ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাটির ফলক চিত্র, নক্সা-বৈচিত্র্যময় জীবনগাথা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৬ আগস্ট ২০১৭

মাটির ফলক চিত্র, নক্সা-বৈচিত্র্যময় জীবনগাথা

নওগাঁর ধামইরহাটের আগ্রাদ্বিগুণ ‘জগেরধাপ’ খননে বেরিয়ে আসছে প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। শত শত বছরের বরেন্দ্র সভ্যতা যেন চাপা পড়ে আছে মাটির নিচে। পাল যুগের একাদশ শতকের সম্রাট ধর্মপাল এটি নির্মাণ করেন বলে ধারণা। রাজা ধর্মপাল ও পরে রাজা দ্বারকানাথ এখানে শাসন ও বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। কেউ বলে ঢিবি, কেউ বলে জগের ধাপ, কেউ বলে জৈন ঢিবি। এই ধাপের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। উত্তরে গঙ্গা, দক্ষিণে মনোহর গঙ্গা দিয়ে আত্রাই নদীতে মিলিত হয়েছে নদীটি। বর্তমান গঙ্গা-যমুনা বিলুপ্ত হয়ে ফসলী জমিতে পরিণত হয়েছে। বিরাট অঞ্চলজুড়ে ইটপাটকেল, পাথর, সুবিন্যস্ত ধ্বংসস্তূপের নিদর্শন বিদ্যমান। দক্ষিণে ধাপের মাঝখানে বিহার। উচ্চতা ৬৬ ফুট। আয়তন ৫২ হাজার আটশ’ বর্গফুট। খননকালে বিহারের দেয়ালগুলোতে মাটির ফলক চিত্র, ইটের খোদাই করা নক্সা বেরিয়ে আসছে। পাথরগুলোর দৈর্ঘ্য সাড়ে তিন ফুট, প্রস্থ দেড় ফুট। সাধারণ মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনগাঁথা চিত্রিত রয়েছে এই বিহারে। বিহারের পাশে অনেক স্থাপত্যের নির্দশন মিলেছে। নওগাঁ জেলা প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ প্রাচীন সভ্যতার অসংখ্য নিদর্শন অপূর্ব শিল্প, সুষমাম-িত। ‘আগ্রার জগের ধাপ’ নামে পরিচিতি রয়েছে এলাকাবাসীর কাছে। আগ্রাদ্বিগুণের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় সুউচ্চ একটি পাহাড়ের চূড়া, প্রকৃত মৌজা কাশিপুর। আগ্রাদ্বিগুণ নামে কোন মৌজা নেই এখানে। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় লোকচক্ষুর অন্তরালে যুগ যুগ ধরে লুকায়িত মাটির নিচে এই বিহারটি দেখতে পাহাড়ের মতো। এখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন হলেও কিছু বিদ্যমান আলামত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রতœতাত্ত্বিকরা জরিপ চালিয়ে খনন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানটির নামকরণ সম্পর্কে কিংবদন্তি রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে এক ম্যাজিস্ট্রেট এই এলাকায় অনুসন্ধান চালাতে এসে এক সাধককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আগ্রা কতদূর’? উত্তরে সাধক বলেন, ‘যতদূর এসেছেন, তার দ্বিগুণ’। তখন থেকে এখানকার নামকরণ হয় ‘আগ্রাদ্বিগুণ’। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ইংরেজ প্রতœতাত্ত্বিক স্যার বাকানুন হ্যামিল্টন বলেছেন, এটি একটি বিহার। সমতল ভূমি থেকে উচ্চতা ৬৬ ফুট, পূর্বে ৫শ’ মিটার দূরে পাথরঘাটা দীঘি। উত্তরে ৬০ ফুট দূরে আরও একটি দীঘি, যার নাম দ্বারকাদীঘি। দক্ষিণে অপর একটি দীঘি, যার নাম সাংগায়িল দীঘি। জনশ্রুতি আছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে তীব্র খরার কারণে প্রজাদের মঙ্গলের জন্য কয়েকটি দীঘি খনন করা প্রয়োজন বলে জানান রাজকুমারী। পাল বংশের রাজকুমারীর এমন প্রস্তাব মতো দীঘিগুলো খনন করা হয়েছিল। ওই রাজকুমারী প্রতিদিন একটি করে দীঘিতে ¯œান করতেন। দক্ষিণে এক কিমি দূরে আগ্রা। উত্তরে ১ কিমি দূরে দ্বিগুণ, মাঝখানে কাশিপুর। প্রতœতত্ত্ববিদরা জানান, ধাপের আলামত হিসেবে পোড়ামাটি, পুতুল, মোমবাতির দিয়ার, চেরাগ, চৌকনবিশিষ্ট ইট, খোদাই করা কালো পাথর, দৈর্ঘ্য ৪ ফুট, প্রস্থ দেড় ফুট এবং হলুদ রঙের মাটি পাওয়া যায়। পাহাড়ের চূড়ায় চারকোন ছাদবিশিষ্ট কক্ষ, মাত্র দুই ফুট খনন করেই পাওয়া যায় ওইসব আলামত। ইট পাথরের দেয়াল, ছাদের মাঝখানে কালো পাথরগুলো প্রতœতত্ত্ববিদরা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। খনন কাজ অব্যাহত রয়েছে। এপ্রিলে এই জগের ধাপর খনন কাজের উদ্বোধন করেন প্রতœতাত্ত্বিক বিভাগের পরিচালক মোসা. নাহিদ সুলতানা। তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের ইনচার্জ মোঃ সাদেকুজ্জামান, মহাস্থানগড়ের সহকারী ইনচার্জ এসএম হাসনাত বিন ইসলাম, ফিল্ড অফিসার হাসিবুল হাসান (সুমি) প্রমুখ। সার্ভেয়ার লোকমান হোসেন জানান, ধাপের চারপাশ ইট, পাথর, দীঘি, নালা, নদীসহ প্রায় চার বর্গ কিমি জুড়ে রয়েছে শিলাখ-। রাজা ধর্মপাল ১০৭০-১১২০ শতকে এটি নির্মাণ করেন। চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে তোলে। এই অঞ্চলের মানুষ হিন্দু ধর্মানুরাগী ছিলেন। ধর্মপাল আগ্রাদ্বিগুণ ধাপে বৌদ্ধমন্দির ও বিহার স্থাপন করেন। ১৮ শতকের দিকে জেনারেল কানিংহাম স্থানটি পরিদর্শন করেন। কলকাতা থেকে এসে শিক্ষার্থীরা এ বিহারে লেখাপড়া করত। সম্রাট আকবরের দরবারী আবু ফজল প্রণীত আইন-ই-আকবরিতে উল্লেখ করেন, সেখানে রামাবতি ও মুসলিম ধর্মীয় মসজিদ শৃঙ্খলায় চলেছিল। এখানে মুসলিম সাধক ছিলেন। ১৭ জন পাল বংশীয় রাজা ছিলেন। ধর্মপালের পতন হলে রাজা দ্বারকানাথ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ধাপের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মাত্র ১৫০ ফুট দূরে ইসলাম ধর্ম প্রচারক সাধকের সমাধি রয়েছে। ভবিষ্যতে এটিও হতে পারে একটি দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্র। ধামইরহাট আমাইতাড়া থেকে পশ্চিমে ১৩ কিমি, পতœীতলার মধইল মোড় থেকে উত্তরে ৭ কিমি, সাপাহার থেকে পূর্বে ১৩ কিমি দূরে আগ্রাদ্বিগুণ বৌদ্ধবিহার অবস্থিত। আগ্রাদ্বিগুণ বিহার থেকে ৭ কিমি পূর্বে আত্রাই নদীর তীরবর্তী ধ্বংসাবেশ মহীপালের রাজ প্রসাদ (মাহীসন্তোষ)। আরও ১৫ কিমি পূর্বে জগদল রামপালের বৌদ্ধবিহার। এর দক্ষিণে পাঁচ কিমি দূরে চান্দিরা-আমাইড়-যুগীর ঘোপা। আগ্রাদ্বিগুন থেকে পাঁচ কিমি দক্ষিণে দিবর দীঘিতে কৈবর্ত্য রাজা দিব্যকের দিব্যক জয়স্তম্ভ। এখান থেকে ২৩ কিমি পূর্বে দিব্যকের ভ্রাতুষ্পুুত্র ভিমের পান্টি (মঙ্গলবাড়ী)। এখান থেকে দক্ষিণে ২০ কিমি পূর্বে পাহাড়পুর (সোমপুর বৌদ্ধবিহার) বৌদ্ধ বিহার অবস্থিত।
×