ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মার মেসেজ পেয়েই বাবা প্যারোলে যাননি

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৯ আগস্ট ২০১৭

মার মেসেজ পেয়েই বাবা প্যারোলে যাননি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে আমার মায়ের অবদান অনেক। আসলে আমার আব্বা (বঙ্গবন্ধু) মায়ের মতো একজন সাথী পেয়েছিলেন বলেই সংগ্রাম করে তিনি সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। বাবার পাশে থেকে মা যদি ত্যাগ স্বীকার না করতেন তাহলে হয়তো আজকে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম কিনা জানি না। এ জন্যই বোধ হয় আমার মায়ের ওপর আক্রোশ ছিল। আমার মা সারাটা জীবন কষ্ট করে গেলেন। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছেন। তারপর ১৫ আগস্ট ছেলে, ছেলের বউ, স্বামী সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন। ওরা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করলো সবাইকে..।’ তাঁর মা সম্পর্কে স্মৃতিচারণের সময় এটুকু বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন হলভর্তি ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে পিনপতন নীরবতা। তখন অনেকের চোখেও অশ্রু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনে পাশে থেকে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সহযোগিতা ও ত্যাগ, স্বাধীনতা অর্জনে অবদান, ১৫ আগস্টের নির্মমতা কথা স্মৃতিচারণসহ ইতিহাসের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বার বার অশ্রুসিক্ত ও আবেগে বাকরুদ্ধ হতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রীকে। মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনীরা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে জানত। এ কারণে তার ওপরও তাদের আক্রোশ ছিল এবং তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘাতকের দল আমার মায়ের ওপর যেভাবে গুলি চালিয়েছে সেটা কখন ভাবতেও পারিনি। একটা বাড়িতে শুধু নয়, তিনটা বাড়িতে একসঙ্গে আক্রমণ করে। তিনি বলেন, জীবনে সব আশা-আকাক্সক্ষা ও ভোগ বিলাসিতা বিসর্জন দিয়ে বাবার পাশে থেকে থেকে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন আমার মা। বাবার পাশে থেকে মা যদি ত্যাগ স্বীকার না করতেন তাহলে হয়তো আজকে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না। আওয়ামী লীগের সঙ্কটময় মুহূর্তেও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মা বঙ্গমাতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঘাতকচক্র ভীত ছিল, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তাই খুনীরা গৃহবধূ, অন্তঃসত্ত্বা মা, শিশু কাউকে বাঁচতে দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাত করতে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তারপর ঘাতকরা দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টোরথে চড়িয়ে দেয়। দেশবিরোধী সেই ষড়যন্ত্র এখনও অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, আমার মা কোনদিন কিছু চাননি। আমার বাবা মন্ত্রী ছিলেন, এমপি ছিলেন, এমএলএ ছিলেন। জাতীয় পরিষদে অংশগ্রহণ করতে তাঁকে প্রায়ই করাচীতে যেতে হতো। আমার মা কিন্তু কোনদিন ওই পশ্চিম পাকিস্তানে যাননি, যেতেও চাননি। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য সব সময় তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা। যা পৃথিবীতে বিরল। বঙ্গমাতার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তিনি সকলের কাছে তাঁর জন্য দোয়া কামনা করেন তিনি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন- মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান রেবেকা মোমেন এমপি, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী, জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মমতাজ বেগম, মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের পর বাধ্য হয়ে ৬ বছর বিদেশে অবস্থানের পর তার দেশে ফেরা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি যখন বাংলাদেশে ফিরে আসি তখন শুধু একটা জিনিসই চেয়েছি, আমার বাবা তো এই দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। যখন একটু কাজ করি মানুষ একটু ভাল থাকে, তখন আমার ওইটুকু মনে হয় যে হয়তো আমার বাবা-মায়ের আত্মাটা শান্তি পাবে। স্কুল-কলেজের প্রথাগত শিক্ষা অর্জন করতে না পারলেও বেগম মুজিব স্বশিক্ষিত ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার মায়ের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল, নিজে নিজে পড়াশোনা করতেন। আব্বা যখন আসতেন মায়ের জন্য বই নিয়ে আসতেন। পড়ার এবং শেখার অত্যন্ত আগ্রহ ছিল যে কারণেই- সবসময় বই পড়াটা আমাদের একটা অভ্যাসই ছিল। পড়ার বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই পড়- এটা আমাদের বাসাতে একটা প্রথাই ছিল এবং এ বিষয়ে আমার মায়ের সব থেকে বেশি আগ্রহ ছিল। বঙ্গমাতা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁরই বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, তাঁর সম্পর্কে মানুষ খুব সামান্যই জানে। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে ও প্রচারবিমুখ ছিলেন। তাই বঙ্গমাতার অবদান লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গেছে। বেগম মুজিব খুব অল্প বয়সেই মা-বাবাকে হারান। আমার দাদা-দাদির কাছে বেড়ে ওঠার সময় অল্প বয়সে তাঁর মধ্যে সাহস, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা গড়ে উঠেছিল। বঙ্গমাতাকে স্বামী-সংসার অন্তঃপ্রাণ বাঙালী নারী এবং শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তির চেতনায় জাগিয়ে তোলার সংগ্রামে স্বামীর পাশে থাকা সহযোদ্ধা আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, আম্মা অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আব্বাকে সহায়তা করতেন। আম্মা জেলখানায় দেখা করতে গেলে আব্বা তাঁর মাধ্যমেই দলীয় নেতাকর্মীদের খোঁজখবর পেতেন। আব্বার দিকনির্দেশনা আম্মা নেতাকর্মীদের পৌঁছাতেন। আব্বা কারাবন্দী থাকলে সংসারের পাশাপাশি সংগঠন চালানোর অর্থ আম্মা যোগাড় করতেন। বাবার প্রতি কাজেই মা প্রতিবন্ধক নয়, সহায়ক ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ কী চায় তা বোঝা, জনমত সৃষ্টি করার পেছনে মায়ের বিরাট অবদান ছিল। আম্মা চাইলে স্বামীকে সংসারের চার দেয়ালে আবদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কখনও ব্যক্তিগত-পারিবারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি। ফলে আমরা সন্তানরা বঞ্চিত হয়েছি এবং আম্মাকেই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, বাবাকে কখনও টানা দুই বছর আমাদের মাঝে পাইনি। আম্মা মানুষের মুক্তির জন্য আব্বার সংগ্রামী চেতনা বুঝতেন এবং সহযোগিতা করতেন। আব্বাও আম্মার সাহস, মনোবল, ত্যাগ, বিচক্ষণতা, দুঃখ-কষ্ট সব বুঝতেন। আম্মার উৎসাহেই জাতির পিতা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লিখেছিলেন। জাতির এক সন্ধিক্ষণে বেগম মুজিবের একটি সিদ্ধান্ত বাঙালীকে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্যারোলে মুক্তি নিতে চাপ দেয়া হয়। মাকে ভয় দেখানো হয়েছিলÑ‘পাকিস্তানীদের শর্ত না মানলে তিনি বিধবা হবেন’। কিন্তু মা কোন শর্তে মুক্তিতে রাজি হননি। আব্বাও প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তান সরকার আব্বাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, মায়ের মেসেজ ঠিক সময়ে বাবাকে জানাতে পারায় এবং বাবা পাকিস্তানীদের প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সে সময় অনেক আওয়ামী লীগ নেতাই আমাকে বলেন, ‘তুমি কেমন মেয়ে হে, বাবার মুক্তি চাও না।’ তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আম্মার যে মনোবল দেখেছি, তা ছিল কল্পনাতীত। স্বামীকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গেছে। দুই ছেলে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তিন সন্তানসহ তিনি গৃহবন্দী। যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন। এত কিছুর পরও আম্মা মনোবল হারাননি। অসীম সাহস এবং ধৈর্য নিয়ে আম্মা সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। তিনি আল্লাহকে স্মরণ করতেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে বন্দী অবস্থায় আম্মা অধিকাংশ সময় হাতে তসবিহ নিয়ে পড়তেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণও তাঁরই অণুপ্রেরণায় বঙ্গবন্ধু নিজের মন থেকে উৎসারিত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বার বার জেল খাটা এবং তাঁর অবর্তমানে বঙ্গমাতার দল পরিচালনার কথা উল্লেখ করে বলেন, মা বসে থাকেননি, একদিকে বাবার মামলা-মোকদ্দমা চালানো বাড়ি খোঁজা, সংগঠনের নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেয়া। ‘মার্শাল ল’; রাজনীতি নিষিদ্ধ, ওই অবস্থায় বলতে গেলে আওয়ামী লীগের সব নেতা জেলে। যারা জেলে তাদের খোঁজ নেয়া, তাদের মধ্যে অনেকে অসুস্থ ছিলেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া, আর্থিক সহযোগিতা করতেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দলের নেতাকর্মীদের সহযোগিতা করতে গিয়ে বঙ্গমাতা ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করতেন জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো করতে যেয়ে কখনও যেমন আমাদের ফ্রিজটা বিক্রি করে দিলেন, সোফা সেট বিক্রি করে দিলেন, হাতের গহনা বিক্রি করতেন কিন্তু কখনও কোন হা-হুতাশ করতেন না। কেন করতে, আমাদের বলতেন ফ্রিজের পানি খেলে ঠা-া লাগে, ফ্রিজ রাখা ঠিক না, তোমাদের খামাখা সর্দি-কাশি হয়ে যায়। সোফা সেট যেদিন বিক্রি করে দেন বলেন যে এটা ছোট ঘর জায়গা নেই, তাছাড়া এটা পুরনো ডিজাইন, এটা বিক্রি করে দেই। পরে আমরা নতুন একটা কিনবো। আর্থিক অনটনে কখনও কখনও ঘরে বাজার করা হতো না জানিয়ে তাঁর বড় বন্যা বলেন, মা তাদের দেখতে যেতেন, আর্থিক সহযোগিতা করতেন। এভাবে সবাইকে দেখতে গিয়ে অনেক সময় এমন হতো যে বাজারই করতে পারেননি। সেদিন খিচুড়ি রান্না করতেন। আচার দিয়ে আমাদের খেতে দিতেন। বলতেন রোজ রোজ ভাত খেতে কি ভাল লাগে? চল আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাব। তিনি যে বাজার করতে পারছেন না, বাজার করার টাকা নেই- এই কথাটা কখনও বলতেন না। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার কথা তুলে ধরার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এসে আমার মাকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে, ছয় দফা দিয়ে কী হবে? আট দফা হলেই ছয় দফার চাহিদা পূরণ হবে। আমরা মায়ের একটাই কথা ছিল, ‘না ছয় দফা তো, ছয় দফাই। আগরতলা মামলা চলাকালে সরকারবিরোধী তুমুল আন্দোলনের মধ্যে বিরোধী দলসহ সকলের সঙ্গে আলোচনার জন্য আইয়ুব খানের বৈঠকের ডাক এবং বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে ওই বৈঠকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্য আব্বাকে প্যারোলে নিয়ে যাবে। আমাদের প্রায় সব নেতারাই রাজি ছিলেন যে, না আব্বা প্যারোলে যান। কিন্তু আমার মা কখনই এর সঙ্গে একমত ছিলেন না। আমার মনে আছে, মা আমাকে খবর দিলেন, ‘তুমি শীঘ্রই আসো, তোমাকে এক্ষুণি যেতে হবে (ঢাকা সেনানিবাস)। ওখানে প্যারোলে নেয়ার জন্য সবাই অস্থির উদগ্রীব, তোমার আব্বা যেন না যায়। উনি (মা) ডিকটেশন দিলেন, আর মণি ভাই লিখে দিলেন। হয়তো সুযোগ পেলে চিঠিটা দেব, নয়তো মেসেজটা দেব। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘ওখানে গিয়ে যখন দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের বড় বড় নেতারা সবাই কিন্তু ভেতরে। তেজগাঁও এয়ারপোর্ট, সেখানে কিন্তু প্লেন রেডি। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। সেখানে গিয়ে দেখলাম মানিক কাকার (তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া) গাড়ি। সেই গাড়িতে করে আমাদের নেতা তাজউদ্দীন সাহেব (তাজউদ্দীন আহমদ), সালাম খান, ড. কামাল (ড. কামাল হোসেন), আমিরুল ইসলাম (ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম) এরা সকলেই সেখানে উপস্থিত। সঙ্গে আরেকজনও ছিল, সে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতা না হলেও সব সময় সঙ্গে সঙ্গে ঘুর ঘুর করত। সেটা হচ্ছে মওদুদ আহমেদ। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমি কিন্তু গেইটের বাইরে দাঁড়ানো। আমি খুব উসখুস করছি, আব্বা যদি একটু বের হয়, আব্বা যদি জানতে পারে আমি আছি.. আমার উপস্থিতিটা উনি বুঝতে পারবেন; মা কোন মেসেজ দিয়ে পাঠিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আব্বা কথা বলতে বলতে যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন, দেখলেন আমি দাঁড়ানো। উনি হেঁটে বাইরে আসলেন। ওনাকে বাইরে আসতে দিচ্ছে না। আমাকেও ঢুকতে দিচ্ছে না। নিচু কাঠের গেট। কাঠের গেটা একটু ফাঁক করা। ওখান থেকে উনি আমাকে আদর করার জন্য গলাটা জড়িয়ে ধরে বললেন, কোন চিঠি দিস না, তোর মা কি বলেছে বল। আমি শুধু বললাম, মা এখনও প্যারোলে যেতে নিষেধ করেছে, কোন সিদ্ধান্ত নিতে নিষেধ করেছে। উনি ইন্টারভিউয়ের জন্য সময় চেয়েছেন। সময় পেলে উনি আসবেন। মা নিষেধ করেছে যেতে। আপনি কিন্তু যাবেন না। আমাদের নেতারা বোধ হয় এটা খুব একটা ভাল চোখে দেখলেন না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আসার আগেই ওনারা পৌঁছে গেছেন। দেখি নিচতলায় সব নেতারা বসা। তারা মাকে বললেন, আপনি এটা কি করলেন ভাবি। ওনারা বুঝে গিয়েছিল আমি যখন গিয়েছি কোন মেসেজ নিয়ে গেছি এবং আব্বা বেরুবেন না। তখন তারা মাকে বললো আপনি কি জানেন আপনি বিধবা হবেন। মা শুধু বলেন, আমি একা কেন সঙ্গে তো আরও ৩৪ জন আসামি আছে। তাদেরও তো স্ত্রী আছে। বিধবা তো তারাও হবে! তাছাড়া বাংলাদেশের কি হবে? কি হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত, দেশের কথা আগে চিন্তা করেন। আমার কথা চিন্তা করতে হবে না।’ শেখ হাসিনা বলেন, মাকে মানাতে না পারে ওখান থেকে দুই নেতা উঠে এলেন। আমি তখন বারান্দায় দাঁড়ানো। আমীর উল ইসলাম খুব কঠিন ভাষায় আমাকে বললো তুমি কেমন মেয়ে, তুমি চাওনা তোমার আব্বা মুক্তি পাক। আমার নিজেরও খুব রাগ হলো আমি বললাম আমার আব্বা মুক্তি পাবে এবং সম্মানের সঙ্গে মুক্তি পাবে, মাথা উঁচু করে মুক্তি পাবে। আপনারা উল্টাপাল্টা করবেন না।’ তিনি বলেন, ‘এই যে তাঁর (বঙ্গমাতা) দৃঢ় মনোবল, আজকে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি তার প্রতিটি ক্ষেত্রে, আমার বাবার প্রতিটি সিদ্ধান্তে আমার মায়ের যে অবদান সেটাই এখানে প্রতিফলিত হলো। জনগণ কী চায়; তা বোঝা, জনমত সৃষ্টি করার পেছনে মায়ের বিরাট অবদান ছিল।
×