ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লন্ডনে নিভে গেল ‘বিদ্যুত-বোল্ট’

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৭ আগস্ট ২০১৭

লন্ডনে নিভে গেল ‘বিদ্যুত-বোল্ট’

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ চিতার চেয়েও ক্ষিপ্র, সিংহের মতো সবল- এমন কথাগুলো তার জন্যই প্রযোজ্য। কোনভাবেই দমে রাখা যায়নি তার গতি আর ক্ষিপ্রতাকে। রক্ত-মাংসের মানুষ হয়েও দানবিক ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অবিশ্বাস্য ৯.৫৮ সেকেন্ড টাইমিং গড়ে। জ্যামাইকান সেই স্প্রিন্ট কিংবদন্তি উসাইন বোল্টকে কখনও থামানো যাবে না এমনটাই ছিল সবার বিশ্বাস। কিন্তু তবু তিনি মানুষ, আর মানুষ মাত্রই একদিন থেমে যায়। সেটাই প্রমাণিত হলো। ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপস আসরে এসে অবশেষে হার দেখেছেন বোল্ট। বিশ্ব আসরের ক্যারিয়ারে ১০০ মিটার ফাইনালে এই প্রথম হার। এবার বিশ্ব আসর শেষেই ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ড থেকে অবসর নেবেন, তাই শেষটা সোনা রংয়ে রাঙ্গাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চরম প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিন গ্যাটলিনের কাছে হেরেছেন, এমনকি রৌপ্যটাও জিততে পারেননি। বোল্ট হয়েছেন তৃতীয়। তবে লন্ডন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৬০ হাজার দর্শকরা বোল্টের পক্ষেই সেøাগান দিয়েছেন। আর পরাজয়ের পর প্রতিপক্ষ গ্যাটলিনকে দারুণ একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করে জানিয়েছেন তিনি নিজেও রক্তমাংসের মানুষ। পরাজিত হলেও সর্বকালের সেরা হিসেবে নিজেকে দাবি করেছেন বোল্ট। একটি রূপকথা লেখা হয়ে যেত। ইতিহাস তো কবেই গড়ে ফেলেছিলেন। যেই ইতিহাস লিপিবিদ্ধ করতে হয়েছে বোল্টের জন্য সেটা কখনও মুছে যাবে এমনটাই কেউ ভাবতে পারেন না। তাই বলা যেতে পারে ইতোমধ্যেই যা করেছিলেন সেটা হয়ে গেছে রূপকথা। তবে শেষটা যেভাবে হলো সেটার জন্য ক্যারিয়ারটাকে নিখুঁত একটি রূপকথা হিসেবে আখ্যা দেয়া যাচ্ছে না। ৬০ হাজার দর্শক লন্ডন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে এসেছিলেন ১০ সেকেন্ডের ক্লাইম্যাক্স দেখার জন্য। পলক ফেলার আগেই দিস্তা দিস্তা কাগজে লেখা হয়ে যাবে ইতিহাস। তাই রেস শুরুর আগে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল স্টেডিয়াম। মানুষ নয়, যেন অস্বাভাবিক ক্ষমতাধর কোন অশরীরীÑ তাই তাকে সাধারণ মানুষগুলো ডাকতে শুরু করেছিলেন ‘বিদ্যুত’। নামটি তার সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়। কারণ একটা সময় গবেষকরা ঘোষণা দিয়েছিলেন মানুষের পক্ষে ৯.৭০ সেকেন্ডের চেয়ে কম সময় নিয়ে ১০০ মিটার শেষ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ২০০৯ সালে বোল্ট সেই ধারণাকে পাল্টে দিয়ে ৯.৫৮ সেকেন্ড টাইমিং গড়ে সারাবিশ্বকে বিমূঢ় করে দিয়েছিলেন। সেই অবিশ্বাস্য ইতিহাসের কাছাকাছি তিনি নিজেই যেতে পারেননি। আর বোল্ট যেহেতু থেকেছেন অপরাজেয়, তাই অন্য কারও সেটার ধারে কাছে ভিড়ে যাওয়া তো আরও অসম্ভব। পিনপতন নিস্তব্ধতা আসলো মাত্র ৯.৯২ সেকেন্ড পর। এই টাইমিংটা গড়েছেন যিনি গত ১০ বছর ধরেই বোল্টের সবচেয়ে বড় হুমকি, সেই গ্যাটলিন। ৯.৯৪ সেকেন্ড টাইমিং নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানেও নেই বোল্ট। আরেক মার্কিন তারকা ক্রিশ্চিয়ান কোলম্যান জিতে গেছেন রৌপ্য। তিন নম্বরে জায়গা হয়েছে বোল্টের- টাইমিং ৯.৯৫। অলিম্পিক কিংবা বিশ্ব আসরে নিজের সবচেয়ে বাজে টাইমিং এটাই। এই প্রথম বিশ্ব আসরের ১০০ মিটারে তার প্রথম পরাজয়। ২০১১ সালের বিশ্ব আসরে ফলস স্টার্টের জন্য ফাইনালে অংশ নিতে পারেননি। সেবার জিতেছিলেন গ্যাটলিন। এছাড়া ২০০৯, ২০১৩, ২০১৫ এই তিন বিশ্ব আসরে গ্যাটলিন কিংবা আর কাউকে সুযোগই দেননি বোল্ট। অলিম্পিকেও পারেননি কেউ। তবে এবার নতি স্বীকার করলেন তিনি। কারণ হিসেবে পুরনো সেই সমস্যা ‘ফলস স্টার্ট’কে দুষেছেন তিনি। এবার ১০০ মিটারের হিটেই অস্বস্তিতে ছিলেন তিনি। অষ্টম স্থান নিয়ে কোনক্রমে সেমিফাইনালে উঠেছিলেন। আর তখনও এই শুরুর সমস্যাটাই ভুগিয়েছিল। সেটা ফাইনালে কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। কারণ শেষটা স্বর্ণপদক জেতার তাড়নাটা বাড়তি স্নায়ুচাপ ছিল, এ মৌসুমে তেমন অনুশীলনও করেননি এবং রেসেও নামেননি বোল্ট। অপরদিকে গ্যাটলিনরা ছিলেন ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের নিয়মিত যোদ্ধা। হারলেও বোল্ট কিংবদন্তি হয়েছেন বহু আগেই। টানা তিন অলিম্পিকে স্প্রিন্টের ডাবল জেতা এই এ্যাথলেট তো ‘অমরত্ব’ই পেয়ে গেছেন। তার মতো ট্র্যাকে ঝড় তুলতে পারেনি কেউ। কেউ কখনও করতে পারবেন এমনটাও বিশ্বাস করতে পারেন না প্রাণী গবেষকরা। ক্যারিয়ার জুড়ে ট্র্যাকে গড়ে ঘণ্টায় ২৩ মাইল গতিতে ছুটেছেন। সর্বোচ্চ ২৭ মাইল গতিতেও ছুটেছেন তিনি। ২০০৯ সালে ম্যানচেস্টারে ১৫০ মিটারের এক রেস শেষ করেছিলেন ১৪.৩৫ সেকেন্ডে। সেদিন তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫.৭১ মাইল (৪১.৩৮ কিলোমিটার)। এ গতিতে তিনি ১০০ মিটারের বিশ্ব রেকর্ডের দিনেও ছোটেননি। অবশ্য দর্শকদের আনন্দ দিতে বুক চাপড়ানো কিংবা আশপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে দৌড় শেষ না করলে ১০০ ও ২০০ মিটারের রেকর্ডগুলো চাইলেই আরও ভাল করতে পারতেন। প্রাণিজগতের অনেক গতিধর জীবই দৌড়ে বোল্টের সঙ্গে পেরে উঠবে না। এর মধ্যে টেরিয়ার জাতের কুকুর সবচেয়ে গতিধর হলেও বোল্টের চেয়ে কম গতিসম্পন্ন। পরাজয়ের পর বোল্ট বলেন, ‘আমার স্টার্টিংটা আমাকে মেরে ফেলল। সাধারণত কয়েক রাউন্ড পর এটা ঠিকঠাক হয়ে যায়। কিন্তু এবার সেটা হলো না। এবার আমার মৃত্যুই ঘটাল এটা। কিন্তু আমি বিশ্বকে প্রমাণ দিয়েছি যে আমিই সর্বকালের সেরা এ্যাথলেট। আমি মনে করি না এই পরাজয় সেক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আনবে। এ্যাথলেট হিসেবে আমি আমার যা করার সেটা সেরে ফেলেছি। এই ক্রীড়াকে ওপরের দিকে নিয়ে গেছি, আকর্ষণীয় করেছি। সুতরাং কোনভাবেই আমি এটাকে হতাশার মনে করি না। আমিও মানুষ। সে কারণে পরাজিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে আমি দেখেছি যে গ্যাটলিন খুবই চমৎকার একজন ব্যক্তিত্ব।’
×