ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. নাসরীন আহমাদ

খুব সাধারণ ছিলেন তিনি

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৮ আগস্ট ২০১৭

খুব সাধারণ ছিলেন তিনি

অনেক দিন ধরেই পারিবারিকভাবে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে চিনি। আমার সুযোগ হয়েছে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার। বঙ্গবন্ধু যখন বঙ্গবন্ধু হননি, বোধ হয় ১৯৬১ সালের দিকে আমরা তাদের পড়শী হই। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আমরা প্রতিবেশী হিসেবে ছিলাম। আমি বঙ্গমাতাকে মামি বলে ডাকতাম। তিনি সব সময় সাধারণ পরিবেশে থাকতে পছন্দ করতেন। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালতে পছন্দ করতেন। গ্রামবাংলার সাধারণ মেয়েরা যেমনটা হয়, তেমনটাই ছিলেন তিনি। তবে সে বাড়িতে ছিল মায়াভরা পরিবেশ। খুব সহজে সবাইকে কাছে টানতে পারতেন। তাঁর যে ¯েœহ পেয়েছি তা কখনও ভুলবার নয়। অনেক বছর হলো তাঁকে আমরা হারিয়েছি। কিন্তু প্রতিবছর এই দিনটাতে যখন তাঁকে নিয়ে ভাবি, তাঁর চরিত্রের নতুন নতুন দিক যেন আবিষ্কার হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনের পুরোটা সময় জনগণের জন্য কাজ করেছেন। এজন্য তাঁকে ১৭ বার জেল খাটতে হয়েছে। যখন বঙ্গবন্ধু জেলে থাকতেন তখন তিনি তাঁর ছেলে-মেয়েদের কখনও তাদের বাবার অনুপস্থিতি বুঝতে দিতেন না। সবাইকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে রাখতেন। যখন শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকতেন তখন মামি নিজের হাতে খাবার রান্না করে নিয়ে দেখতে যেতেন। টিফিন বাটি ভরে খাবার নিয়ে যেতেন আর ফিরে আসতেন জনগণের খবর নিয়ে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন শ্লোকের ভাণ্ডার। মাঝে মাঝে অনেক সুন্দর সুন্দর সব শ্লোক বলতেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। সব সময় হাসি-খুশি থাকতে পছন্দ করতেন। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। যদি কখনও কোন বিষয় নিয়ে গম্ভীর পরিবেশ তৈরি হতো তিনি সহজে তাঁর শ্লোকের মাধ্যমে পরিবেশকে হালকা করে দিতে পারতেন। আমার জানা মতে তাঁর ছোট মেয়ে শেখ রেহেনা তাঁর মায়ের বলা কিছু শ্লোক লিখে রেখেছেন। তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করত খুব বেশি। ১৯৭৪ সালে আমার মা মারা যান লন্ডনে। সেখান থেকে যখন তাঁর মরদেহ দেশে এনে ধানম-ির বাড়িতে রাখা হয়, তখন মামি মায়ের কফিন ছুঁয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন আর বারবার একটি কথাই বলছিলেন যে, ‘আপনি তো চলে গেলেন, এখন আমাদের কি হবে’। আরেকটি ঘটনা, ১৯৭৫-এর জুলাই মাসের শেষ দিকে আমি ও মামি (বঙ্গমাতা) ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়িতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম নিচে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য ঘোরাফেরা করছে। তবে তারা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তিনি আমাকে বললেন, ‘দেখ আজকে যারা আমাদের পাহারা দিচ্ছে একদিন তারাই আমাদের দিকে গুলি তাক করবে।’ ঠিক তার কিছুদিন পরেই ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সেনাবাহিনীরই কিছু বিপথগামী সদস্য। তিনি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, খুব শীঘ্রই কোন বিপদ আসবে। এটা থেকে তাঁর দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অত্যন্ত স্নেহময়ী ছিলেন। পান খেতে ভালবাসতেন। সব সময় পান, সুপারিসহ একটা পানের বাটা তিনি যতœ করে রেখে দিতেন। ছোট ছোট জিনিসে খুব আনন্দ পেতেন তিনি। কোন উপহার পেলে তিনি যে কী খুশি হতেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তিনি একদিন আমাকে একটা লাল গামছা উপহার দিয়েছিলেন। আমার বিয়েতে বিয়ের গান, গায়ে হলুদ মাখানোসহ অনেক আনন্দ করেছিলেন তিনি। সে স্মৃতি কখনও ভোলার মতো না। তিনি আমাদের এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে, কখনও তাঁকে আমাদের প্রতিবেশী মনে হয়নি। মনে হয়েছে আমাদের পরিবারেরই একজন। তিনি বিচক্ষণ একজন মানুষ ছিলেন। যদি কখনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতেন, তখন তিনি তাঁকে পরামর্শ দিতেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণের আগে নেতাকর্মীরা তাঁকে বলেছিলেন ঐদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে। কিন্তু কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। সে সময় বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, এত চিন্তা না করে তোমার মন যা বলে তুমি তাই শোন। একথা শুনে বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ ভেবে তারপর ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার জন্যই বঙ্গবন্ধু ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠেছিলেন। দেশের মানুষের কথা বলতে গিয়ে তিনি তাঁর জীবনে অনেকবার জেলে গেছেন। খুব কম সময়ই তিনি পরিবারের সঙ্গে থেকেছেন। বেগম মুজিব একা সংসার সামলাতেন। কখনও কোন অভিযোগ করতেন না। সব সময় বঙ্গবন্ধুকে সাহস জোগাতেন। আর সংসারে শান্তি ছিল বলেই বঙ্গবন্ধু আমাদের শান্তির জন্য কাজ করতে পেরেছিলেন। এজন্য বলা হয় বঙ্গবন্ধু যদি বজ্র হয়ে থাকেন তাহলে তার ১২ আনা বারুদ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। লেখক : উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×