ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বিভাগের প্রতিবেদন

অর্ধেক ব্যাংকই ঝুঁকির মুখে

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৮ আগস্ট ২০১৭

অর্ধেক ব্যাংকই ঝুঁকির মুখে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের ব্যাংকগুলোর মূলধনে আঘাত হেনেছে খেলাপী ঋণ। বড় গ্রাহকদের প্রতি ব্যাংকগুলো বেশি ঝুঁকে পড়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। তারা মনে করছেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে বড় অঙ্কের ঋণগুলো আছে বেশি ঝুঁকিতে। দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংক মূলধন হারিয়ে দেউলিয়ার পথে হাঁটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। খেলাপী ঋণের প্রভাবে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশের ব্যাংকিং খাত। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন ব্যাংকের মূলধনও ভাঙতে হচ্ছে। মূলত যথাসময়ে ঋণ ফিরে না আসায় এমন বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের ৫৬টি ব্যাংক থেকে পাওয়া ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বিভাগ। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বড় গ্রাহকদের প্রতি ব্যাংকগুলো বেশি ঝুঁকে পড়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এখন বিষয়টির দ্রুত পর্যালোচনা শুরু করেছে। আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোর মূলধনে আঘাত হেনেছে খেলাপী ঋণ। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর মূলধনের ৭৪ শতাংশই পরিণত হয় খেলাপীতে। ওই সময়ে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। তখন ব্যাংকগুলোর মূলধনের পরিমাণ ছিল ৮৩ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে একই সময়ে মূলধনের ৬০ শতাংশ ছিল খেলাপী। চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা মূলধনের প্রায় ৮০ শতাংশ। প্রতিবেদনটির মোড়ক উন্মোচনের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির বলেছেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে বড় অঙ্কের ঋণগুলো আছে বেশি ঝুঁকিতে। তাই আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে ও খেলাপী ঋণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে বড় ঋণ দেয়ার হার কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য বড় আকারের ঋণ না দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করতে হবে।’ এদিকে মূলধন হারিয়ে সরকারের কাছে দ্বারস্থ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা ব্যাংকগুলো। জনগণের করের টাকা দিয়ে এসব ব্যাংককে রক্ষার চেষ্টা করছে সরকার। ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’ নামে ব্যাংকগুলোতে ইতোমধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে বড় গ্রাহকদের প্রতি আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। শুধু তিনজন শীর্ষ গ্রাহকের কাছে নিজেদের ভাগ্য সঁপে দিয়েছে দেশের ২৩টি ব্যাংক। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, শীর্ষ ১০ জন গ্রাহক খেলাপী হলে ৩৭টি ব্যাংক এবং তিনজন গ্রাহক খেলাপী হলে ২৩টি ব্যাংক ঝুঁকিভারিত সম্পদের বিপরীতে মূলধন (সিআরএআর) সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। এছাড়া সাতজন খেলাপী হলে মূলধন হারাবে ৩৩টি ব্যাংক। এসব কারণে মূলধন হারিয়ে দেউলিয়ার পথে হাঁটবে দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘ব্যাংকগুলো ডোবানোর জন্য মূলত অসৎ কর্মকর্তা ও গ্রাহকরাই দায়ী। কারণ তারা অসৎ গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। ১০০ জন ছোট উদ্যোক্তা খেলাপী হলে একটি ব্যাংক যতটুকু ঝুঁকিতে পড়ে, একজন বড় গ্রাহক খেলাপী হলে তারচেয়েও বেশি ঝুঁকিতে পড়ে।’ জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের মোট ঋণের ৫২ শতাংশ নিয়েছে ১২টি শিল্প গ্রুপ। এগুলো ব্যাংকটি থেকে ১৯ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এছাড়া জনতা ব্যাংক থেকে ১২টি গ্রুপের ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৯ শতাংশ। আর অগ্রণী ব্যাংকের দেয়া মোট ঋণের ২৩ শতাংশই নিয়েছে ১৩টি শিল্প গ্রুপ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে- খেলাপী ঋণ ৩ শতাংশ বাড়লে পাঁচটি ব্যাংক, ৯ শতাংশ বাড়লে ২৭টি ব্যাংক এবং ১৫ শতাংশ বাড়লে ৩৫টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়বে। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপী ঋণের মধ্যে ৩২ হাজার ১৮১ কোটি টাকা পাঁচটি ব্যাংকে রয়েছে বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে। এ পরিমাণ খেলাপী ব্যাংক খাতের মোট খেলাপী ঋণের ৫১ দশমিক ৮০ শতাংশ। বাকি ৫২টি ব্যাংকে রয়েছে ২৯ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপী ঋণের ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ। আর শীর্ষ ১০ ব্যাংকে রয়েছে ৪১ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বাজার ঝুঁকির বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ঋণে সুদের হার মাত্র ১ শতাংশ কমালে পাঁচটি ব্যাংক তাদের প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। ঋণের সুদহার ২ ও ৩ শতাংশ কমলে ৯টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে আর ব্যাংক খাতের ইক্যুইটির মূল্য ১০, ২০ ও ৪০ শতাংশ কমলে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে তিন থেকে চারটি ব্যাংক। ঋণের বিপরীতে ঋণগ্রহীতারা যেসব সম্পদ ব্যাংকের কাছে জামানত রাখেন, ওই সম্পদের ১০ শতাংশ কমলে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে দুটি ব্যাংক। একই ভাবে ৪০ শতাংশ করে জামানতের সম্পদমূল্য কমলে ৮টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সার্বিক ব্যাংকিং খাতে সম্পদের ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ পাঁচটি ব্যাংকে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। আর ১০টি ব্যাংকের অনুকূলে এ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিমাণ ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
×