ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গড়ে তোলা সম্ভব পাখির অভয়ারণ্য

পাহাড়ে বাসা শালিক চড়ুই বাতাসী সুঁইচোরার- পর্যটনের সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৮ আগস্ট ২০১৭

পাহাড়ে বাসা শালিক চড়ুই বাতাসী সুঁইচোরার- পর্যটনের সম্ভাবনা

এইচ এম এরশাদ ॥ কক্সবাজার শহরের কলাতলী মোড় থেকে প্রায় আড়াই কিমি দক্ষিণে মেরিন ড্রাইভ ও সমুদ্র সৈকতসংলগ্ন দরিয়া নগরের পরিত্যক্ত বিশাল পাহাড়ের বড়ছড়া খালের উত্তর পাশ থেকে শুকনাছড়ি পর্যন্ত প্রায় ১০ একর এলাকাজুড়ে অবস্থিত। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এ পাহাড়ে রয়েছে ঘন বাঁশবন ও সেগুন বাগান ছাড়াও নানা প্রজাতির বৃক্ষ ও গুল্মের সমাহার। প্রতিবছর প্রজনন মৌসুম উপলক্ষে বংশবৃদ্ধি ঘটাতে ওই পাহাড়ে খাড়া ঢালে গর্ত খুঁড়ে বাসা বাঁধে দুই প্রজাতির শালিক, সুঁইচোরা, স্পটেট কিংস ফিশার বা মাছরাঙা, চড়–ই ও বাতাসী পাখির দল। পরে বাচ্চা বড় হলে তারা অন্যত্র চলে যায়। সারাবছরই কোন না কোন পাখি এসে এ পাহাড়ের গায়ে গর্ত খুঁড়ে বাচ্চা ফোটায়। চলতি প্রজনন মৌসুম উপলক্ষেও গত দুই মাসে অন্তত ৩ সহস্রাধিক পাখি বাচ্চা ফুটিয়েছে। একদল পাখি বাচ্চা ফোটানোর পর আসে অন্য দল। এভাবে সারাবছর নানা পাখির কলকাকলীতে মুখরিত থাকে পাহাড়টি। বিষয়টি পর্যটকদের বেশ দৃষ্টি কাড়ে। এরই টানে এ বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাখিপ্রেমীরা এখানে এসে ভিড় করেছে। ফলে পাখিপ্রেমীদের জন্য পাহাড়টি একটি বাড়তি বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো একটি পাখির অভয়ারণ্য হচ্ছে দরিয়া নগরে। অভয়ারণ্যটি প্রতিষ্ঠিত হলে দেশ ও বিদেশের প্রকৃতিপ্রেমীরা এখানে এসে ভিড় করবে। এমনকি এখানকার পাখির দৃশ্য বিশ্বব্যাপী প্রচার হবে। অভিজ্ঞজনরা বলেন, সমুদ্র তীরবর্তী মেরিন ড্রাইভ সড়কসংলগ্ন এ দরিয়া নগর গ্রামটি পাহাড়, নদী ও সাগরের মিলনকেন্দ্র। এ কারণে দরিয়া নগরকে কক্সবাজারের ভূস্বর্গ হিসেবেও ধরা হয়। পাখি ছাড়াও এ পাহাড়ে বাস করে বন্য বানরের একাধিক দল। আর এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যম-িত ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ পাহাড়টিকে কেন্দ্র করে একটি ‘পাখির অভয়ারণ্য’ কাম পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। আর এতেই পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও পরিবেশবাদীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন আরও জানান, পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন করার লক্ষ্য বর্তমান সরকারের। এরই জের ধরে জেলা প্রশাসন এমন উদ্যোগ নিয়েছে। বিদেশী কয়েকটি সংস্থা এতে অর্থ সংস্থানে সম্মত হয়েছে। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে একটি নতুনমাত্রা যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক বলেন, পাখির অভয়ারণ্য বা বানরের পাহাড়ের জীববৈচিত্রের অভিন্ন অংশ হিসেবে চিহ্নিত আশপাশের ছড়াসহ নিচু জমিও এ অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দরিয়ানগরে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এখানে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ব্রিজ নির্মাণ ও বিদ্যুতায়নের পাশাপাশি একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস স্থাপন করছে সরকার। ইতোমধ্যে ওই ক্যাম্পাসের কারণে এলাকার রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এলাকার দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। এক সময় দরিয়ানগরে যাতায়াতের জন্য একটি ইটবিছানো রাস্তাও ছিল না। ১৯৯৯ সালে দরিয়ানগর বড়ছড়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একটি আশ্রয়ণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। যেই দুর্গম দরিয়ানগরে এখন দামী গাড়ি চলতে শুরু করেছে। কক্সবাজারের বিশিষ্ট পরিবেশকর্মী আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, সমুদ্র তীরবর্তী এ পাহাড়টি বানরসহ বিভিন্ন পাখির বিচরণ ক্ষেত্র হওয়ায় তা সংরক্ষণের জন্য সবাই দাবি জানিয়ে আসছিল। আর প্রশাসন এ দাবি মেনে নিয়ে কক্সবাজারের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। প্রকল্পটি দ্রুত যাতে আলোর মুখ দেখে এ জন্য এনজিও কর্মকর্তা আবু মোর্শেদ চৌধুরী দাতা সংস্থাগুলোর কাছে বেশ দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্থা ওই প্রকল্পে অর্থ সংস্থানে সম্মত হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পাখির অভয়ারণ্য কাম পর্যটন কেন্দ্রটি পর্যটকদের জন্য হবে বাড়তি আকর্ষণ। পাখির নির্বিঘœ প্রজননের জন্য ওই পাহাড়ের চারদিকে ঘেরাবেড়া দিয়ে সংরক্ষণ করা হবে। এখানে পাখি দেখার জন্য বিশেষ ঘর, ওয়াচ টাওয়ারসহ আধুনিক নানা সুযোগ-সুবিধাও তৈরি করা হবে। এদিকে গ্রামবাসীর মতে, প্রায় ২৪ বছর আগে শহর ও সাগর পাড়ের উচ্ছেদকৃত চার শতাধিক পরিবারকে দরিয়ানগর বড়ছড়া এলাকায় পুনর্বাসনের পর ’৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী ৮০টি পরিবারকে নিয়ে আশ্রায়ণ প্রকল্প নির্মাণ করেন। এরপর এতদিন সেখানে কোন রাস্তাঘাট তৈরি বা উন্নয়ন করা হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় আসার পর গত চার-পাঁচ বছরে এখানে একটি ব্রিজ, একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনসহ গ্রামে বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি দুই বছর আগে একটি ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসও প্রতিষ্ঠা করেন। সমুদ্রসীমা বিজয়ের ফসল ঘরে তুলতে দেশের সমুদ্র সম্পর্কিত অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমি জোরদারে সরকারের যে পরিকল্পনা, তারই অংশ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে ক্যাম্পাসটি। এ ক্যাম্পাসের সুফল এখনই ভোগ করতে শুরু করেছে এলাকাবাসী। ইতোমধ্যে এলাকায় নতুন ও উন্নতমানের রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। কক্সবাজার শহরতলির দরিয়ানগরে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে চলাচলের পাকা রাস্তা নির্মাণ করছে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ওই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অধ্যয়ন ও গবেষণার কাজে আসা দেশী-বিদেশী শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য আরও প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছেÑ একটি ডরমিটরি। ইতোমধ্যে ওই উন্নয়ন কাজের জন্য ঠিকাদার নির্বাচনের পর কার্যাদেশও দেয়া হয়েছে। শহরতলির দরিয়ানগরে বানরের পাহাড়কে কেন্দ্র করে একটি পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা সম্ভব হলে পর্যটনের জন্য নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো এ ধরনের উদ্যোগকে জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন এ বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাজী আবদুর রহমানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাজী আবদুর রহমান (উপ-সচিব) জানান, পাখির অভয়ারণ্য দরিয়ানগর পাহাড়টি হবে অত্যন্ত উপযুক্ত। ইতোমধ্যে এ অভয়রাণ্যের জন্য জমির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বিদেশী কয়েকটি সংস্থার সাহায্য চাওয়া হয়েছে। প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেছে। ফলে প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
×