ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শফী আহমেদ

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৮ আগস্ট ২০১৭

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আজ ৮ আগস্ট। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৮তম জন্মদিন। বেগম মুজিবের জন্মদিন পালিত হবে এক অনাড়ম্বর পরিবেশে। বাঙালী জাতির জন্য একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, সেই আন্দোলন কালপর্বে সংগ্রামের ধারায় শেষ পর্যন্ত বাঙালী জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে যায় চূড়ান্ত সংগ্রামে। যার ফলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করি কাক্সিক্ষত স্বাধীন বাংলাদেশ। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশরতœ শেখ হাসিনার গর্ভধারিণী মা। আজ বেগম মুজিবের শুভ জন্মদিনে তাঁকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। বায়ান্ন থেকে একাত্তর অবধি যে সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল, সেই সংগ্রামে বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধু মুজিবের পেছনে ছায়ার মতো ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেগম মুজিবের অনানুষ্ঠানিকভাবে যখন বিয়ে হয় তখন তাঁর বয়স ছিল ৩ বছর, আর বঙ্গবন্ধুর বয়স ছিল ১০ বছর। পৃথিবী তখনও বর্তমান সভ্যতার আলোকিত পর্বে উদ্ভাসিত হয়নি। তবুও শৈশব থেকে চির সংগ্রামী মুজিবকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি আগলে রেখেছিলেন অপার মমতা ও ভালবাসা দিয়ে, সংগ্রামের সাহস দিয়েÑ তিনি হচ্ছেন বেগম মুজিব। যাঁর ছিল না কোন লোভ, মোহ, যিনি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিব তাঁর আপোসহীন দৃঢ়তায় এক মহান জাতীয়তাবাদী নেতার নেতৃত্বে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালীর জাতি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা সংগ্রামের যে নবধারা সূচিত হয়, সেই থেকে শুরু“করে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অবধি বেগম মুজিব এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা একে একে সেই ঘটনাবলীর কিছু কিছু আলোকপাত করব। বাঙালী জাতির একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মূল বাহন ছিল বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস ঘটিত হয়েছিল, এ নিউক্লিয়াসের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনক্রমে সংগঠন, আন্দোলন এবং সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে আপোসহীন ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই ছাত্র তরুণ সমাজের প্রধান এবং সর্বাত্মক প্রেরণার উৎসস্থল ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে, নেতৃত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের মধ্যে যখনই কোন সঙ্কটের কালো ছায়া ঘনীভূত হয়েছে বেগম মুজিব সেই কালো ছায়া দূর করার জন্য পর্দার অন্তরালে থেকে দৃঢ়, কৌশলী এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। এ আমার কথা নয়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যাঁরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তাঁদের সঙ্গে ঘরোয়া আলাপচারিতায় এ সত্য এবং বস্তুনিষ্ঠ কথাগুলো বার বার উঠে এসেছে। কিন্তু ইতিহাস তা লিপিবদ্ধ করেনি। উত্তরাধিকার সূত্রে বেগম মুজিব যতটুকু অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন তার পুরোটাই তিনি ব্যয় করেছেন নিঃস্বার্থভাবে সংসার এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত রাজনীতির পেছনে। তিনি একদিকে কিছু টাকা জমিয়ে বসতবাড়ি নির্মাণের জন্য যে প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ দেয়া হতো সেই প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু ভবনখ্যাত ৩২ নম্বর বাড়িটির কাজ সুসম্পন্ন করেন। পুত্রসম ভাগ্নে শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি নিজ পুত্র শহীদ শেখ কামাল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, শহীদ শেখ জামাল এবং কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেলের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার সব দায়িত্ব তিনি সুচারুরূপে পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগের পেছনে যতটুকু আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল তাও তিনি করেছেন। ছাত্র এবং তরুণদের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে কখনও কখনও বিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেই বিভেদও তিনি একজন দক্ষ সংগঠক ও নেতা যেমনভাবে সমাধান করে, ঠিক তেমনভাবে সমাধান করেছিলেন। এটিও ইতিহাসের এক অনুল্লিখিত অধ্যায়। ১৯৬২ সালের সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যখন অন্দোলন শুরু হয় তার কিছু দিন পরেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। সেই সময়ে আন্দোলন পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতেন বঙ্গবন্ধু প্রেরিত বার্তা মোতাবেক ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বেগম মুজিব। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন তখন সেই ৬ দফার আলোকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বাঙালী জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখে সেই নেতৃবৃন্দের পেছনেও বেগম মুজিব ছিলেন ছায়ার মতো। ৬ দফা কেন্দ্রিক আন্দোলন প্রচার প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালী জনগোষ্ঠীকে এক লোহ কঠিন ঐক্যের কাতারে নিয়ে আসে। তৎকালীন, বর্তমান ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা ছড়িয়ে পড়েন শ্রমিক ও শিল্পাঞ্চলে। সেখানেও শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। প্রচারধর্মী আন্দোলন একপর্যায়ে রাজপথের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এর বিস্ফোরণ ঘটে ৬ দফার আলোকে আহূত শ্রমিক ধর্মঘটে, যে আন্দোলনে শহীদ হন শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ অনেক শ্রমিক। আন্দোলন ছড়িয়ে পরে সকল শিল্পাঞ্চলে। কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, সেই অন্দোলনেও বেগম মুজিবের সুচিন্তিত ও দৃঢ় মনোভাব আন্দোলনকামীদের উৎসাহ যুগিয়েছিল। আন্দোলন দমন করতে না পেরে সামরিক শাসক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব) দায়ের করে। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে আবারও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। বাঙালীর জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের এই কঠিন পর্যায়ে দলের মধ্যে সুবিধাবাদী ও আপোসহীন ধারার বিভাজন রেখা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেগম মুজিবের অনুপ্রেরণায় তৎকালীন, সাবেক ও বর্তমান ছাত্রলীগ নেতারা এই আপোসকামী ধারাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মোকাবেলা করে আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে যায়। ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ছাত্র জনতার পক্ষে ঐতিহাসিক ময়দানে ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাসের বড়মাল্য ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এই বরমাল্য বরণ করে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে যান সত্তরের নির্বাচনের দিকে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে সামরিক জান্তা একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। জান্তার গুলিতে শহীদ হন আগরতলা মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক। ছাত্র জনতা রাজপথে নেমে আসে, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সেই মিছিলে সেøাগান উঠে ‘জহুর জহুর জ্বাল আগুন যায় না যে সহা’। শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শামসুজ্জোহা। আসাদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। কবি শামসুর রাহমান লেখেন ‘আসাদের রক্তমাখা শার্ট আমার পতাকা’। শহীদ হন নব কুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর। ছাত্র জনতা অগ্নিসংযোগ করে বিচারপতির বাসভবন এবং তৎকালীন দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান পত্রিকা অফিসে, ভেসে যায় পাকিস্তানী জান্তার সর্বশেষ দোসরদের ঠিকানা। ইতিহাসের এই পর্যায়ে বেগম মুজিব এক দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন যা কিনা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত ছিল। সামরিক জান্তা আইয়ুবের কাছ থেকে প্রস্তাব আসে বঙ্গবন্ধুকে পেরোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল আলোচনায় বসার জন্য। সেই সময়কার বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন নেতৃত্ব ও ছাত্র তরুণদের দৃঢ়তা বেগম মুজিবের দৃঢ়তার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের কতিপয় প্রভাবশালী নেতা বঙ্গবন্ধু ভবন ৩২ নম্বরে বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসেন পেরোলে মুক্তির প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য। কিন্তু বেগম মুজিব এক অনমনীয় দৃঢ় মনোভাব প্রদর্শন করেন। পরবর্তীতে বেগম মুজিব কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন এবং পেরোলে মুক্তি না নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধের মধ্যে অসম্ভব দৃঢ়তা প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। সামরিক জান্তা রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল শেখ মুজিব পেরোলে মুক্তি পাচ্ছেন এবং আলোচনায় যোগ দিচ্ছেন। পেরোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পাকিস্তানী শাসকের সমস্ত পরিকল্পনা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কিন্তু পাকিস্তানীরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করে। শুরু“হয়ে যায় পূর্ববাংলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালী জাতির উপর ইতিহাসের এক নগ্ন হামলার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ২৫ মার্চের কাল রাতে সেই হামলার সূচনা হয়। শুরু হয় চূড়ান্ত মুক্তির সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে, বেগম মুজিব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলকে। বঙ্গবন্ধু পুত্র শহীদ শেখ কামাল ও শেখ জামাল পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি স্বাধীনতা লাভ করে। আমরা পাই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। বেগম মুজিব পরিবারসহ মুক্ত হন মিত্রবাহিনীর সহায়তায়। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞের মুহূর্তটি পর্যন্ত বেগম মুজিব তাঁর নির্লোভ ভূমিকার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫নং আগস্টের যে কাল রাতে স্বাধীনতাবিরোধী কুদেতারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সে সময়েও অর্থাৎ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেগম মুজিব ছিলেন ইতিহাসের কালজয়ী এক মহানায়কের অনুপ্রেরণাদায়িনী হিসেবে। বাঙালী জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে বেগম মুজিবের অবদান বঙ্গবন্ধুর পতœী হিসেবে নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাতা হিসেবে নয়; একজন নীরব দক্ষ সংগঠক যিনি ধূপের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয় সম মহানায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। ইতিহাসে বেগম মুজিবের এই অবদান যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত। পুনশ্চ : বেগম মুজিবের জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা ও নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রনেতা
×