ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৮ আগস্ট ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

দশকের পর দশক ধরে ঢাকায় থাকতে থাকতে আমরা অনেকেই সর্বংসহা হয়ে উঠেছি; জান যায় যায় অবস্থা হলেও ঢাকার মাটি কামড়ে পড়ে আছি। এ নিশ্চয়ই ঢাকাপ্রেম নয়, এ আমাদের নিজের অক্ষমতা। আবার আমাদের মাঝেই এমন অনেকেই আছেন, ঢাকাবাসী হয়েছেন খুব বেশি বছর হয়নি; তারা দিনরাত ঢাকাকে শাপশাপান্ত করছেন। ঢাকার কিছু মৌসুমী সমস্যা রয়েছে, আবার রয়েছে নিত্যদিনের ভোগান্তি। যেমন বর্ষামৌসুমে কয়েক ঘণ্টার বন্যা। আর ৩৬৫ দিনই যানজটের যন্ত্রণা। ভুল বললাম, বছরে দুই ঈদে কয়েকদিনের জন্য যানজট বিরতি নেয়। যাহোক, ঢাকাকে যারা গালমন্দ পাড়েন তারা কি ভেবে দেখেছেন যে ঢাকার কোন দোষ নেই! যদি দোষ দিতে হয় তো দিতে হবে উচ্চাভিলাষী লোভী ঢাকাবাসীদের। ঢাকার খাল-জলাশয়গুলোর টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। তার অনেকগুলোর আর চিহ্নমাত্র নেই। মানুষের মৃত্যু হলে সমাধি থেকে যায়, খালবিল হত্যা করা হলেও তার জল শুকিয়ে কংক্রিটের জঞ্জাল বা পাষাণ হয়ে ওঠে। ঢাকার চার নদীতেও আমরা লোভের কামড় বসয়েছি। এইসব কথা নানাভাবে বছরের পর বছর ধরে আমরা শতসহস্রজন লিখছি; বলছি লাখো নাগরিক। এখন অনেকটা হাহাকারের মতোই শোনায় এসব। এবং সুসংবাদ সেদিন এক চিলতে স্বস্তি মিললো কুড়িল বিশ্বরোড থেকে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ের (৩০০ ফুট) দুই পাশে বিভিন্ন স্থায়ী-অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষর অভিযান চালু রাখার সংবাদ জেনে। বৃহস্পতিবার এই সড়কের ১০০ ফুট খাল খনন প্রকল্পের খিলক্ষেত অংশে রেস্তোরাঁ, পাকা ভবনসহ ২৫টির মতো স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। সকালে বসুন্ধরা কনভেনশন সিটির একটু সামনে থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান চলে বিকেল পর্যন্ত। এর আগে বুধবার রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রথম দিনের অভিযানে সড়কের খিলক্ষেত অংশে বসুন্ধরা কনভেনশন সিটির সীমানাপ্রাচীর, কয়েকটি রেস্তোরাঁ ও বিপরীত পাশে জোয়ারসাহারা অংশে নির্মাণাধীন একটি বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ভেঙে দেওয়া হয়। কুড়িল থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১০০ ফুট প্রশস্ত খাল খননের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে এসব স্থাপনা গড়ে উঠেছিল। সড়কের দুই পাশে এমন দেড় শতাধিক স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে। যেগুলো পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করা হবে। প্রতি বর্ষা মৌসুমে রাজধানীর নিকুঞ্জ, বারিধারা, জোয়ারসাহারা, ডিওএইচএস, সেনানিবাস, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কালাচাঁদপুরসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য গত ৮ জুলাই কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বালু নদ পর্যন্ত এই খাল খননের কাজ শুরু হয়। সড়কের দুই পাশেই এই খালের দৈর্ঘ্য হবে ১৩ কিলোমিটার করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। খরচ হবে ৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯০ একর ভূমি অধিগ্রহণেই ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। যাহোক ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। ঢাকার তিন-পাঁচ কাঠা প্লটের মালিকরা যে জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বহুতল ভবনে কবুতরের খোপের আদলে হাজার বারোশ’ বর্গফুটের গন্ড গন্ডা ফ্ল্যাট গড়েছেন আর মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ঢাকামুখী মানুষ পরিবার-পরিজনসহ এইসব কুঠুরিতে মাথা গুঁজছেন- একদিন ঢাকার ক্রমবর্ধমান সমস্যার জন্য এ বিষয়টিও বেশি করে আলোচিত হবে। বিপরীতমুখী দুটো গাড়ি স্বচ্ছন্দে চলতে পারে না এমন আঁটোসাঁটো সড়কের দুইপাশে সারি সারি আট তলা ভবনের প্রত্যেকটিতে বসবাসকারী শত শত মানুষ কিভাবে ঘরে-বাইরে চলাচল করবে, কোথা থেকে গ্যাস-বিদ্যুত-পানির যোগান আসবে- এইসব দূরদর্শী চিন্তা ও সুপরিকল্পনা ছাড়াই যারা ঢাকাকে ঘিঞ্জি বস্তিতুল্য অবয়ব দিয়েছেন, তারা বিপুল অর্থোপার্জন করেছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু ঢাকা যে রসাতলে গেল তার বেলা কী হবে? আসলে নেতিবাচক কথা না বলে বরং ঢাকার একটু প্রশংসাই করতে চাইছিলাম। যে মানুষটি গ্রামে বা মফস্বলে আর দুবেলা দুমুঠো খাবারের বন্দোবস্ত করে উঠতে পারেন না, তিনিও বিশ্বাস করেন, ঢাকায় চলে গেলে কোন না কোন একটা উপায় হয়ে যাবে বেঁচে থাকার। সত্যি সত্যি হচ্ছেও। আর কিছু না হোক, রিক্সা চালিয়ে বা ছোটখাটো ব্যবসা করে, মানে ফেরি করে হোক, বা রাস্তায় বসে পড়ে হোক কিছু একটা বেচাবিক্রি করে ক’টা টাকার মুখ সে দেখতে পারছে। এখনও ঢাকার বাইরে কোন ব্যক্তির অসুখ না সারলে ঢাকা দূর থেকে তার সামনে আশার একটা আলো জ্বালিয়ে রাখে। এই যে গাইবান্ধার দুটি জোড়া লাগানো শিশু ঢাকায় এসে নতুন সুস্থ জীবন ফিরে পেল, সেজন্য ঢাকার প্রশংসা কি করা যাবে না? যেসব চিকিৎসক তোফা-তহুরাকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনলেন, তাদেরকে অভিনন্দন জানাতে হবে। এর আগেও দেশে তিন জোড়া শিশুকে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা হয়েছে, কিন্তু তাদের ধরন ছিল আলাদা। তোফা-তহুরা যেভাবে জোড়া লাগানো ছিল, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘পাইগোপেগাস’। শিশু দুটোর অস্ত্রোপচারে বিভিন্ন বিভাগের ১৬ জন সার্জন যুক্ত ছিলেন। জন্মের পর থেকে ১০ মাস তোফা ও তহুরা একসঙ্গে বড় হয়েছে। পিঠের কাছ থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তোফা-তহুরার মায়ের নাম শাহিদা ও বাবার নাম রাজু মিয়া। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর শাহিদা তোফা-তহুরার জন্ম দেন। তার বাবা একজন দিনমজুর। তার পক্ষে এত ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ বহন করা সম্ভব নয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা করা হয়েছে। এবার বৃহস্পতিবার মহাজলাবদ্ধতার কারণে সাপ্তাহিক মহাঅচলাবস্থা। গত সপ্তাহের লেখায় ছিল বুধবারে ঢাকা জলমগ্ন হওয়ার কথা। লিখেছিলাম: বুধবার, ২৬ জুলাই। এদিন মহাজলাবদ্ধতার শিকার হয় রাজধানী! মহানগরী ঢাকার এমন কোন এলাকা নেই, যেখানে জলাবদ্ধতা ও যানজট হয়নি। এক সপ্তাহ ব্যবধানে এবার লিখতে হবে বৃহস্পতিবার ৩ আগস্টের কথা। পরদিন জনকণ্ঠের ব্যানার হেডলাইন ছিলÑ ডুবেছে রাজধানী। ছয় কলাম জুড়ে ছাপানো ছবি দেখে যে কারোরই মনে হবে ঢাকায় বুঝি বন্যা চলছে। এই মহাজলাবদ্ধতা নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নেই। সব কথাই আগে বলা হয়ে গেছে। ঘন ঘনই এসব কথা আমরা বলছি। তবে নিকট অতীতে দেখা যায়নি এমন একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেটি হলো জেমিনি বোটে করে ছাত্র-ছাত্রীদের প্লাবিত এলাকা পার করে দেয়া। ফায়ার ব্রিগেড কর্মীরা এই কাজের জন্য রাজধানীর সবচাইতে আলোচিত প্লাবিত এলাকা শান্তিনগরকে বেছে নেন। শান্তিনগরে চলাচলকারীর মধ্যে ভাগ্যবানেরা এতে কিছুটা শান্তি পেলেও পুরো অচল রাজধানীর বাসিন্দারা যে জলাবদ্ধতার অশান্তি ভোগ করছেন, সেকথা বলাই বাহুল্য। সাবিনা ও লাইলী মাত্র পাঁচ সপ্তাহ ব্যবধানের দুটি ঘটনা। দুটি গৃহকর্মী নির্যাতনের। একটির প্রতিবাদ হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অপরটি, গৃহকর্মী যে বস্তিটিতে থাকতেন সেখানকার অধিবাসীরা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করেন। বেশ সহিংস ছিল প্রতিবাদ। শুক্রবার বনশ্রীর একটি বাসায় গৃহকর্মী লাইলীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। গাড়ি ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে। একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী কর্তৃক নৃশংসভাবে নির্যাতিত হয় ১১ বছরের গৃহকর্মী সাবিনা। ডিম পোচ করতে গিয়ে কুসুম ভেঙে ফেলার অপরাধে তাকে প্রচণ্ড নির্যাতন করা করা হয়। মারতে মারতে তার চোখ দুটি ফুলে ঢোলের মতো হয়ে যায়। আমরা কেবল তার মুখের ছবিটি দেখতে পেয়েছি কিন্তু আমার বিশ্বাস তার শরীরে আরও এমন অনেক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যাবে। বাবা-মা কতটা অসহায় হলে তার সন্তানকে অন্যের বাসায় কাজে দেন এটা সবাই বুঝতে পারে। আমাদের দেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ কিন্তু গৃহকর্মী হিসেবে আমরা অনেকেই কমবয়সী শিশুদের নিয়োজিত করি। মামলার একমাত্র আসামি আয়েশাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। এই কলাম লেখার সময় জানতে পারি যে সাবিনার পরিবার কোর্ট থেকে মামলা দুলতে চাইছে। আসামিপক্ষ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছে, বলেছে আরও টাকা দেবে। টাকার বিনিময়ে মামলা থেকে হয়তো রেহাই পাওয়া যায়, কিন্তু মানুষের ঘৃণার অদৃশ্য চাবুক থেকে নিষ্কৃতি কি মেলে? ঢাকার প্রায় প্রতিটি মধ্যবিত্ত পরিবারেই খ-কালীন কিংবা পূর্ণকালীন গৃহকর্মী নিয়োজিত রয়েছে। গৃহকর্মী নির্যাতনের বিষয়টি যেভাবে বাড়ছে, একইসঙ্গে তার প্রতিবাদও যে পর্যায়ে হচ্ছে- এসব দেখে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বিচলিত হওয়ারই কথা। একজন দুস্থ ও খেটে খাওয়া মানুষের ওপর তার নিয়োগদাতা পরিবারের কোন সদস্য অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায় কোন বিচারে? মানুষের মধ্য থেকে কি মানবিকতা, সহমমর্র্মিতা সম্পূর্ণ লোপ পেতে বসেছে? গৃহকর্ত্রীদের বুঝতে হবে, অর্থের বিনিময়ে শ্রম কিনলেই শ্রমিকের ওপর নির্যাতনের অধিকার জন্মে না। অরক্ষিত বাসের জানালা চলন্ত বাস-মিনিবাসের জানালা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। সিগন্যাল বাতি দেখে আটকে থাকা যানসমূহ সবুজ সংকেত পেয়ে তড়িঘড়ি ছুটতে শুরু করলেই সুযোগ বুঝে লাফিয়ে উঠে যাত্রীর কানের সঙ্গে সেঁটে থাকা মোবাইল ফোনটি টান মেরে ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। আমার সামনেই এমন দুটি ঘটনা ঘটেছে। আরেকটিতে এক ভদ্রমহিলার কানের সোনার দুল ছিনিয়ে নেয়া হয়। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে শুধু বললেন, আমি তো মাথায় কাপড় দিয়েই রেখেছিলাম, ওরা জানল কিভাবে ঘোমটার নিচে সোনার দুল আছে! শিশুসাহিত্যিক রোমেন রায়হান এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট লিখেছেন ফেসবুকে। তুলে দিচ্ছি: প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে শাহবাগ আর বাংলামোটরের মাঝে গাড়ি স্থির হয়ে বসে আছে। লাল ক্যাপ পরা এক যুবক দুটি পত্রিকা হাতে রাস্তার মাঝ বরাবর আইল্যান্ডের একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে আসা যাওয়া করছে। আচরণ অত্যন্ত সন্দেহজনক। বেকার সময় কাটানোর জন্য জানালার কাচ নামিয়ে জানতে চাইলাম : এই ৫টার সময় কে পেপার কিনব? : ১০০টা নিয়া সকালে বাইর হইছিলাম। আর মাত্র দুটা আছে। লাগব? : না। তা তুমি রাস্তার মাঝ দিয়া হাইটা বেচতেছো ক্যান? রাস্তার সাইড দিয়া গিয়া বেচ! : কয়েকটা ড্রাইভার আছে যাগোর কাছে ৩/৪ টা কইরা পেপারের ট্যাকা পাই। ওগোরে খুঁইজা দেখতেছি পাই নাকি... লাল ক্যাপ আবার জোরে হাঁটা দিয়েছে। আমার ড্রাইভার কাশেদের নিশ্চিত ধারণা এইটা টানা পার্টি, মানে জ্যাম ছুটে গাড়ি চলতে শুরু করলেই গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বেখেয়াল মোবাইল ইউজারের মোবাইল ছিনতাই করবে। আমি সতর্কতার সঙ্গে জানালার কাঁচ তুলে স্ট্যাটাস লিখছি আর জ্যাম ছোটার অপেক্ষায় আছি। অন্যান্য বার কাশেদের কথা সত্যি হয়েছে। এইবার দেখি কী হয়! ০৬ আগস্ট ২০১৭ [email protected]
×