ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পিইডিপি-৩-এর;###;কেনাকাটা নিয়ে তোলপাড় ॥ সর্বনিম্ন দরদাতার কাজ না পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও অনিয়ম হয়নি- দাবি অধিদফতর কর্মকর্তাদের

৮৫ কোটি টাকার দরপত্রে ২০ কোটি গচ্চার শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৮ আগস্ট ২০১৭

৮৫ কোটি টাকার দরপত্রে ২০ কোটি গচ্চার শঙ্কা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচীর (পিইডিপি-৩) স্কুলে শিশুদের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটায় ৮৫ কোটি টাকার দরপত্রে সরকারের ২০ কোটি টাকা গচ্চা দেয়ার আয়োজন চলছে। অনিয়ম করতে সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা বেশি দরে হলেও অন্য দরদাতাকে কাজ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের শিশুদের শিক্ষার মানোন্নয়ন কর্মসূচীর এ অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সর্বনিম্ন দরদাতা থেকে শুরু করে দরপত্রে অংশ নেয়া নামী-নামী প্রতিষ্ঠান অনিয়মের অভিযোগ তুলে কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা দাবি করেছে। সর্বনিম্ন দরদাতার কাজ না পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও এখানে কোন অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, আরএফএল প্লাস্টিকস কোম্পানি সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও তারা কাজ পাচ্ছে না। দরপত্র বাছাই কমিটি ঠিক করেছে কারা কাজ পাবে আর কারা পাবে না। সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও আরএফএল প্লাস্টিকস অন্যান্য শর্ত পূরণ করতে পারেনি বলে কাজ দেয়া হচ্ছে না বলে বলছেন কর্মকর্তারা। জানা গেছে,উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচীতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করেছে সরকার। এর আগে এ কর্মসূচীতে কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থ প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘটনাও আছে। তবে তারপরও কাজের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসেনি বলে অভিযোগ। থেমে নেই অনিয়ম। সম্প্রতি এই কর্মসূচীর আওতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুলে টেবিল, চেয়ার ও বেঞ্চ (উঁচু ও নিচু) সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে গত বছর ৩০ নবেম্বর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর। পরবর্তীতে টেন্ডারের মেয়াদ আবার ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ওই দরপত্রে দেশের স্বনামধন্য ১৪ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্রকল্পের আওতায় জিডি ৫১৬ নাম্বার টেন্ডারে আটটি লটে (ধাপে) কার্যক্রম সম্পাদন হবে। তবে অভিযোগ উঠেছে, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিতে কারসাজি শুরু করেছে অধিদফতরের একটি চক্র। যাদের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে বহুবার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এবার এ কাজের টেন্ডার ওপেনের পর ৬ মাস অতিক্রম হলেও পরবর্তী কার্যক্রম প্রক্রিয়া থেকে ছিল। এখন হঠাৎ করে সর্বনিম্ন দরদাতা আরএফএল প্লাস্টিকস কোম্পানিকে কাজ না দিয়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় সারির সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে। অথচ দ্বিতীয়, তৃতীয় বা অন্য কাউকে কাজ দিলে ৮৫ কোটি টাকার এই টেন্ডারেই সরকারের গচ্চা দিতে হবে ২০ কোটি টাকারও বেশি। কেবল তাই নয়, এতে এক দিকে যেমন সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে, তেমনি প্রাথমিকের কোমলমতি শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ থেকে। দরপত্র নির্বাচক কমিটিসহ অধিদফতরের একটি চক্র ও মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এই অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দরপত্র নির্বাচন কমিটির সাবেক সভাপতি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিকল্পনা শাখার পরিচালক আব্দুর রউফ অবশ্য দাবি করেছেন, আমরা নিয়ম মেনেই কাজ করছি। এখানে কাউকে কাজ পাইয়ে দেয়ার কোন প্রক্রিয়া আমরা গ্রহণ করিনি। প্রভাবিত হয়ে কাউকে কাজ পাইয়ে দেয়ারও কিছু নেই। নিয়মানুয়ায়ী সব কাজ হচ্ছে। ২০ কোটি বেশি টাকা দিয়ে হলেও সর্বনিম্ন দরদাতাকে কেন বাদ দিতে হচ্ছে? তাদের অযোগ্যতার বিষয়টি আসলে কোথায়? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ২০ কোটি টাকা মূল কথা না। যারা নিয়মনীতি মেনে টেন্ডার জমা দিয়েছে, তাদেরই কাজ দেয়ার জন্য বিবেচনায় আনা হয়েছে। তারা সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও অন্যান্য শর্ত পূরণ করতে পারেনি। টেন্ডার বাছাই কমিটি সকল কিছু দেখে ঠিক করছে। জানা গেছে, দরপত্র নির্বাচক কমিটিতে রয়েছেন সাত সদস্য। তার মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের অর্থ, পরিকল্পনা ও প্রশাসন বিভাগের তিন পরিচালক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক সহকারী অধ্যাপক এবং এলজিইডির দুই প্রকৌশলী রয়েছেন। কমিটির প্রধান অর্থ বিভাগের পরিচালক মহেশ চন্দ্র রায়ের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে অপর দুই সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ নিয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বিদেশ যাওয়ার দিন অবশ্য বলেছিলেন, কমিটির সদস্যরা আমাকে রিপোর্ট দিয়েছে। সেখানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। নিম্ন দরদাতাকে বাদ দেয়া হয়েছে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শর্ত পূরণ না হওয়ায় নিম্ন দরদাতা কোম্পানিকে বাতিল করা হয়েছে বলে জেনেছি। ২০১১ সালের শেষদিকে পিইডিপি-৩ কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণ ও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বাড়াতে নেয়া কর্মসূচীর ব্যয় ধরা হয় ২২ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নের শুরুতেই বিশ্বব্যাংক ৩০ কোটি ডলার বা ২৪শ’ কোটি টাকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৩২ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা ঋণ দেয়। প্রকল্পটিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যের ডিএফআইডি, সুইডিশ সিডা, কানাডিয়ান সিডা, জাপানের জাইকা, ইউনিসেফ ও অজ-এইডসহ ১০ দেশ ও দাতা সংস্থা আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।
×