ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী অর্থায়নকারী মোস্তাক ফের গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৯ আগস্ট ২০১৭

জঙ্গী অর্থায়নকারী মোস্তাক ফের গ্রেফতার

গাফফার খান চৌধুরী/রফিকুল হাসান চৌধুরী তুহিন ॥ অবশেষে আবারও গ্রেফতার হয়েছে বহুল আলোচিত জঙ্গী অর্থায়নকারী মোস্তাক আহম্মেদ খাঁ। এক সময় জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। পরবর্তীতে তুরস্কের একটি মাদ্রাসায় প্রায় ছয় বছর পড়াশুনা করার সময় পুরোপুরি জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। তুরস্কের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের হয়ে কাজ করেছে। দেশে ফিরে নিজেই এনজিও খুলে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা শুরু করে। সেই টাকায় এদেশীয় জঙ্গীদের অর্থায়ন করতে থাকে। মাত্র সাতাইশ বছর বয়সী এই জঙ্গীর এ্যাকাউন্টে ইতোমধ্যেই দুই কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলিছে। যদিও বর্তমানে এ্যাকাউন্টটিতে মাত্র কয়েক হাজার টাকা রয়েছে। বাকি অর্থ আগেই উত্তোলন করে জঙ্গীদের হাতে তুলে দেয়। সেই টাকা ২০১৪-১৫ সালে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধে নাশকতামূলক কর্মকান্ড চালানোর কাজে ব্যয় করেছে জঙ্গীরা। মঙ্গলবার ঢাকার মালিবাগে সিআইডি সদর দফতরে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, সোমবার গভীর রাতে সিআইডির একটি বিশেষ দল হবিগঞ্জ সদর জেলার একটি বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযানে গ্রেফতার করা হয় মোস্তাক আহম্মেদ খাঁকে। তার পিতার নাম মনোয়ার হোসেন খাঁ। বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং থানাধীন তকবাজখানী গ্রামে। তাকে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। মামলাটির তদন্ত করছেন সিআইডির পরিদর্শক সফি আহমেদ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, ১০/১১ বছর আগে মোস্তাক অবৈধভাবে তুরস্কে যায়। তুরস্কে মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে। সেখানে পড়ার সময় তুরস্কের বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। দেশে ফেরার পর বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলে। নিজে জঙ্গী হওয়ার কারণে জঙ্গী তৎপরতায় অর্থায়ন করতে থাকে। শুধু জঙ্গী তৎপরতা নয়, দেশ বিরোধী কর্মকান্ড চালাতে থাকে। দেশ বিরোধী কর্মকান্ড চালাতে অর্থের প্রয়োজন। অর্থের যোগান দিতে সে বিভিন্ন ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট খুলে। সেই এ্যাকাউন্টে বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা আসতে থাকে। সব মিলিয়ে তার এ্যাকাউন্টে প্রায় ২ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য মিলে। তার বিরুদ্ধে একাধিক থানায় মামলা রয়েছে। ব্যাংকের এ্যাকাউন্টে লেনদেন হওয়া অর্থ সম্পর্কে কোন সদুত্তর দিতে পারেনি মোস্তাক। সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, তুরস্কে যাওয়ার পর মোস্তাক সেখানে একাধিক মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে। মাদ্রাসায় পড়ার সময় জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ে। তুরস্ক ছাড়াও বিভিন্ন দেশের জঙ্গী ও সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলে। দেশে ফিরে আল কাওসার নামে একটি এনজিও (বেসরকারী সংস্থা) খুলে। আর এ্যাকাউন্ট খুলে ইসলামী ব্যাংক হবিগঞ্জ শাখায়। এনজিও পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের এনজিও ব্যুরো থেকে অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক। মোস্তাক আহমেদ এনজিওটির অনুমোদন নেয়নি। ইসলামী ব্যাংকের এ্যাকাউন্টে বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা আসতে থাকে। মাত্র সাতাইশ বছর বয়সী একটি ছেলের এ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের বিষয়টি প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসে। ব্যাংকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মাত্র ২ বছরে ইসলামী ব্যাংকের হবিগঞ্জ শাখায় প্রায় সাড়ে ৪৮ লাখ টাকা জমা হয়। আর দুই দফায় দেড় কোটি টাকার উপরে উত্তোলিত হয়। এছাড়া ব্র্যাক ব্যাংক বানিয়াচং শাখায়ও অস্বাভাবিক লেনদেন পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রামের হালিশহর ও বন্দরটিলার বিভিন্ন ব্যাংক থেকে মোস্তাকের এ্যাকাউন্টে বিপুল অঙ্কের টাকা জমা হওয়ার তথ্য মিলে। ইসলামী ব্যাংক বানিয়াচং শাখায় মোস্তাক আহম্মেদের মালিকানাধীন এম কে এন্টারপ্রাইজের নামে থাকা এ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক টাকার লেনদেনের তথ্য বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডির অনুসন্ধানে। একই রকম অস্বাভাবিক লেনদেন দেখা যায়, কাউসার মিয়া (২৬) নামের একজনের এ্যাকাউন্টে। কাউসারের পিতার নাম জাহের আলী। বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানাধীন রসুচৌধুরীপাড়া গ্রামে। পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। কাউসারের শাশুড়ি হামিদা খাতুনের (৫৮) ব্যাংক এ্যাকাউন্টেও অস্বাভাবিক লেনদেন ধরা পড়ে। হামিদার স্বামীর নাম ফজলুল কামাল ওরফে পেচু মিয়া। বাড়ি একই গ্রামে। তদন্তে বেরিয়ে আসে কাউসার মিয়া আলোচিত মোস্তাক আহম্মেদ খাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তদন্তে বেরিয়ে আসে, যে সময় টাকাগুলো উত্তোলিত হয়েছে; তখন বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধের নামে সারাদেশে পেট্রোলবোমা হামলা, যানবাহন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চলছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংককে বিষয়টি অবহিত করে। সবচেয়ে বেশি টাকার লেনদেন হয় ২০১৪-১৫ সালে। ওই সময় সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধ-হরতালের মতো কর্মসূচীর নামে দেশকে রীতিমতো সন্ত্রাসের জনপথে পরিণত করেছিল কর্মসূচী আহ্বানকারী ও তাদের দেশী-বিদেশী দোসর এবং জঙ্গীরা। ওই সময় পেট্রোল বোমা মেরে নারী, শিশু, সাধারণ মানুষ, পথচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যার ঘটনা ঘটে। এসব নাশকতামূলক কর্মকান্ডে মোস্তাক অর্থায়ন করে আসছিল বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডির তদন্তে প্রাথমিক তথ্য মিলে। এমন তথ্যের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সিআইডি পুলিশ মোস্তাক আহমেদের ওপর নজরদারি বাড়াতে থাকে। পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে মোস্তাক জঙ্গীবাদে অর্থায়ন করছে। জঙ্গীরা মোস্তাকের কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচীতে নাশকতা চালিয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও মোস্তাক এ ধরনের তথ্য দিয়েছে। ওই সময় বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের সঙ্গে মিশে তাদের সঙ্গে একত্রে ব্যাপক নাশকতা চালিয়েছে জঙ্গীরা। দীর্ঘ তদন্ত শেষে মোস্তাক আহম্মেদ খাঁ, কাউসার মিয়া ও তার শাশুড়ি হামিদা খাতুনের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানায় ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন করার অভিযোগে মামলা হয়েছে। এই তিন জন ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি একই থানায় দায়েরকৃত ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়েরকৃত মামলারও আসামি। যার নম্বর-২। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ইতোপূর্বে পুলিশের হাতে আটক হয়েছিল মোস্তাক। কিন্তু জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকার কোন উপযুক্ত প্রমাণাদি আদালতে দাখিল না হওয়ায় এবং নানা দুর্বলতার কারণে মোস্তাক পরবর্তীতে ছাড়া পেয়ে যান। মোস্তাকের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ব্যাপক দহরম মহরম রয়েছে। মোস্তাকের বিরুদ্ধে একটি দ্রুত বিচার আইনের মামলাসহ মোট ৫টি নাশকতার মামলা রয়েছে। সিআইডির বিশেষ পুলিশ মোল্যা নজরুল ইসলাম আরও জানান, পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাসহ অন্যদের বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে। এর নেপথ্য কারিগরদের শনাক্ত করে স্বল্প সময়ের মধ্যেই আইনের আওতায় আনতে তারা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রায়হানুল হকসহ উর্ধতন সিআইডি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×