ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কুষ্টিয়া শহর বাইপাস সড়ক প্রকল্প ॥ ৫৩ কোটি টাকার প্রকল্প ১৮৪ কোটিতে ঠেকেছে

সাড়ে ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে সাড়ে ৭ বছর!

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৬ আগস্ট ২০১৭

সাড়ে ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে  সাড়ে ৭ বছর!

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল আড়াই বছর। ইতোমধ্যে প্রায় সাত বছর শেষ হয়েছে। এরমধ্যে দফায় দফায় সময় বাড়ানো হয়েছে। তবুও কাগজে কলমে কাজের অগ্রগতি অর্ধেকেরও কম। অথচ এই সময়ে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে প্রায় চারগুণ। এতে রাষ্ট্রের প্রায় দেড়শত কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ও নির্মাণ কাজে গড়িমসির কারণেই বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বারবার সময় ও অর্থ বাড়িয়েও আগামী জুনে শতভাগ অর্থাৎ সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘কুষ্টিয়া শহর বাইপাস সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। এজন্য আরও এক বছর সময়ে চেয়ে প্রকল্পের সংশোধন প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। এদিকে প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি ও ব্যয় নিয়ে অসন্তুষ্ট খোদ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরাও। এ বিষয়ে সড়ক বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা এ নিয়ে কোন বক্তব্য দিতে নারাজ। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, কেন প্রকল্পটি এত বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে এ বিষয়ে খোঁজ নেয়া হবে। যত দ্রুত সম্ভব কাজ এগিয়ে নেয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন তারা। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতে না থাকায় এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি কর্মকর্তারা। সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি সরকারের আমলে বটতৈল এলাকায় কোন রকমের প্রস্তুতি ছাড়াই এই বাইপাস সড়কের উদ্বোধনের নাটক করেছিলেন তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। এরপর প্রকল্পের অগ্রগতি হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর এই শহর বাইপাস নির্মাণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জেলার নেতারা ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। শহরবাসীকে যানজট থেকে রক্ষা দিতে ৬ দশমিক ৬০ কিলোমটিার দীর্ঘ এবং ৭ দশমিক ৩০ কিলোমিটার প্রস্থ কুষ্টিয়া শহর বাইপাস সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে ডিপিপি তৈরি হয়। তাতে ব্যয় ধরা হয় ৫২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আর বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত। সার্বিক দিক বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৫ এপ্রিলে অনুমোদন দেন। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে কুষ্টিয়াবাসী দীর্ঘদিনের দাবি পূরণের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু কাজের কাজ তেমন হয়নি। শুধু ব্যয় বাড়িয়ে বিশেষভাবে সংশোধনী এনে ৫৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ২০১৩ সালের ৮ এপ্রিল তাতে অনুমোদনও দেন। তাতে কাজে গতি আসেনি। আবারও এবার সময় বাড়িয়ে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন জটিলতায় মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই আবারও ব্যয় বাড়িয়ে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা ও সময় বাড়িয়ে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত প্রাক্কলন করে সংশোধনের প্রস্তাব করে সড়ক মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা কমিশনও প্রকল্পটি শেষ করার জন্য ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি একনেক সভায় অনুমোদন দেয়। যার মেয়াদ আগামী মাসে শেষ হচ্ছে। কিন্তু কুষ্টিয়াবাসীর আশায় গুড়েবালি। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জিভূত আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা বা ৪৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। এরমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ, সড়ক বাঁধে মাটির কাজ, নতুন পেভমেন্ট, হার্ডসোল্ডার নির্মাণ, গার্ডার সেতু নির্মাণ, রেলওয়ে ওভারপাস নির্মাণ, আরসিসি বক্স কালভার্টসহ অন্যান্য কাজের আংশিক শেষ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাকি কাজ শেষ করতে আবারও সড়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বা ১০১ শতাংশ। আর বাস্তবায়ন করতে সময় চেয়েছে আরও এক বছর। অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুনে তা শেষ করা হবে। প্রস্তাবিত সংশোধিত প্রকল্পের প্রধান কাজ হিসেবে ধরা হয় ভূমি অধিগ্রহণ ২৩ দশমিক ৮৮ হেক্টর, সড়ক বাঁধে মাটির কাজ ৫ দশমিক ৭০ লাখ ঘনমিটার, নতুন পেভমেন্ট নির্মাণ ৮ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার, সার্ফেসিং বাইন্ডার কোর্স ৮ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার ও হার্ডসোল্ডার নির্মাণ ৮ দশমিক ১৯ কিলোমিটার। এ ছাড়া একটি পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ করা হবে ৪৮ দশমিক ৪৮ মিটার, একটি রেলওয়ে ওভারপাস নির্মাণ করা হবে ১৪৩ দশমিক ৭৭ মিটার। এর বাইরেও কিছু কাজ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তা যাচাই-বাছাই করতে ৩০ এপ্রিল পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ২ বছর ৬ মাসের জায়গায় ৭ বছর ৬ মাস সময় লাগায় অর্থাৎ দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়ে এবং বেশি ব্যয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হয়। একই সঙ্গে নতুন অঙ্গ হিসেবে ইউটিলিটি শিফটিং এবং ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্স সমন্বয় খাত অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এসব সংশোধন করে সংশোধিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে খুব শীঘ্রই একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হবে বলে সূত্র জানায়। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৪৮ শতাংশেরও কম। তাই আবারও একবছর সময় অর্থাৎ ২০১৮ সালের জুনে শেষ করার জন্য প্রকল্পটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধনের প্রস্তাব করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তাতে ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি অর্থাৎ ১০১ শতাংশ করা হয়েছে। তা যাচাই-বাছাই করতে সম্প্রতি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। আড়াই বছরে কাজটি শেষ করার কথা থাকলেও সাড়ে ৭ বছর সময় লাগায় সভায় প্রশ্ন তোলা হয়। এত বিলম্বের কারণও জানতে চাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া-পাকশী-দাশুরিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়ক। যা কুষ্টিয়া শহরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। এ মহাসড়কে প্রতিদিন অসংখ্য পণ্যবাহীসহ বিভিন্ন ধরনের যানবহন চলাচল করে। এছাড়া মংলাবন্দরসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলার মালবাহী ট্রাকসহ অসংখ্য যানবাহন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় এ সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে। তাই এ সড়কটিতে প্রচ- যানজটের সৃষ্টি হয়। শহরে প্রতিনিয়তই যানজটের সৃষ্টির পাশাপাশি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া মজমপুরে রেল গেটে ট্রেন চলাচলের সময় গেট বন্ধ থাকায় যানজট মারাত্মক আকার ধারণ করে। তবুও সমস্যার কোন সঠিক দিশা হয়নি। তবে প্রকল্প পরিচালক ও খুলনা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রুহুল আমিন সাংবাদিকদের বলেন, কাজের অগ্রগতি ভাল হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। আগামী অর্থবছরে পুরো কাজ শেষ হয়ে যাবে। সড়কটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর।
×