ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষিত মেয়েকে সেফহোমে মাকে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখার নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৮ আগস্ট ২০১৭

ধর্ষিত মেয়েকে সেফহোমে মাকে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখার নির্দেশ

সমুদ্র হক/মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া থেকে ॥ ধর্ষিতা মেয়ে ও তার নির্যাতিতা মাকে ভর্তির ১১ দিন পর সোমবার দুপুরে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের ২৯ নম্বর কেবিন থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। তার আগে হাসপাতালে তাদের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। বিভাগীয় প্রধান বলেছেন, মেয়ে ও মা এখন সুস্থ। শারীরিক ক্ষত সেরে উঠছে। তবে মানসিক ক্ষত সারতে কিছুটা সময় লাগবে। এটা নির্ভর করছে দিনে দিনে মেয়েটি ঘটনা ভুলে কতটা স্বাভাবিক হতে পারে। এরপরই বেলা পৌনে দু’টার দিকে মেয়ে ও মাকে পুলিশী নিরাপত্তায় অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ-১ ও শিশু আদালতে হাজির করে তাদের নিরাপত্তা বিধানে আদালতের কাছে আবেদন জানায় পুলিশ। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আদালতের বিচারক মোঃ ইমদাদুল হক সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে ধর্ষিতা তরুণীকে রাজশাহী সেফহোমে এবং মেয়ের নির্যাতিতা মাকে (যিনি এ মামলার বাদী) কোন ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখার আদেশ দেন। এর আগে আদালত মেয়ে ও মায়ের কাছে জানতে চায় কোথায় তারা থাকতে চান। মেয়ে এ সময় আদালতকে জানায় রাজশাহীতে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতে চায়। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষ আদালতকে জানায় মেয়ের মা এ মামলার বাদী। তাদের নিরাপত্তা নেই। আদালত তখন মেয়ের বাবাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিজের হেফাজতে রাখতে চান কি না। এ সময় মেয়ের বাবা আদালতকে জানান তিনি নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন। এ অবস্থায় তিনি নিজের হেফাজতে না রাখার মত প্রকাশ করে বলেন এ ঘটনার অভিযুক্তদের তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। আদালতের নির্দেশের পর বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্ত্তী জানান, যত দ্রুত সম্ভব সোমবারের মধ্যেই আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ধর্ষিতা মেয়েকে রাজশাহী সেফহোমে এবং মেয়ের মাকে ঢাকা অথবা রাজশাহী যেখানে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার আছে সেখানে রেখে আসা হবে। দুশ্চিন্তা তাদের গ্রাস করে ফেলেছে ধর্ষিতা মেয়েটি এখন বলছে ‘আগে এতটা বুঝিনি। কোন এক পশুর কাছে গিয়েছিলাম। আমার জীবনের এখন কি হবে! এখন না হয় পুলিশ নিরাপত্তা দিচ্ছে। পুলিশী নিরাপত্তা যখন উঠে যাবে কি হবে তখন!’ নানা দুশ্চিন্তার কড়াল গ্রাসের মধ্যে পড়েছে মেয়ে ও তার মা। হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের কেবিনে তারা প্রথম দিকে ক্ষণে ক্ষণে আঁতকে উঠেছে। বীভৎস দৃশ্যগুলো মেয়েকে তাড়া করে ফেরে। মা ও মেয়ে ভুলতেই পারছে না নারী কি ভাবে নিজেরা ও সন্ত্রাসী দিয়ে আমানুষিক নির্যাতন করতে পারে। তাদের শরীরের ক্ষত একদিন শুকিয়ে যাবে। মেয়েটির জীবন শুরু হতে না হতেই মনের মধ্যে ক্ষতের যে দাগ যে রেখা চিহ্ন তৈরি হলো তা জীবনভর বয়ে বেড়াতে হবে। আতঙ্কিত দিনলিপি এখন তাদের সামনে। কি হবে সামনের দিনগুলোতে, এমন ভাবনাও তাদের তাড়া করছে। মেয়ের লালিত স্বপ্ন কি পূরণ হবে। মেয়েটি বারবার বলছে সে লেখাপড়া করে বড় হতে চায়। তুফান পাকা অভিনেতা ও কৌশলী পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তুফান সরাসরি ঘটনার কথা স্বীকার করেনি। যা বলেছে তা পরোক্ষভাবে বলা। যে কারণে তাকে তিন দফায় পুলিশী রিমান্ডে নেয়া হয়। তারপরও পুলিশ সদুত্তর পায়নি। সূত্র জানায় তুফানের স্বীকরোক্তি না পাওয়া গেলেও এজাহারভুক্ত অভিযুক্ত তুফানের সহযোগী ক্যাডার সন্ত্রাসী আতিক ও মুন্না এবং এজাহারবহির্ভূত অভিযুক্ত নরসুন্দর (নাপিত) জীবন আদালতে ১৬৪ ধারায় যে জবানবন্দী দিয়েছে তাতে সম্পূর্ণ বিষয় পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। এর আগে ধর্ষিতা তরুণী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় আদালতে জবানবন্দী দেয়। পুলিশ এখন আদালতের আদেশে তুফানকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। সূত্র জানিয়েছে ঘটনার যে তথ্য উপাত্ত, আলামত, জবানবন্দী এবং সাক্ষ্য প্রমাণ পুলিশের হাতে আছে তা মামলার চার্জশীট দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এদিকে তুফান যে পাকা অভিনেতা তার নমুনা পরিষ্কার দেখা গেছে আদালত চত্বরে। রবিবার বিকেলে তুফানকে যখন আদালতে হাজিরের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তখন পুলিশের দুই সদস্যের কাঁধে ভর দিয়ে কষ্টের ছাপের অভিব্যক্তিতে বারান্দা দিয়ে হাঁটে। এর কিছু পরই তুফানকে প্রিজন ভ্যানে তুলে জেলহাজতে নিয়ে যাওয়ার সময় তুফানকে এতটাই স্বাচ্ছন্দ্য দেখায় যে সে স্বাভাবিকভাবে দ্রুত হেঁটে যায়। এ সময় তুফান পুলিশের সামনেই তার সহযোগীদের উচ্চস্বরে কথা বলে। একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরা তা স্পষ্ট দেখা গিয়েছে। যা ওই টিভি চ্যানেলে প্রচারিতও হয়। তুফানের স্ত্রী জ্যাঠাস ও শাশুড়ি দুর্ধর্ষ প্রকৃতির বগুড়ার এ ঘটনার পর তুফানের স্ত্রী আশা, জ্যাঠাস পৌরসভার নারী কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকি ও তাদের মা রুমী খাতুন কতটা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির তার এখন লোকমুখে ফিরছে। একই সঙ্গে তুফানের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা কি ভাবে নগরীতে ত্রাস সৃষ্টি করত তাও বেরিয়ে আসছে। সোমবার রিক্সা, ব্যাটারি চালিত রিক্সা ও ইজিবাইকের কয়েকজন চালক বললেন, এখন তাদের কোন চাঁদা দিতে হচ্ছে না। একজন রিক্সা চালক বললেন ‘তুফানের যে কি ব্যার ব্যারে গেছিল তা যারা দেখেনি তারা কিচ্চুই বুঝবি ন্য। শহরের প্রত্যেক জাগাত মোটা লাঠি হাতত নিয়ে দাঁড়্যে থাকিচ্চিল। ট্যাকা না দিলেই কোবাচ্চিল (তুফান যে কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল না দেখলে তা বোঝা যাবে না। নগরীর প্রতিটি পয়েন্টেই তুফানের সন্ত্রাসীরা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকত। চাঁদা না দিলেই পিটাত)।’ কয়েক রিক্সাচালক বললেন ‘তুফান ফির ছাড়া পায়া তো ব্যার হয়া আসবি ন্য (তুফান ফের ছাড়া পেয়ে তো বের হয়ে আসবে না)।’ এলাকার লোকজন বলছেন তুফানের জ্যাঠাস পৌর নারী কাউন্সিলর চাঁদা আদায়ারে জন্য যখন যা মনে আসত তাই করত। কখনও চাঁদার জন্য অন্যের বাড়িতে তালা ঝুলিয়েছে। তার অত্যাচার অতিষ্ঠ হয়ে অনেকে ঘর ছেড়ে চলেও গেছে। রুমকি নিজের বাড়িতে বিচার সালিশ করত। সেখানে নিজেই নির্যাতন চালাত। এই কাজে তার সঙ্গে থাকত তার বোন আশা ও তাদের মা রুমী খাতুন। রুমকির মা এসব বিষয়ে কোনই প্রতিবাদ করত না। উল্টো মেয়েদর সমর্থন দিতো। তুফান ও তার ক্যাডাররা যেমন ছিল ত্রাস, একই ভাবে রুমকি আশা ও তাদের মাও ছিল ত্রাস। তারা অনেক সময় তুফানের ক্যাডার নিয়েও চলাফেরা করত। রুমকি ও আশার নির্দেশে তুফানের ক্যাডাররা ধর্ষিতা মেয়ে ও মাকে অপহরণে করে রুমকির বাড়িতে নিয়ে যায়। রুমকির নির্দেশে তুফানের তিন ক্যাডার মেয়ে ও মাকে নির্যাতন করে। বগুড়ার আকাশে টাকার গন্ধ বগুড়া নগরীজুড়ে আলোচনা তুফান তার ভাইদের ক্যাডার ও সহযোগীরা বিভিন্ন মহলে ঘটনা ধামাচাপা দিতে এবং ঘটনা অন্য খাতে নিয়ে যেতে বহু অংকের টাকা ছড়াচ্ছে। এই অর্থ ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। মিডিয়ারও হাতেগোনা কয়েকজন অতি সুক্ষè কৌশলে তুফানের ধর্ষণের ঘটনা আড়াল করে বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ধর্ষণকে কৌশলে ‘মিউচুয়াল সেক্স’ বলে প্রচারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ বিষয়ে একাধিক সূত্র জানায়, ধর্ষিতার মেডিক্যাল পরীক্ষার সব রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত ও প্রমাণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্ষিতা নিজেও আদালতের কাছে জবানবন্দী দিয়েছে। একই সূত্র জানায় এখন ‘ধর্ষণ হয়নি অন্য কিছু হয়েছে’ এমন কথা বলে পার পাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থই হবে। যারা এই কথা বলছে তারা ‘কোন দৃষ্টিকোণ থেকে কিভাবে এবং কেন’ এই কথা বলছে তাও বগুড়ার লোকজন বুঝে গিয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে তারা এখন ঘৃণিত। তাদের নাম শুনলেই লোকজন ছিঃ ছিঃ করছে। বলাবলি তুফান গংরা নিজেদের কুকীর্তি ঢাকতে কত টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের কাছে কত বড় ধামা আছে যা দিয়ে চাপা রাখবে। একজন সুধীজন বললেন প্রবাদের ‘ধামাচাপা’ অর্থ যাই থাক ধামার একটা নির্দিষ্ট মাপ আছে। এর বাইরে ধামা কিছু কিছু চাপা দিতে পারে না। তুফান গংরাও তা পারবে না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। আইন চায় তথ্য প্রমাণ। সেই প্রমাণ এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের কাছে আছে।
×