ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

এরদোগানের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন লৌহমানবী আকসেনার

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ৬ আগস্ট ২০১৭

এরদোগানের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন লৌহমানবী আকসেনার

তুরস্কের লৌহমানবী বলে পরিচিত মেরাল আকসেনারের ওপর আজ দেশের গণতন্ত্রকামীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ। কারণ, প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানকে তিনি চ্যালেঞ্জ করার জন্য তৈরি হচ্ছেন যার প্রতি এক বড় ধরনের রাজনৈতিক হুমকিতে পরিণত হতে পারেন তিনি। মেরাল আকসেনার লড়াইয়ের ময়দান থেকে কেটে পড়েন না। এক সময় তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৭ সালে সামরিক বাহিনী সরকার অপসারণের পদক্ষেপ নিলে তিনি সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এক জেনারেল তাকে শূলে চড়ানোর হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু তাকে তার অবস্থান থেকে টলানো যায়নি। এই মানুষটিই আজ তুরস্ক গণতন্ত্রের পতন রোধ করতে পারে বলে তার সমর্থকরা আশা করেন। ঘোরতর জাতীয়তাবাদী আকসেনার প্রেসিডেন্ট এরদোগান প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে জোর ‘প্রচারাভিযান’ শুরু করেছেন। প্রেসিডেন্ট এরদোগান বর্তমান পার্লামেন্ট পদ্ধতির সরকারের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন যা প্রেসিডেন্টকে করেছে সর্বশক্তিধর। এ লক্ষ্যে গত ১৬ এপ্রিল গণভোট হয়েছে এবং তাতে এরদোগান অল্প ব্যবধানে বিতর্কিত বিজয় লাভ করেছেন। আকসেনার ওই গণভোটে ‘না’ ভোট দেয়ার জন্য প্রচারাভিযান চালান। ২০১৯ সালে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তাতে এরদোগানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তিনি দাঁড়াবেন বলে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে। জানা গেছে, তিনি নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করার কথা ভাবছেন। তিনি বলেন ‘আমি এরদোগানের ঘুম হারাম করে দেব। কারণ, তিনি জানেন আমিই সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী।’ এরদোগান সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস খুব কম জনেরই আছে। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে সব শুদ্ধ ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে এরদোগান বিরোধিতার প্রায় প্রতিটি উৎস দমন করেছেন। নিজ দলের অন্যান্য নেতাকে কোণঠাসা অবস্থায় রেখেছেন। বিরোধী পার্লামেন্ট সদস্যদের জেলে পুড়েছেন এবং সমালোচনাকারী সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছে। এসব যেমন করেছেন তেমনি আবার বেশ কিছু নির্বাচনে জয় লাভও করেছেন। এসব করে তিনি রাজনীতির এমন এক মডেল তৈরি করেছেন যার সঙ্গে ২০১৬ সালে ইউরোপ ও আমেরিকায় সৃষ্ট রক্ষণশীল মার্কা লোকরাঞ্জনবাদী জোয়ারের মিল আছে। ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তুরস্কে ব্যর্থ ও রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পর দমন-নিপীড়ন তীব্রতর রূপ ধারণ করে। এ পর্যন্ত ৫০ হাজারেরও বেশি লোককে আটক করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ছাত্র ও সিভিল সার্ভেন্ট রয়েছে। হালে এই দমন অভিযান জোরদার হয়েছে। জুলাই মাসে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের স্থানীয় ডিরেক্টরসহ ১০জন মানবাধিকার কর্মীকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে জুন মাসে ডজনখানেক বিরোধীদলীয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের মধ্যে এক পার্লামেন্ট সদস্যকে ২৫ বছর জেল দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে তুরস্কের সর্ববৃহৎ বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা কামাল কিলিকদারোগলুর নেতৃত্বে আঙ্কারা থেকে ইস্তানবুুল পর্যন্ত ২৮০ মাইল বিক্ষোভ মিছিল ও পরিশোধে ইস্তানবুুলে ৯ জুলাই এক বিশাল সমাবেশ হয়। এত বড় বিক্ষোভ সমাবেশ গত কয়েক বছরে কখনও হয়নি। তবে এরদোগানের প্রতি সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টির ক্ষমতা কিরিকদারোগলু বা তার সেক্যুলার দল সিএইচপির নেই। ১৫ বছর ধরে দলটি একটা জাতীয় নির্বাচনেও জিততে পারেনি। সেদিক দিয়ে এরদোগানের প্রতি সত্যিকারের হুমকি হতে পারেন আকসেনার। কারণ, তার রাজনীতির প্রতি ব্যবসায়ী শ্রেণী, ধর্মীয় লোকজন ও জাতীয়তাবাদী ভোটার সবারই সমর্থন আছে। শুধু তাই নয়, এরদোগানের সাংবিধানিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ব্যাপারে তিনি যেভাবে বিরোধিতা করে চলেছেন তাতে ক্ষমতাসীন জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) অসন্তুষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত সদস্য এমনকি কিছু বামপন্থী ভোটারদেরও সমর্থন পাচ্ছেন তিনি। অনেকেই বলছেন যে, এরদোগানের প্রতি তিনি মস্তো রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। আকসেনার তুরস্কের মধ্য-ডান ভোটারদের কাছে যেমন আকর্ষণীয় প্রার্থী হতে পারেন। তেমনি এরদোগানও একেপির ভোটারদের টেনে নেয়ার ক্ষমতাও তার আছে। আকসেনারের জন্ম ১৯৫৬ সালে। ১৯৯৫ সালে তিনি সেক্যুলার রক্ষণশীল ট্র পাথ পার্টির সদস্য হিসেবে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন। দু’বছর পর সামরিক বাহিনী সরকারকে চরমপত্র দিয়ে তিনি তখনকার রাজনৈতিক অঙ্গনে মুখ্য কুশীলব হয়ে দাঁড়ান। সে সময় তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি সেনা অভ্যুত্থানের হুমকির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। অবশ্য এরদোগানের মতো আকসেনারও রক্ষণশীল। দেশে ৩০ লাখ সিরীয় উদ্বাস্তুর উপস্থিতি নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি তার মনোভাব কঠোর। অতীতে তিনি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) জঙ্গীদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৯৭-এর অভ্যুত্থানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হওয়ার এক দশক পর আকসেনার ডানপন্থী ন্যাশনালিস্ট এ্যাকশন পার্টির (এমএইচপি) সদস্য হিসেবে পার্লামেন্টে পুনর্নির্বাচিত হন। তাকে ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেত্রী মেরিন লা পেনের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। তবে তিনি এই তুলনা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘আমরা বর্ণের ভিত্তিতে রাজনীতি করি না।’ এরদোগানের আবেগভিত্তিক লোকরঞ্জনবাদের বিপরীতে তিনি প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির প্রতি অবিচল আনুগত্য পোষণ করে থাকেন। তিনি বলেন, ‘এরদোগানের বিশ্ব সাদা ও কালো, আমি ন্যায় অন্যায়ের শাসনে বিশ্বাস করি না। আমি আইনের শাসনে বিশ্বাসী।’ তিনি মহিলাদের প্রতি এরদোগানের সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেন। বলেন, ‘উনি আমাদের ঘরের ভেতর রাখতে চান।’ আকসেনার দুটি মেয়াদ পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। তিনি ডেপুটি স্পীকারও হন। ২০১৬ সালে এরদোগানের সংবিধান পরিবর্তনের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে এমএইচপি নেতাদের সঙ্গে তার মতান্তর ও বিচ্ছেদ ঘটে। প্রেসিডেন্টকে তার দলের সমর্থন ঘোষণায় শামিল না হয়ে তিনি তার এই ত্যাগের বিরোধিতায় নামেন এবং পার্টি নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন ও দল থেকে বেরিয়ে যান। আকসেনার এখন নতুন ব্যানারে দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ভাবছেন। তবে নিখুঁত রাজনৈতিক প্রার্থী বলতে যা বোঝায় তিনি তা নন। সরকারের মন্ত্রী হিসেবে তার যে অভিজ্ঞতা আছে এটাই তার সম্বল এবং সেটাকে তিনি তার বিশেষ সুবিধা হিসেবে দেখেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সেলিম সাজাকের ভাষায় আকসেনার হচ্ছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন। এরদোগানকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বৈধতা থাকা প্রার্থী তুরস্কে হাতেগোনা ক’জন আছে। এরদোগানের দলে বিরুদ্ধবাদী নেতা যারা আছেন তারা তাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য সামনে এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যরা বিরোধিতার জন্য চরম মূল্য দিয়েছেন। যেমন কুর্দিপন্থী পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এইন ডিপি) জনপ্রিয় নেতা সেলাহাতিন ডেমিরটাস এখন সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে কারাগারে। তার দলের আরও ১০ জন এমপিকে গত নবেম্বরে গ্রেফতার করা হয়। আকসেনার নিজেরও যে সরকারের রোষানল থেকে মুক্ত থাকতে পারছেন তা নয়। সরকারপন্থী মিডিয়া তার সমালোচনায় মুখর থাকে। তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘৃণ্য অপপ্রচার চালায়। হত্যার হুমকিও তিনি পেয়েছেন কয়েকবার। এসব কিছুকে তাকে ভীতসন্ত্রস্ত করার সাজানো অভিমান বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাস থেকে ওরা আমাকে পিঠটান দিতে বাধ্য করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। কিন্তু পারেনি। বিরোধীদলীয় নেতারা মনে করেন যে সরকার আকসেনারকে থামানোর কোন না কোন উপায় বের করবেই। সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসোবে কারোর নাম একবার উল্লেখ করা হলেই এসব গু-া-বদমাশ ও মিডিয়ার লোকজনকে তাকে হেনস্তা ও অপদস্থ করার জন্য লেলিয়ে দেয়া হয়। আকসেনার এসব বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠে শেষ অবধি এরদোগানের মুখোমুখি হবেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। সূত্র: টাইম
×