ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বজিত হত্যা মামলায় হাইকোর্টেও রায়॥ ফাঁসি বহাল ২ জনের

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ৭ আগস্ট ২০১৭

বিশ্বজিত হত্যা মামলায় হাইকোর্টেও রায়॥ ফাঁসি বহাল ২ জনের

বিকাশ দত্ত ॥ বহুল আলোচিত পুরান ঢাকার দর্জির দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিত দাস হত্যা মামলায় বিচারিক আদালত যে আটজন আসামিকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল তার মধ্যে দুইজন রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদারের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। অন্য চারজনকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং দুইজনকে খালাস দেয়া হয়েছে। বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে যে দুইজন আপীল করেছিলেন, তারা হাইকোর্টে খালাস পেয়েছেন। পলাতক থাকা বাকি ১১ জনের বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে কোন মন্তব্য করা হয়নি। একই সঙ্গে সঠিক রিপোর্ট প্রদানে ব্যর্থতায় সুরতহালকারী সূত্রাপুর থানার এসআই জাহিদুল হক ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডাঃ মাকসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। রবিবার বিচারপতি মোঃ রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট দ্বৈত বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রপক্ষ বলেছেন, তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবে কিনাÑ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল নজিবুর রহমান। আর আসামিদের পক্ষে ছিলেন- আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী, এস এম শাহজাহান, লুতফর রহমান মন্ডল, সৈয়দ আলী মোকাররম, সৈয়দ শাহ আলম, মোঃ আবদুস সালাম, মোঃ ইসা, সৈয়দ মাহমুদুল আহসান। পলাতক আসামিদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন মোমতাজ বেগম। হাইকোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, ‘বর্তমানে ছাত্রনেতারা হলের রুম পর্যন্ত ভাড়া দেয়। তারা দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে।’ ‘এটা পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকা- না হলেও আসামিদের সম্মিলিত হামলার ফলেই বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়েছে।’ কিন্তু সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে ‘গাফিলতির’ কারণে নিম্ন আদালতের দেয়া সাজা হাইকোর্টে এসে কমে গেছে। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের আঘাতের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আসামিদের জবানবন্দী ও সাক্ষীদের বর্ণনার মিল পায়নি আদালত। ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, বিশ্বজিতের লাশের সুরতহাল করার ক্ষেত্রে সূত্রাপুর থানার এসআই জাহিদুল হকের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা- তা তদন্ত করে আইজিপিকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আর ময়নাতদন্ত করার ক্ষেত্রে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডাঃ মাহফুজুর রহমানের কোন গাফিলতি ছিল কিনা- তা তদন্ত করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ডেন্টাল কাউন্সিলকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাইকোর্ট। এই আদেশ ঠিকমতো বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা- সে বিষয়ে মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে সময়ে সময়ে আদালতে জানাতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ‘সামগ্রিকভাবে অপরাধের মাত্রা ও গভীরতা বিবেচনা করে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করলে ন্যায়বিচার সমুন্নত হবে বলে এ ট্রাইব্যুনাল মনে করে।’ বিচারক বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচী হরতাল-অবরোধের কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নামধারী এই ছাত্ররা বিশ্বজিতকে রক্তাক্ত জখম করার পর মিটফোর্ড হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। কাজেই এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচী হরতাল-অবরোধের ক্ষেত্রে আহ্বানকারী পক্ষ ও বিরোধী পক্ষকে গণতন্ত্র রক্ষা ও আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার জন্য গভীর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়া আশঙ্কা, জনসাধারণের শান্তিভঙ্গ বা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা, সম্পত্তির ক্ষতিসাধন না হয়।’ ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধের মধ্যে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে বিশ্বজিত দাসকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার খবর ও ছবি সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। রবিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হয় এই রায় পড়া। শেষ হয় বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ। গত ১৭ জুলাই শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য ৬ আগস্ট দিন নির্ধারণ করে আদালত। হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়েছেÑ রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদারের। আর মৃত্যুদন্ড থেকে খালাস পেয়েছেন- সাইফুল ইসলাম ও কাইয়ুম মিঞা টিপু। মৃত্যুদন্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে- মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন ও মীর মোঃ নূরে আলম লিমন। এছাড়াও বিচারিক আদালতের দেয়া যাবজ্জীবন থেকে খালাস পেয়েছেন- এএইচএম কিবরিয়া ও গোলাম মোস্তফা। রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন না করায় বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত বাকি ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- বহাল রাখা হয়েছে। তারা হলেন- খন্দকার ইউনুস আলী, তারেক বিন জোহর, আলাউদ্দিন, ওবায়দুল কাদের, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল আমিন শেখ, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, কামরুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন। গত ১৭ জুলাই এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপীল শুনানি শেষে রায়ের জন্য ৬ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়। রায় ঘোষণার পর ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল নজিবুর রহমান জানান, যে পলাতক ১১ আসামির বিষয়ে মন্তব্য করেনি হাইকোর্ট, তারা গ্রেফতার হলে বা আত্মসমর্পণ করলে তাদের বিষয়ে পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ মামলায় ৮টি আপীল ও ৭টি জেলা আপীল করে আসামিরা। এসব আপীল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি একসঙ্গে নিয়ে রায় দেয় হাইকোর্ট। গত ১৬ মে বিশ্বজিত দাস হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানি শুরু হয়। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল নজিবুর রহমান। আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী ও শাহ আলম। আদেশের পর ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল নজিবুর পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আটটি আপীল, সাতটি জেল আপীল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর মোট ১৫ কার্যদিবস শুনানি হয়েছে। সাক্ষীদের জবানবন্দী ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচারিক আদালত যে সাজা দিয়েছিল আমরা যুক্তিতর্কে সেগুলো তুলে ধরে দ- বহাল রাখার আর্জি জানিয়েছিলাম।’ বহুল আলোচিত বিশ্বজিত দাস হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ২১ আসামির মধ্যে ৮ জনকে মৃত্যুদন্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় বিচারিক আদালত। ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবিএম নিজামুল হক এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বজিত হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেন আসামিরা। মৃত্যুদ-প্রাপ্তরা হলেন- রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিঞা টিপু, রাজন তালুকদার ও মীর মোঃ নূরে আলম লিমন। যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্তরা হলেন- এএইচএম কিবরিয়া, ইউনুস আলী, তারিক বিন জোহর তমাল, গোলাম মোস্তফা, আলাউদ্দিন, ওবায়দুর কাদের তাহসিন, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল-আমিন, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, মোশাররফ হোসেন ও কামরুল হাসান। এছাড়া তাদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে অর্থদ-ও দেয়া হয়। এছাড়া বেআইনী সমাবেশের আরেকটি ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওই ১৩ জনকে ছয় মাস করে কারাদ- ও ৫০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। আসামিদের মধ্যে মৃত্যুদন্ডদেশ পাওয়া রাজন ও লিমন এবং যাবজ্জীবনের আসামি ইউনুস, তমাল, আলাউদ্দিন, তাহসিন, ইমরান, আজিজ, আল-আমিন, রফিকুল, পাভেল, কামরুল ও মোশাররফ নিম্ন আদালতে রায়ের সময় পলাতক ছিলেন। বিশ্বজিত দাস হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ ২১ আসামির মধ্যে আটজন কারাগারে এবং বাকিরা পলাতক। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে রাজধানীর পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে খুন করে বিশ্বজিত দাসকে। শাখারী বাজারে বিশ্বজিতের একটি টেইলার্স ছিল। তিনি থাকতেন লক্ষ্মীবাজার। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। এ হত্যার ঘটনায় রাজধানীর সূত্রাপুর থানায় মামলা করা হয়। এ হত্যার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সে আলোকে দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। রায়ে সস্তুষ্ট হতে পারেনি বিশ্বজিতের মা-বাবা শরীয়তপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, আবারও বিশ্বজিতের বাড়িতে কান্নার রোল পড়েছে, রায়ে সস্তুষ্ট হতে পারেনি বিশ্বজিতের পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী কেউ। তারা বলেছে, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আগের রায়ে তারা সন্তুষ্ট ছিল। আগের রায় বহাল রাখার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে তারা। বিশ্বজিতের পিতা অনন্ত দাস বলেছেন, এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সারাদিন রায় শোনার জন্য বাড়িতে বসেছিলাম। কিন্তু যে রায় দেয়া হয়েছে তাতে তারা সন্তষ্ট নয়। আমরা হতভম্ব হয়েছি। আগের রায় বহাল রাখার জন্য ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন তিনি। বিশ্বজিতের মা কল্পনা রানী দাস বলেন, এই রায়ে আমরা মোটেও সন্তুষ্ট নয়। বিশ্বজিতকে যেভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে, সে তুলনায় এই রায় ঠিক হয়নি। আগের রায় ঠিক ছিল। বিশ্বজিতের বোন রুপা আক্তার বলেছেন, এই রায়ে তারা মেনে নিতে পারেনি। তারা আগের রায় বহাল রাখার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান। গত ৯ ডিসেম্বর, ২০১২ সালে ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালে ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে প্রকাশ্যে অবরোধ বিরোধীরা নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর এলাকার অনন্ত দাসের ছেলে ঢাকার শাখারী বাজারের আমন্ত্রণ টেইলার্স ব্যবসায়ী বিশ্বজিত দাসকে। আজকে শরীয়তপুরের সাংবাদিকরা নিহত বিশ্বজিতের ভোজেশ্বরের গ্রামের বাড়িতে গেলে তার বাবা অনন্ত দাস, মা কল্পনা রানী ও বোন রুপা দাসসহ আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা রায় শুনে বিশ্বজিতের শ্মশানের কাছে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সেখানে আজ এক হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়। বিশ্বজিতের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের একটাই দাবি বিশ্বজিত হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দিতে হবে। তাহলে তাদের আত্মা শান্তি পাবে।
×