ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কে এম এনায়েত হোসেন

বঙ্গবন্ধু ॥ বাংলার এভারেস্ট

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ৬ আগস্ট ২০১৭

বঙ্গবন্ধু ॥ বাংলার এভারেস্ট

বঙ্গবন্ধুকে দেখলে বাংলাদেশ দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুকে জানলে বাংলাদেশকে জানা হয়। আমরা যারা বাংলাদেশের জন্মের প্রসব বেদনার ব্যথা কিঞ্চিত হলেও সহ্য করেছি, ’৭১-কে প্রত্যক্ষ করেছি সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সঙ্গে, তাদের কাছে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু এমনই, যেমনটি বলেছি শুরুতে। এ প্রত্যয়ের ব্যতিক্রমী ধারণার লোক যে একেবারেই ছিল না তা নয়। তখনও ছিল, এখনও আছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ধর্মের নামে যা কিছু অধর্মের, অন্যায়ের, অপরাধের তার কোনটাই করতে বাকি রাখেনি সে সময়ে। তারা বাঙালী হয়েও যুদ্ধ করেছে পাকিস্তানীদের পক্ষে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়েছে তারা। জয় হয়েছে বঙ্গবন্ধুর, বিজয় হয়েছে বাংলাদেশের, বিজয়ী হয়েছে সাড়ে সাত কোটি, আজকের ষোলো কোটি জনসংখ্যার বাঙালী। বাঙালী জাতির এই বিজয়ের সংগ্রাম একদিনের নয়, এক যুগের নয়, এক শতাব্দীরও নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এক বহতা নদীর মতো চলে এসেছে বাঙালী জাতির নিরন্তর সংগ্রামের এই অপ্রতিরোধ্য ধারা। কখনও চলেছে খরতর স্রোতস্বিনীর বেগে, কখনওবা ধীর লয়ে। কিন্তু থেমে যায়নি কখনও একেবারেই। সুদূর অতীতে না গিয়ে বলা যায় এর সূত্রপাত এখন থেকে কিঞ্চিত অধিক আড়াইশ’ বছর পূর্বে পলাশীর আম্রকাননে। তারিখটা ২৩ জুন, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ। যুদ্ধের নামে একটা যুদ্ধাভিনয় হলো। দেশের পক্ষে নবাব মনসুরুল মুলক সিরাজদ্দৌলা শাহকুলি খাঁ মির্জা মহম্মদ হায়বৎজঙ্গ বাহাদুর। দেশবাসীর কাছে নবাব সিরাজদ্দৌলা নামে সমধিক পরিচিত। মাত্র কিছুকাল অর্থাৎ কিঞ্চিত অধিক চৌদ্দ মাস পূর্বে পরলোকগত নবাব আলিবর্দী খাঁর স্নেহধন্য দৌহিত্র চব্বিশ বছরের স্বাধীনচেতা, তেজোদীপ্ত এক যুবক, নবাবী মসনদে বসার পনেরো মাস যেতে না যেতেই তরুণ এই নবাবকে যুদ্ধসাজে সাজতে হয় দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ত্ব রক্ষার প্রয়োজনে। নবাব পক্ষে পদাতিক, অশ্বারোহীসহ পঞ্চাশ হাজার সৈন্য। অপর পক্ষে ক্লাইভের নেতৃত্বে তিন শ’ সৈন্য নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নবাব পক্ষের মীরজাফরসহ বেশিরভাগ সৈনাধ্যক্ষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে যুদ্ধের মজা দেখলেন। প্রকৃত যুদ্ধ করলেন সৈনাধ্যক্ষ মোহনলাল, মীর মর্দান, সিনফ্রে প্রমুখ। মীরজাফর, জগৎশেঠ, উমি চাঁদ, রাজা রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ খান প্রমুখের ষড়যন্ত্র এবং যুদ্ধের ময়দানে নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে যুদ্ধে নবাব হেরে গেলেন। অস্তমিত হলো বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। উদিত হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের লোভ-লেলিহান সূর্য। কবিগুরু রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়, ‘বণিকের মানদ- পোহালে শর্বরী, দেখা দিল রাজদ- রূপে।’ সে রাজদ- ব্যবহৃত হতে থাকল ভারতবর্ষকে অবাধ লুণ্ঠনের হাতিয়ার হিসেবে। অথচ জনৈক ব্রিটিশ ঐতিহাসিকের মতে, ‘সেদিন পলাশীর প্রান্তরে নবাব পক্ষে যে সৈন্য সমাবেশ ছিল তারা যদি শুধু সাধারণভাবে ক্লাইভের সৈন্য দলের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে চাইত তা-ই হতে পারত ক্লাইভের সৈন্য দলকে পদদলিত এবং পর্যুদস্ত করার জন্য যথেষ্ট।’ মীরজাফর গং স্ব-স্ব লাভ, লোভ এবং সঙ্কীর্ণ স্বার্থে বিক্রি করল বাংলা তথা পর্যায়ক্রমে গোটা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব। সিরাজদ্দৌলার নশ্বর দেহ হলো খ-িত বিখ-িত। সবার অলক্ষ্যে বাংলার প্রথম শহীদের রক্তসিঞ্চনে অঙ্কুরিত হতে শুরু করল স্বাধীনতার বীজ। এরই ধারাবাহিকতায় কত শত সহস্র মায়ের অশ্রু আর জানা-অজানা অসংখ্য বীরের ভক্তি, ভালবাসা, দেশপ্রেম, ত্যাগ আর রক্তধারায় সিক্ত, কণ্টকিত রাজপথ পেরিয়ে আমরা এসে উপনীত হই বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। হ্যাঁ, বাঙালী জাতির জন্য বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ যেমন মহাগৌরবের তেমনি মহাকলঙ্কেরও। এই সময়টাতেই অর্থাৎ ষাটের দশকে একজন শেখ মুজিব তার গভীর দেশপ্রেম, অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা আর অসীম সাহসিকতার বলে হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। তার দেয়া ছয় দফায় মূর্ত হয়ে উঠল বাঙালী জাতির প্রাণের চাওয়া। সে চাওয়াকে পাওয়ায় রূপান্তরিত করতে বঙ্গবন্ধুু চষে বেড়ালেন বাংলার শহর, বন্দর, নগর, গ্রাম, পাড়া, মহল্লা সব। তার বজ্রকণ্ঠের তেজোদীপ্ত ভাষণ আর বিশাল হৃদয়ের আবেগ সঞ্চারিত হতে থাকল হৃদয় থেকে হৃদয়ে, ঘর থেকে ঘরে, জন থেকে জনে আর মন থেকে মনে। এমনি একটা সময়ে সত্তরের প্রাক নির্বাচনী প্রচারণায় বঙ্গবন্ধুকে অতি কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার মাটিভাঙ্গা কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধুর সভা। আমরা মিছিল করে থানা সদর থেকে পৌঁছেছি কলেজ মাঠে। সঙ্কীর্ণ রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধ হয়ে আমরা অগুণতি মানুষ অপেক্ষা করছিলাম বঙ্গবন্ধুর আগমনের। তিনি এলেন। দীর্ঘ ঋজু দেহের বঙ্গবন্ধু কপালে হাত ওঠাতে ওঠাতে এগিয়ে চললেন মঞ্চের দিকে। মাত্র এক হাত দূরত্বের ব্যবধানে দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে। ষোলো বছরের তরুণ হৃদয়ে আমার খেলে গেল যেন এক অদৃশ্য বিদ্যুত শিহরণ। মিছিল আর রোদের ক্লান্তি কোথায় উবে গেল; হৃদয়ের গভীর কন্দরে অনুভব করলাম এক অভূতপূর্ব সঞ্জীবন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে জলদগম্ভীর কণ্ঠে অনেক কথা বললেন। তার মধ্যে আজও আমার কানে অনুরণন ঘটায় বঙ্গবন্ধুর সেই কথাটি ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে ওইসব পশ্চিমা ভুঁড়িওয়ালাদের ভুঁড়ির ওপরে ট্যাক্স বসাব।’ বঙ্গবন্ধুর এই কথাটিই আমার মতো অসংখ্য হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত করে দিয়েছিল একটি বাস্তব প্রত্যয় ‘আমরা আর ওরা’-এর মধ্যেই ছিল, আমার বিশ্বাস, আমাদের বাঙালী জাতির আলাদা স্বাধীন অস্তিত্বের সুস্পষ্ট ইশারা। বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রম বহুধাবিভক্ত বাঙালী জাতিকে এনে দাঁড় করিয়ে দিল একই সমতলে যার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল সত্তরের নির্বাচনী ফলাফলে। পূর্ব পাকিস্তানের এক শ’ ঊনসত্তর আসনের মধ্যে এক শ’ সাতষট্টিটি এলো বঙ্গবন্ধুর হাতে। এর পরের ইতিহাস আমাদের স্বাধীনতার। পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতার ন্যায্য দাবিদার আমাদের বুকে চালানো হলো গুলি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা ঘরে ঘরে গড়ে তুললাম প্রতিরোধের দুর্গ। অতঃপর আঘাতে আঘাতে চূর্ণ করে দিলাম পাকিস্তানের তখতে তাউস। নয় মাসে জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালী জাতির প্রাণপ্রিয় বঙ্গবন্ধু হলেন জাতির পিতা। একজন শেখ মুজিব থেকে কোন্ জাদুমন্ত্র বলে তিনি হয়ে উঠলেন জাতির পিতা? কোন্ শক্তির বলে জাতিকে উপহার দিতে পারলেন একখ- নিজস্ব আবাসভূমি? আর কেনই বা জাতির এই ক্ষণজন্মা পুরুষকে সপরিবারে কারা বর্বরতম নৃশংসতায় হত্যা করল স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়? সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও আসে, স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর পেরিয়ে এসেও আমরা কেন পারলাম না স্বাধীন সে আবাসভূমিকে বাসযোগ্য করে তুলতে? প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা যেতে পারি স্বামী বিবেকানন্দের কাছে। যিনি বলেছেন, ‘যে সব মানুষ যায়, তাদের মধ্যে কতক কতক মানুষ কালের গায়ে একটা দাগ রেখে যায়।’ ইংরেজ কবি একেই Foot-prints on the sands of time বলেছেন, অর্থাৎ সময়ের বেলাভূমিতে পদচিহ্ন রেখে যাওয়া। পৃথিবীর ইতিহাসে যে ক’জন ক্ষণজন্মা পুরুষ এমনি সময়ের বুকে পদচিহ্ন রেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব। যার কীর্তি অমর করে রেখেছে তাকে। সংস্কৃত কবির ভাষায় ‘কীর্তির্যস্য স জীবতি।’ অর্থাৎ মানুষের কীর্তিই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রাসঙ্গিক বিধায় নির্যাতিত মানবতার বন্ধু কিউবান বিপ্লবের নায়ক ফিদেল ক্যাস্ট্র্রোর ঐতিহাসিক সেই উক্তিটি উল্লেখ করছি। ১৯৭৩ সালে আলজিরিয়ায় এক সম্মেলনে মহাকালের দুর্গম পথের ক্লান্তিহীন অভিযাত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছ থেকে দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘এক সময় নেপাল গিয়ে মনোরম হিমালয় দেখার প্রবল ইচ্ছা ছিল, আজ আপনাকে স্বচক্ষে দেখে সে ইচ্ছা উবে গেল। হিমালয় দেখবার আর প্রয়োজন নেই।’ এ যেন আমাদের প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী রাষ্ট্র নায়কের গেয়ে ওঠা; মুজিবের মুখ আমি দেখিয়াছি তাই, হিমালয়ের বুক আমি খুঁজিতে যাই না আর।-মুজিব আমাদের হিমালয়, বাংলার এভারেস্ট। শেষ দুটি উক্তিকে সংক্ষেপে এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে, বাংলার হিমালয় সুউচ্চ শিরে বাংলাকে সত্যিকার অর্থে সোনার বাংলা তৈরি করতে গিয়ে যে সব দেশী-বিদেশী স্বার্থ শিকারিদের কোপানলে পড়েছিলেন তারাই তাকে সপরিবারে হত্যা করেছে নির্মম পৈশাচিকতায়। আর বেগুন গাছকে বটগাছের স্থলাভিষিক্ত করায় জাতি হিসেবে আমরা হারিয়ে বসেছি আমাদের সকল মূলধন- দেশপ্রেম, নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ আর সাহসিকতা। জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে মেতে উঠেছি সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের ইঁদুর দৌড়ে। তবে মানুষ স্বভাবতই আশাবাদী। আমরাও। একদিন শেষ হতেই হবে এই সঙ্কীর্ণ স্বার্থ তাড়নাজাত ইঁদুর দৌড়ের। আমরা ফিরে যাব বঙ্গবন্ধু-বাংলার এভারেস্টের কাছে। সেইভাবে, যেভাবে বলেছেন বিখ্যাত ইংরেজ কবি টেনিসন তার কবিতায় : ÔThe mortal goes, dust to dust; ashes to ashes;/ He that was great in him is gone,/ Gone for ever ; but nothing can/ Bereave him of the force he/ Makes his own living here. Õ মানুষ যায়, -কোথায়, কোন্ অনন্ত সাগরে মিলে মিশে যায়, কিন্তু তার সবটুকু যায় না। বিশ্বমাঝে তার কীর্তির মাধ্যমে যে শক্তিটুকু রেখে যায় তা চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে যায় না বরং উত্তরোত্তর সে শক্তির তেজ অনুসারে ক্রমেই বাড়তে থাকে। এ কথার সত্যতা পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি স্বার্থ শিকারিদের অবিরাম অপপ্রচার আর বঙ্গবন্ধুর গায়ে কালিমালেপনের প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও আজকের প্রজন্মের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের ‘রোল মডেল’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই নতুন প্রজন্ম তার অনুভবে আর উপলব্ধিতে লালন করবে : ‘বড় প্রয়োজন সামনে এসেছে / ছোট প্রয়োজন ছাড়তে হবে। / জীবন হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র-, / ভুল করলে হারতে হবে।’ আমরা যেন ভুল করেও সেই ভুল না করি। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
×