ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নুরজাহান সাথী

অভিমত ॥ ন্যায়-অন্যায় পৃথকীকরণে শিল্পের বোধ কার্যকর

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৮ আগস্ট ২০১৭

অভিমত ॥ ন্যায়-অন্যায় পৃথকীকরণে শিল্পের বোধ কার্যকর

মানবিক, মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক ও সহনশীল সমাজ গড়তে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প আর কিছু নেই। এ কথা অনস্বীকার্য যে, শিল্পীরা চারপাশের সমাজকে দেখে দর্শনের চোখে আর দার্শনিকরা দেখে বিশ্লেষণের আদলে। হয়তো মৌলিক সৃষ্টি মানুষের অসাধ্য, তবে আবিষ্কার ও সংযুক্তিকরণে শিল্পীর ভূমিকা সবার উর্ধে। সৃষ্টি প্রাকৃতিক। সুতরাং প্রকৃতি যেটাকে গড়ে শিল্পী সেটাকে মানুষের চোখে তুলে ধরে। সেই তুলে ধরার প্রয়াসটাই বিবিধ ক্রিয়াকলাপের বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকাশ। এ ধরনের কার্যক্রমের ফলে মানুষ সুন্দর বস্তু লাভ করে এবং প্রকৃতির অপরূপ সৈন্দর্য অবলোকন করে। আর এ জন্যই শিল্প সবসময় সুন্দরকে নির্দেশ করে। মানব মন যখন সুন্দরে বিস্মিত ও বিমুগ্ধ হয়ে যায় তখন সুন্দরটাকে নিজের মধ্যে আপন করে পেতে চায়। তারই ধারাবাহিকতায় সে চায় এই নৈসর্গিকতাকে একটি স্বাভাবিক রূপ দিতে। এর মাধ্যমে জন্ম হয় শিল্পের। সুতরাং যা কিছু শিল্প তার সবটাই সুন্দর। তাই সুন্দর হতে বা সুন্দর করতে শিল্পের বিকল্প নেই। ড্রইং, আলোছায়া টোন, স্কেচ, পেইন্টিং, মডেলিং ভাস্কর্য, টেরাকাটা ও মৃৎশিল্প, ছাপচিত্র, নাচ, গান, বাদ্য বাজনা, গল্প, কবিতা, নাটক, সিনেমা এ সবই সৃষ্টি মনের একটি বিশেষ অবস্থান বা বিশেষ পরিস্থিতিগত স্তর থেকে উদ্ভূত। শিল্পী তার সবটুকু আবেগ, প্রেম দিয়ে তার ভাবনাটাকে সৌন্দর্য প্রয়াসে রূপান্তর করে। যেখানে মিশ্রিত থাকে শিল্পীর নিবিড় পর্যবেক্ষণ, দর্শন এবং সমাজ ও সভ্যতার কল্যাণে মানুষের সঙ্গে সংযুক্তিকরণের ব্যাপক ইচ্ছা। শিল্পী কখনও শূন্যতাকে অবলম্বন করে টিকে থাকে না। সমাজ, পরিবেশ, জীবন, সম্পর্ক ইত্যাদির সঙ্গে তার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এমন অনেক নজির আছে যে, সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে অনেক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সিদ্ধান্তের পূর্বে শিল্প সাহিত্যের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। অনেক দাবি আদায়ে, আন্দোলনে মানব মুক্তির স্বার্থে শিল্প ও শিল্পবোধ অনেক কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। এমন সুষ্ঠু রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে রাষ্ট্রনায়কদেরও শিল্পী সাহিত্যিকের শরণাপন্ন হতে দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু, গান্ধী, নেহরুর মতো মহান নেতাদেরকেও বিভিন্ন সময় শিল্পী-সাহিত্যিকদের কাছে ঘেঁষার অনেক নজির আছে। শিল্পের ক্ষমতা সত্যের মতো অনড়। কেননা শিল্পীর কাজ সত্য উপলব্ধি করা, সৌন্দর্য সৃষ্টি করা। সুন্দর-অসুন্দর শুভ-অশুভ মিলিয়ে পূর্ণতা। শিল্পী তার মনের মাধুরী মিশিয়ে সেই পূর্ণতাকেই শিল্পে রূপান্তর করে। এক এক জনের নিকট শিল্পের ধারণা এক এক রকম। আমাদের চারপাশের অতি বা অতি বৃহৎ, তুচ্ছ বা অতি প্রয়োজনীয়, কুৎসিত বা সুন্দর এই সবকিছুর বিচারে শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। এ সবকিছুর সমন্বয়ে শিল্পের মাধ্যমে সত্যের প্রকাশ। সত্যের জয়গান, অসত্যের নিন্দা, ন্যায়ের বাহবা অন্যায়ের প্রতিবাদ, সুন্দরের প্রশংসা, অসুন্দরের বিরোধিতা এসব কিছু একজন শিল্পী তার শিল্প মাধ্যমে নিপুণভাবে প্রকাশ করে। তাই শিল্পবোধ সৃষ্ট হলেই সৃষ্টি হবে মানবিকতার বোধ, মুক্তমনা ভাবনা, সহনশীল সামাজিকতার বোধ, অসাম্প্রদায়িকতার বোধ। শিল্পমাত্রই নান্দনিক। আবার যা কিছু শিল্প তাই সংস্কৃতি। শিল্প হচ্ছে হৃদয়ের সুকোমল বৃত্তি। যার ব্যাপ্তি জগৎজোড়া। শিল্পের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে বাস্তবধর্মী হওয়া। বাস্তবে যা ঘটে বা ঘটা সম্ভব, শিল্প তারই প্রতিরূপ। শিল্পের বাস্ততায় শিল্পের গুণ। যেহেতু পরাবাস্তবতাও বাস্তবের বাইরে নয়। বিশ্ব কেন্দ্রিক ভাবনাই শিল্পের মহানুভবতা। যে ভাবনায় সকলে মিলে সবাই ভাবনা তৈরি করে। যা সতন্ত্র ও সহনীয় সমাজ গড়তে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শিল্প চিন্তায় সত্যের স্থান অন্য সকল তত্ত্বের উর্ধে। সত্যকে সুন্দর করতে সেই জানে যার দৃষ্টি নির্মল। যার হৃদয় পবিত্র, যে সর্বত্রই আনন্দকে প্রত্যক্ষ করতে চায়। তার কোথাও বাধা থাকে না। আর এজন্যই একজন শিল্পী তার শিল্পে সত্যকে বা সৈন্দর্যকে নির্মাণ করতে পারে। শিল্প হচ্ছে মানুষের আত্মিক শক্তির বিকাশ। যা মানুষের আত্মিক শক্তির স্পর্শধন্য তা কখনোই মিথ্যা হতে পারে না। এক কথায় শিল্প হলো প্রকাশ। শিল্পীর জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনাকে আত্মস্থ করে এর রং বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। চারপাশের আলো অন্ধকার দুঃখ হাসি ভরা পরিবেশে শিল্পীর ভাবনাকে উদ্দীপিত করে। শিল্পচর্চার সবচেয়ে কার্যকরী দিক হচ্ছে শিল্পবোধ। প্রথমেই সমস্ত জীবের জীবনের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র জীবনবোধ তৈরি করে। শিল্পের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। জীবনই হলো শিল্পের পটভূমি। মানব জীবনের দঃখ, সুখ, বেদনা, আনন্দ এবং অপরাপর অভিজ্ঞতা শিল্পের বিষয়বন্তু হয়ে প্রতিভাত হয়। জীবনের মধ্যে যেমন সুন্দর ও অসুন্দরের অভিব্যাক্তি দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি দেখতে পাওয়া যায় পাপ পূর্ণ, সৎ-অসৎ, নীতি-দুর্নীতি ইত্যাদির বিপরীত বৈশিষ্ট্যাবলীর সংমিশ্রণ ্ শিল্প যেহেতু জীবনের প্রতিরূপ অথবা জীবন থেকে রস আহরণ করে শিল্পের প্রাণরূপ সান্জবীত হয়। সেহেতু এ সমস্ত বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যাবলী শিল্পের মধ্যে প্রত্যক্ষ রূপ লাভ করে। শিল্পের লক্ষ্য সুন্দরকে রূপদান করা নয়। শিল্পের লক্ষ্য হলো সত্যকে প্রকাশ করা। আর সুন্দরের ব্যাপ্তি কেবল সুন্দরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অসুন্দরের মধ্যেও তার অনুপ্রবেশ। কারণ ভাল-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর সকল ক্ষেত্রেই আমরা একই মহা-সত্তার প্রবেশ দেখতে পাই। যদিও মানুষের অভিজ্ঞতার জগৎ সেই মহাসত্তার রূপেই রূপময়। তবুও আমরা আমাদের রুচি-অভিরুচি দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষা-দীক্ষা অনুসারে সুন্দর অসুন্দরের প্রভেদ করে থাকি। কোন বস্তুই মূলত সুন্দর বা অত্যান্তিকভাবে অসুন্দর নয়। তাই শিল্পেও দুটির অনুপ্রবেশেই সুন্দর প্রকাশ। সুতরাং সুন্দর-অসুন্দর, নীতি-দুর্নীতি, সৎ অসৎ, ন্যায়-অন্যায় বোধ সৃষ্টিতে এবং এসবের পৃথকীকরণে শিল্পের বোধ সবচেয়ে কার্যকর। লেখক : সংস্কৃতিকর্মী
×