কিন্তু একই রকমের র‌্যাডিকেল যেসব সংগঠন বিদেশী শত্রুদের লক্ষ্য করে সহিংসতা চালাচ্ছে তারা সেনাবাহিনীর রোষানল থেকে রেহাই পাচ্ছে। এমনি পটভূমিতে গত গত বছর সেনাবাহিনীর শীর্ষ অফিসারবৃন্দ ও সিভিলিয়ান নেতাদের মধ্যে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। তাতে রাজনীতিকরা নাকি জেনারেলদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে তারা সুনির্দিষ্ট চরমপন্থী সংগঠনগুলোর রাশ টেনে না ধরলে পাকিস্তান কূটনৈতিক দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এ বছরের এপ্রিল মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ সেনাবাহিনীকে এই হুঁশিয়ারি দেয়ার জন্য নিজের এক শীর্ষ উপদেষ্টাকে বরখাস্ত করেন। এর প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর জনসংযোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক জেনারেল টুইট করেন যে কাজটা ভাল হলো না। পাকিস্তানের বেশিরভাগ সংবাদপত্র তখন ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে যে সেনাবাহিনীর উচিত নির্বাচিত নেতাদের কাছে জবাবদিহি থাকা। সেনাবাহিনী ও সিভিলিয়ানদের এই অদৃশ্য লড়াইয়ে এখনও পর্যন্ত সেনাবাহিনীরই প্রাধান্য বজায় আছে। রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়ার ৭০ বছর পর এখনও দেশটিতে সত্যিকারের কোন জাতীয় দল গড়ে ওঠেনি। প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের তিনটি দীর্ঘ অধ্যায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিবর্তনকে করেছে ব্যাহত। দেশটির রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এখনও দৃঢ়ভিত্তির ওপর গড়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান রয়ে গেছে বিভিন্ন ভাষাভাষী কতগুলো প্রদেশের সমষ্টিতে। তত্ত্বগতভাবে ইসলাম দেশটিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো দেশটিকে ধরে রেখেছে সেনাবাহিনী। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×