ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদিতে ৩ স্টেশনে অদক্ষ পাকি কোম্পানিকে জিএসএ করছে বিমান?

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৬ আগস্ট ২০১৭

সৌদিতে ৩ স্টেশনে অদক্ষ পাকি কোম্পানিকে জিএসএ করছে বিমান?

আজাদ সুলায়মান ॥ এবার পাকিস্তানী কোম্পানিকে জিএসএ দেয়ার সব আয়োজন চূড়ান্ত করেছে বিমান। বিতর্কিত ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে অদক্ষতা, অযোগ্যতা ও জঙ্গী অর্থায়নের মতো অভিযোগ থাকার পরও একটি প্রভাবশালী মহল এখন আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে। ইতোমধ্যে ঢাকায় এসেছে পাকিস্তানী কোম্পানির এক প্রতিনিধি। অথচ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আপত্তি থাকার পরও মামাস নামের ওই কোম্পানিকে দ্রুত কাজ দেয়ার জন্য আগামী মঙ্গলবারের পর্ষদ সভার এজেন্ডাভুক্ত করা হয়েছে। এতে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে খোদ বিমানের শীর্ষ মহলে। জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জনকণ্ঠকে বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মামাসকে কাজ দেয়ার পক্ষে নই। এটা তো হওয়ার কথা নয়। এখন বিষয়টি বিমান পর্ষদে পাঠানো হবে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান চেয়ারম্যান এয়ারমার্শাল ইনামুল বারী জনকণ্ঠকে বলেন, কোন তদ্বিরের কথা আমি বলতে পারব না। পর্ষদে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। যেটা বিমানের জন্য মঙ্গল হবে সেটাই করা হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদও একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন, আমি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না। সিদ্ধান্ত যা নেয়ার বোর্ড মিটিংয়েই নেয়া হবে। জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরবে বাংলাদেশ বিমানের তিনটি স্টেশনের জিএসএ (জেনারেল সেলস এজেন্ট) হিসেবে পাকিস্তানী একটি কোম্পানিকে কাজ দেয়ার তদ্বির চলছে। শক্তিশালী চক্রের জোরে ইতোমধ্যে এ বিষয়ে ফের চিঠি চালাচালি শুরু হয়েছে। পাকিস্তানী কোম্পানিটির নাম মামাস। অভিযোগ উঠেছে বিমান ও মন্ত্রণালয়ের একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট এ তদ্বির চালাচ্ছে। পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। এদের অন্যতম বিমানের এক জিএম এবং জিএসএ সংক্রান্ত বোর্ড সাবকমিটির এক প্রভাবশালী মেম্বার যিনি প্রকাশ্যেই মামাসের পক্ষ নিয়ে প্রভাব বিস্তার করছেন। ইতোমধ্যে রিয়াদ থেকে সায়মন নামে এক ব্যক্তি ঢাকায় এসে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলে প্রকাশ্যে তদ্বিরে নেমে বিষয়টি পাকাপোক্ত করে ফেলেছে বলেও বিমানের এক পরিচালক জানিয়েছেন। ওই পরিচালক জানান, সম্প্রতি বিমানের এক পর্ষদ সভায় মামাস নামের এ কোম্পানিকে সৌদি আরবের জেদ্দা, রিয়াদ ও দাম্মাম স্টেশনে জিএসএ নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিমান পরিচালনা পর্ষদ গঠিত বোর্ড সাবকমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে মামাসকে জিএসএ হিসেবে নিয়োগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, মামাসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা তদন্তে প্রমাণিত। এরপরই বিমান পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে। মামাসকে জেদ্দা, রিয়াদ ও দাম্মামের জিএসএ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানানো হয়েছে। জানা গেছে, পর্ষদ সভায় মামাসকে জিএসএ নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্তের পরপরই এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। হজের সময় পাকিস্তানী নাগরিকের মালিকানাধীন একটি জিএসএ কোম্পানিকে একসঙ্গে সৌদি আরবের তিন স্টেশনে নিয়োগ দেয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। এ অবস্থায় মামাসের বিরদ্ধে অভিযোগ জানানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। এ ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত এক সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্তে মামাসের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ প্রমাণিত। এরপরই বিমান কর্তৃপক্ষ মামাসকে কার্যাদেশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সম্প্রতি রহস্যজনক কারণে মন্ত্রণালয়ের এই তদন্ত রিপোর্টকে পাশ কাটিয়ে একটি সিন্ডিকেট আবারও মামাসকে নিয়োগ দেয়ার জন্য জোর তদ্বির শুরু করেছে। তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, মামাস নামে যে কোম্পানিকে বিমান জিএসএ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ওই কোম্পানির মালিক একজন পাকিস্তানী । এ ছাড়া বিমানের সবচেয়ে বড় স্টেশন জেদ্দা, রিয়াদ ও দাম্মাম স্টেশন পরিচালনা করার মতো অভিজ্ঞতাও নেই মামাসের। জেদ্দায় তাদের কোন নিজস্ব অফিস নেই। নামসর্বস্ব একটি অফিস থাকলেও সেখানে বাংলাদেশী কোন স্টাফ নেই। একমাত্র ইন্দোনেশিয়ার একটি ছোট এয়ারলাইন্সের জিএসএ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাদের। তাছাড়া আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী জিএসএ হতে হলে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) সদস্য হতে হয়। কিন্তু মামাস এখনও আয়াটার সদস্য হতে পারেনি। এ অবস্থায় তদন্ত কমিটি তাদের সুপারিশে মামাসকে সৌদি আরবে বিমানের ৩টি বড় স্টেশনের জিএসএ হিসেবে নিয়োগ না দেয়ার সুপারিশ করে রিপোর্ট প্রদান করে। এ ছাড়া একটি কোম্পানিকে একসঙ্গে তিনটি বড় স্টেশনের জিএসএ নিয়োগ দেয়ার রেকর্ডও বিমানের ইতিহাসে নেই। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিমান মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ মামাসকে নিয়োগের বিষয়টি স্থগিত করে দেয়। এরপর ৩ স্টেশনে কর্মরত বর্তমান জিএসএর মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের চুক্তির মেয়াদ আরও ৩ মাস বর্ধিত করে। বর্তমানে জেদ্দা স্টেশনে জিএসএ হিসেবে কাজ করছে এলাফ এভিয়েশন আর রিয়াদ ও দাম্মাম স্টেশনে কাজ করছে এসিই নামে একটি কোম্পানি। বিমানের এক পরিচালক জানান, এ বছর বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ মিলে ১ লাখ ২৭ হাজার হজযাত্রী পরিবহন করবে। এর মধ্যে বিমান পরিবহন করবে ৬৫ হাজারের বেশি হজযাত্রী। এ অবস্থায় যদি একটি বিতর্কিত ও অদক্ষ কোম্পানিকে জেদ্দা, রিয়াদ ও দাম্মামের জিএসএ নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে হজযাত্রী পরিবহনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা ছিল। যে কোন ধরনের স্যাবোটাজ হওয়ারও আশঙ্কাও রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে মামাস বিমানের স্টাফদের পক্ষে জরুরী মুহূর্তে সৌদি আরবের ভিসা করিয়ে দেয়ার মতো কোন ধরনের যোগ্যতা নেই। এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে রিয়াদের মতো সবচেয়ে লাভজনক একটি স্টেশনের জিএসএ দেয়া হলে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে বলে জানিয়েছেন একাধিক বিমান কর্মকর্তা। অভিযোগ আছে, বিমানের একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট নানা কৌশলে বিমানের বিভিন্ন স্টেশনে তাদের পছন্দের জিএসএ নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা চালায়। এ চক্রটিই মামাসকে আবারও ওই তিন স্টেশনের জিএসএ নিয়োগ দেয়ার জন্য বিমান মন্ত্রণালয়ে তদ্বির শুরু করেছে। এ সম্পর্কে বিমান সূত্র জানিয়েছে, মামাসের মতো একটি অযোগ্য ও বিতর্কিত কোম্পানিকে কাজ দেয়া হলে বিমানকে অনেক বড় খেসারত দিতে হতে পারে। এজন্য বিমানের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কিছুটা উদ্বিগ্ন হলেও প্রভাবশালী চাপের মুখে তারা অসহায়। কারা এই চাপ দিচ্ছে জানতে চাইলে বিমানের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে অফিসিয়াল চিঠি দিয়ে মামাসের পক্ষে প্রকাশ্যে নগ্ন তদ্বির করা হয়েছে; যা একটা দরপত্র প্রক্রিয়ায় সরাসরি হস্তক্ষেপের শামিল। এটা কিছুতেই মেনে নেয়ার মতো নয়। এ অবস্থায় আগামী মঙ্গলবার বিমানের পর্ষদ বৈঠকের আগে মামাস ঢাকায় পাঠিয়েছে সায়মন নামে এক প্রবাসী বাংলাদেশীকে। তিনিই মূলত এ্খন বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাঁপ করছেন। আগামী মঙ্গলবার পর্ষদ বৈঠকের আগেই সায়মনকে বিমানের এক কর্মকর্তার সঙ্গে বলাকায় প্রকাশ্যে শলাপরামর্শ করতে দেখা গেছে। ওই কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর তাকে রিয়াদে মামাস কোম্পানিতে ৩ হাজার ডলারে চাকরি প্রদানের আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। সম্ভবত ওই প্রলোভনেই তিনি এখন প্রকাশ্যেই মামাসের গুণগান করছেন। এ বিষয়ে এয়ারমার্শাল ইনামুল বারী বলেছেন, কেউ কোন তদ্বির করেছে কিনা তা আমার জানা নেই। বিমান কারও তদ্বিরের কাছে মাথা নত করবে না । দেখুন পর্ষদের বৈঠকে কি ঘটে- আগে থেকে কিছু বলতে চাই না।
×