ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টি ইসলাম তারিক

ফুটবল সৌন্দর্যের আরেক নাম নেইমার’

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ৯ আগস্ট ২০১৭

ফুটবল সৌন্দর্যের আরেক  নাম নেইমার’

ফুটপাথ, সমুদ্র সৈকত কিংবা বস্তিতে খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠা। এক সময় বিশ্বসেরা তারকা বনে যাওয়া। দক্ষিণ আমেরিকার সব ফুটবলগ্রেটের ক্ষেত্রেই এর যে কোন একটি প্রযোজ্য। নেইমার দ্য সিলভা সান্তোস জুনিয়রের উত্থানও অন্যসব ফুটবল গ্রেটদের মতোই। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ আর জীবিকার তাগিদে ফুটবলকে ধ্যান-জ্ঞান ও পেশা হিসেবে বেছে নেয়া। যার ফল, নেইমার এখন বিশ্ব ফুটবল মঞ্চের মূল কুশীলব। ছোটবেলায় দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে নেইমারের বাবা ‘সিনিয়র নেইমার দ্য সিলভা’কে। ভাগ্যান্বেষণে ব্রাজিলের মধ্যাঞ্চলের শহর সাও ভিনসেন্ট থেকে ১৯৯২ সালে সাও পাওলোর মগি দাস ক্রুজেস শহরে এসেছিলেন তিনি। মনের কোণে বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন লালন করে জন্মস্থান ছেড়ে এসেছিলেন সিনিয়র নেইমার। কিন্তু পারেননি ভাগ্যের চাকা সচল করতে। তাঁর পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। নিদারুণ ওই দুঃসময়ে সিনিয়র নেইমারের ভালবাসার প্রতীক হিসেবে ঘর আলো করে আসে জুনিয়র নেইমার। এরপর স্বপ্নের পরিধি বেড়ে যায় তার। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা ছেলেকে দিয়ে পূরণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এ কারণে অভাবের সংসার হলেও ছেলেকে এর আঁচ লাগতে দেননি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন উত্তরসূরির চাওয়া পূরণ করতে। ছোট্ট ছেলের প্রতিভা ক্ষুরধার হওয়ায় কাজটাও সহজ জয়। যার প্রমাণ মেলে স্থানীয় ‘পর্তুগীজা সানটিস্টা’ ফুটবলে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। তখনই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, ব্রাজিলের বস্তি থেকে ফুটবিশ্ব শাসন করতে আসছে আরও একজন বিস্ময়বালক। মূলত সাও পাওলোর রাস্তায় ফুটসাল খেলতে খেলতে ফুটবলের সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় সে দিনের ছোট্ট নেইমারের। আর তার পরিণতিটা নিয়মিতভাবে দেখেছে ফটবল দুনিয়া। নেইমারের বিস্ময়কর উত্থানের শুরু ২০০৩ সাল থেকে। ওই বছর তিনি কিশোর প্রতিভা হিসেবে কিংবদন্তি পেলের সাবেক ক্লাব সান্তোসে যোগ দেন। পেশাদার ফুটবলের সঙ্গে তখন থেকেই পরিচিতি ব্রাজিলের বর্তমান স্বপ্নদ্রষ্টার। ফলস্বরূপ অল্প সময়ের মধ্যেই নেইমারের সংসারের অভাব বিতাড়িত হয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের মালিক বনে যায় নেইমারের পরিবার। এরপর প্রত্যাশিতভাবেই নাম লেখান সান্তোসের মূল দলে। ফলাফল কি হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! ধারাবাহিক বিস্ফোরক পারফরমেন্স প্রদর্শন করে নেইমার এখন বর্তমন বিশ্ব ফুটবলের সেরা তারকাদের একজন। সঙ্গতকারণেই অর্থের ঝনঝনানির সঙ্গে নিত্য বসবাস নেইমার ও তার পরিবারের। টগবগে তারুণ্য। এখনই সময় সবকিছু জয় করার। নেইমার তেমনই করে চলেছেন। ফুল হয়ে ফোটার আগেই ছড়িয়ে চলেছেন সুগন্ধ। আর তাতেই বিশ্ব বুদ। ২৫ বছর বয়সী এই প্রাণচাঞ্চল তরুণ ২০১৩ সালে নবম ফিফা কনফেডারেশন্স কাপে আরেকবার চেনান নিজের জাত। বিশ্বের বাঘা বাঘা ফুটবলারদের পেছনে ফেলে আসরের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন। নিজ দেশ ব্রাজিলকে ঐতিহাসিক হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ে কারিগরের ভূমিকা পালন করেন। এসব সম্ভব হয়েছে ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, পায়ের কারুকাজ, মাঝ মাঠে গতির ঝড়, আচমকা আক্রমণে প্রতিপক্ষের রক্ষণকে গুড়িয়ে দেয়ার কারণে। দুর্দান্ত এই পারফরমেন্স দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও ক্ষুরধার হয়েছে। যার প্রমাণ রেখেছেন ক্লাব বার্সিলোনা ও জাতীয় দল ব্রাজিলের হয়ে। সাহসী এই যুবার পারফরমেন্স এমন যে, মনে হয় তিনি একাই এক শ’! সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ক্লাব ফুটবলে লিওনেল মেসির ছায়া থেকে ক্রমশই নিজেকে সরিয়ে আনছেন নেইমার। সম্প্রতি এ বিষয়টা আরও পাকাপোক্ত করেছেন। মেসির ছায়া থেকে বের হয়ে আসতে গত ৩ আগস্ট দলবদলের বিশ্বরেকর্ড গড়ে বার্সা ছেড়ে ফরাসী ক্লাব প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইনে (পিএসজি) যোগ দিয়েছেন। নেইমারের এই দলবদল বিশ্ব ফুটবলের চিত্রই পাল্টে দিয়েছে। এতে বরং সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ ফুটবলের সৌন্দর্যের অপর নাম এখন নেইমার। সেলেসাও তারকা ন্যুক্যাম্পে আসার পর বার্সার সৌন্দর্যও বেড়েছিল। সবাই বলত মেসি-নেইমার-সুয়ারেজ জুটির কথা। সান্তোসে যখন ছিল তখন সেই ক্লাবটারও বাড়তি সৌন্দর্য তৈরি হয়েছিল। টানা দুই বছর আলোচনায় ছিল ব্রাজিলিয়ান ক্লাবটিও। নেইমার একজন সুপারস্টার। সে যেখানে যাবে সেখানে বাড়তি একটা উন্মাদনার যেমন তৈরি হবে তেমনি ক্লাব ফুটবলের সৌন্দর্যটা আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। যদি মেসি আজ ইতালিয়ান কোন ক্লাবে যায় তাহলে একইভাবে সেই ক্লাবের সৌন্দর্য বাড়বে। এখন বার্সার সৌন্দর্য মেসি। সে না থাকলে বার্সার খেলা দেখবে ক’জন! যেমন কিংবদন্তি দিয়াগো ম্যারাডোনা যখন নেপোলিতে খেলত তখন সেই ক্লাবটি ছিল আলোচনায়। এখনও পর্যন্ত নেপোলির আলোচনা আসলেই ম্যারাডোনার কথা চলে আসে। একইভাবে ডেভিড বেকহ্যাম, রোনাল্ডিনহো, রোনাল্ডো, রবার্তো কালোর্সরা যখন যেখানে খেলেছেন নিশ্চিতভাবেই সেখানে ফুটবলের বাড়তি উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। এসবই সৌন্দর্য। ফুটবলের এই সৌন্দর্য, সৌরভ এখন ছড়িয়ে পড়েছে ফরাসী ফুটবলে; সর্বোপরি বিশ্ব ফুটবলে। বিশ্বরেকর্ড গড়া ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরো (২২২ মিলিয়ন ইউরো) ট্রান্সফার ফিতে নেইমারের আলোচিত দলবদল সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৬ সালের আগস্টে ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাস থেকে পল পোগবাকে সাড়ে ১০ কোটি ইউরো দিয়ে কিনেছিল ইংলিশ পরাশক্তি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। সেটাই ছিল ট্রান্সফার ফির আগের বিশ্বরেকর্ড। ফরাসী ফরোয়ার্ড পোগবার দলবদল প্রথম ১০০ মিলিয়নের ঘর ছুঁয়েছিল। আর সেটাই এখন পার হয়ে গেছে ২০০ মিলিয়নের ঘর। যদিও সব মিলিয়ে এই দলবদলের আসল আকার গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ৫০০ মিলিয়নে। পিএসজির সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন নেইমার। সব মিলিয়ে এ পাঁচ বছরে নেইমারের পেছনে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ইউরো (৪৫ কোটি পাউন্ড) খরচ হবে পিএসজির। এর মধ্যে আছে নেইমারের রিলিজ ক্লজ মূল্য, পারিশ্রমিক ও বোনাস। নেইমারের রিলিজ ক্লজ মূল্য ১৯ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড (২২ কোটি ২০ লাখ ইউরো)। প্যারিসের ক্লাবটিতে বছরে ২ কোটি ৬৮ লাখ পাউন্ড (৩ কোটি ইউরো) পারিশ্রমিক পাবেন। অর্থাৎ পাঁচ বছরে নেইমারকে ১৫ কোটি ইউরো পারিশ্রমিক দিতে হবে পিএসজিকে। এটা অবশ্য কর পরিশোধের পর। এমনিতে নেইমারের সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক দাঁড়াচ্ছে ৫ লাখ ১৫ হাজার পাউন্ড। এ ছাড়াও ব্রাজিলিয়ান তাকরার ট্রান্সফার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সহায়তা করায় তাঁর বাবা নেইমার সিনিয়র ও নেইমারের ইসরাইলি এজেন্ট পিনি জাহাভিকে ৩ কোটি ৮০ লাখ ইউরো দেবে পিএসজি। সব মিলিয়ে তাই পাঁচ বছরের এই চুক্তিটার আকার হয়ে যাচ্ছে ৫০০ মিলিয়ন। অবশ্য এর বেশির ভাগটাই নেইমার পাবেন না। তবে তাঁর নিজস্ব আয়ও কম হচ্ছে না। পিএসজিতে প্রতি সেকেন্ডে ৮৮ পেন্স আয় করবেন নেইমার। তার মানে, পিএসজিতে প্রতি মিনিটে তার আয়ের অঙ্কটা দাঁড়াচ্ছে ৫৩ পাউন্ডের কিছু বেশি, ঘণ্টায় ৩,১৯৭.৪৪ পাউন্ড এবং দিনে ৭৬,৭৩৮.৫৭ পাউন্ড। প্রতি দিন বাংলাদেশি মুদ্রায় নেইমারের আয় হবে নাকি প্রায় ৮২ লাখ টাকা!! ন্যূক্যাম্প ছাড়ার পর নেইমার বলেন, বার্সিলোনা ছিল একটি চ্যালেঞ্জের চেয়ে বেশি কিছু। এটা ছিল একটি শিশুর স্বপ্ন যে কি-না ওইসব তারকার সঙ্গে ভিডিও গেমের মাধ্যমে খেলেছে। কাতালানদের হয়ে চার বছর খেলা সেলেসাও তারকা বলেন, আমি পিএসজিতে যোগ দিতে পেরে খুবই খুশি। আমি ইউরোপে আসার পর থেকে ক্লাবটি সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক ও সবচেয়ে উচ্চাকাক্সিক্ষ ক্লাবগুলো মধ্যে আছে। আর আমাকে এখানে নতুন সতীর্থদের সঙ্গে যোগ দিতে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি যা হলো ক্লাবকে এমন শিরোপা জেতানো যা তাদের সমর্থকরা চায়। নেইমার বলেন, পিএসজির তীব্র আকাক্সক্ষা আমাকে এই ক্লাবের দিকে আকর্ষণ করেছে। আমি চার মৌসুম ইউরোপে খেলেছি। আমি মনে করি, আমি এখন চ্যালেঞ্জটা নিতে প্রস্তুত। পিএসজির সতীর্থদের সঙ্গে খেলতে যেন তর সইছে না। এ প্রসঙ্গে বলেন, আমার নতুন সতীর্থদের সহায়তা করতে, আমার ক্লাবের জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা করতে এবং বিশ্বজুড়ে লাখ-লাখ সমর্থকদের আনন্দ দিতে আজ থেকে আমি আমার সম্ভাব্য সব কিছু করব। দলবদলের পর শুক্রবার প্যারিসে গেছেন নেইমার। সেখানে পিএসজির সমর্থক, সংগঠক, ফুটবলাররা ব্রাজিলিয়ান তারকাকে ভালবাসায় বরণ করে নেন। এখয় ময়দানী লড়াইয়ে ঝড় তোলার অপেক্ষা।
×