ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহী সিটি নির্বাচনের আগাম হাওয়া

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৫ আগস্ট ২০১৭

রাজশাহী সিটি নির্বাচনের আগাম হাওয়া

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ রাজশাহী সিটি নির্বাচনের জন্য এবার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছেন বড় দুই দলের দুই প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এবারও এখানে থাকছেন সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন আর বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন আবারো নগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। বুলবুল বর্তমানে রাসিকের মেয়র। ফলে আগামীতেও ভোটযুদ্ধে তুমুল লড়াই হবে লিটন-বুলবুলের মধেই এমনটাই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে আগাম প্রচারে নেমেছেন তারা। আগামী বছরের (২০১৮) মাঝামাঝি রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হওয়ার কথা। এ নির্বাচন সামনে রেখে তাই সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতোমধ্যে প্রচারে নেমে পড়েছেন। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও সম্প্রতি কেন্দ্রের সভায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা তাকে প্রস্তুতি নিতে বলায় তিনি মাঠে নেমে পড়েছেন। একমাসের বেশি সময় ধরে খায়রুজ্জামান লিটন মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। প্রতিদিনই নানা কর্মসূচী পালন করছেন নেতাকর্মীদের নিয়ে। নেতাকর্মীদেরও সক্রিয় করছেন নির্বাচনকে টার্গেট করে। এদিকে বর্তমান মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল সামনের নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন, এটা প্রায় নিশ্চিত। তিনি মাঠের প্রচারের পাশাপাশি ব্যস্ত ঘর গোছাতে। নগর বিএনপির সভাপতি হওয়ার পর থেকে দলের একটি বড় অংশের বিরোধিতার মুখে পড়েছেন তিনি। সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান মিনু ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলনের সঙ্গে তার শীতল সম্পর্ক। ফলে বুলবুলকে এখন দলের ভেতরে-বাইরে লড়াই করতে হচ্ছে। এছাড়া দির্ঘদিন নগর ভবনের বাইরে থাকার পর দায়িত্ব পেয়ে নগর সামলাতেও হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। সূত্র জানায়, সম্প্রতি শেষ হওয়া আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক শেষে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা মেয়র প্রার্থী হিসেবে লিটনকে প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলেন। লিটন জানান, দলীয় প্রধান তাকে প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামতে বলেছেন। তাই তিনি মাঠের কাজ শুরু করেছেন। দলের প্রধান তাকে যেভাবে বলবেন, তিনি সেভাবে কাজ করতে চান। লিটন বলেন, দলের কর্মীরা তাদের অতীতের ভুল বুঝতে পেরেছেন। ফলে আগামী নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাই তার পক্ষে মাঠে নামবেন। ফজলে হোসেন বাদশার সঙ্গে তার শীতল সম্পর্কের বিষয়টিও একটি পক্ষের প্রচার বলে জানান তিনি। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা জানান, গত নির্বাচনে লিটনকে বিজয়ী না করে নগরীর মানুষ যে ভুল করেছেন, এখন তারা তা বুঝতে পারছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যবদ্ধ থাকাটা জরুরী। নইলে স্বাধীনতাবিরোধীরা সুযোগ নেবে। আগামী নির্বাচন দেশ ও জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে মেয়র নির্বাচনটিকেও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে মাঠে থাকবে ১৪ দল। তবে লিটনের জন্য এবারও অপেক্ষা করছে বড় চ্যালেঞ্জ। ২০১৩ সালের নির্বাচনে দলের একটি অংশ তার পক্ষে মাঠে নামেনি। নাগরিক কমিটির সিনিয়র সদস্যরাও ছিলেন নিষ্ক্রিয়। দুই অংশকে সক্রিয় করা হবে লিটনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া বুলবুলকে সাময়িক বরখাস্তের পর দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র হন লিটনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নিজাম উল আযীম। নিজামের সময় নেয়া সিদ্ধান্তগুলোতে ক্ষোভ বাড়ে নাগরিকদের মাঝে। প্রচার আছে, এসব সিদ্ধান্ত লিটনের পক্ষ থেকে এসেছে। ফলে সেই সঙ্কট কাটাতেও মাঠে কাজ করতে হবে লিটনকে। প্রায় দুই বছর নগর ভবনের বাইরে থাকা নির্বাচিত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল দলের প্রার্থী হচ্ছেন, এটা অনেকটা নিশ্চিত। তবে মিনুকে সরিয়ে দলের সভাপতি হওয়ার পর থেকে অনেকটা বেকায়দায় আছেন বুলবুল। মিনু সমর্থকরা বুলবুলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এ নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে কেন্দ্রের কাছে অভিযোগও করেছেন সিনিয়র একাধিক নেতা। বুলবুলকে সভাপতির দায়িত্বে নিয়ে আসার নেপথ্যে যারা কাজ করেছেন, এমন সিনিয়র নেতাদের এখন অবজ্ঞা করে চলেছেন বুলবুল। ফলে আগামী নির্বাচনে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া মেয়রের দায়িত্ব ফিরে পাওয়ার পর কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে পড়েন বুলবুল। বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে বুলবুলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন কর্মচারীরা। এ ছাড়া হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত তিনি তা বাস্তবায়ন করেননি। এ নিয়ে সুশীল সমাজের একটি বড় অংশের বিরোধিতার মুখে পড়েছেন তিনি। লিটনের সময় নেয়া কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজের কোন অগ্রগতি না হওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে জনতার মুখোমুখি হতে হবে বুলবুলকে। বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান মিনু জানান, দল থেকে যাকে প্রার্থী করা হবে, বিএনপি নেতা-কর্মীরা তার পক্ষেই মাঠে থাকবেন। বুলবুলের সঙ্গে তার সম্পর্ক আগের মতোই আছে দাবি করে তিনি বলেন, দলীয় প্রধান যেভাবে বলবেন, আমরা সবাই সেভাবেই চলব। আগামী সিটি নির্বাচনে মানুষ এ সরকারের বিরুদ্ধে তাদের রায় দেবে বলে দাবি করলেও মেয়র হিসেবে নিজে দলের মনোনয়ন চাইবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি হ্যাঁ বা না বলেননি। নগর বিএনপি সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল জানান, নির্বাচিত হওয়ার পরও তাকে যে কাজ করতে দেয়া হয়নি, তা নগরীর মানুষ জানেন। এ ছাড়া দলের ভেতরে আগে তার বিরুদ্ধে কিছু নেতা ছিলেন। কিন্তু এখন বিএনপির সব নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ। আগামী নির্বাচনে দলীয়ভাবে প্রার্থী ঘোষণা হওয়ার পর মাঠে সেটি দেখা যাবে। মিজানুর রহমান মিনুর সঙ্গে সম্পর্কের কোন অবনতি হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি। এদিকে আগামীতে নির্বাচনে লিটনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ থাকলেও বিগত সময়ে রাজশাহী নগরীর ব্যাপক দৃশ্যমান উন্নয়ন তাকে সফলতার দিকে এগিয়ে নেবে এমনটাই মনে করছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। বিগত সময়ের নানা উন্নয়নের বার্তা নিয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করছেন তিনি। তবে ভিন্ন চিত্র বিএনপিতে। বুলবুল নির্বাচিত হলেও ঠিকমতো বেশিরভাগ সময় দায়িত্বের বাইরে থাকতে হয়েছে তাকে। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রায় ৫০ হাজার ভোটে পরাজিত হন তৎকালীন মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। মেয়াদের পাঁচ বছরে রাজশাহী নগরীর অভূতপূর্ব উন্নয়ন করে চমক সৃষ্টি করেছিলেন লিটন। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে তা কাজে লাগাতে পারেননি। রাজশাহীর উন্নয়নে কয়েক শ’ কোটি টাকা আওয়ামী লীগ সরকার বরাদ্দ দিলেও ভোটারদের মন জয়ে ব্যর্থ হন। যদিও সে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পেছনে তৎকালীন ‘হেফাজত ইস্যুকে’ দায়ী করেন লিটন। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার জানান, গত সিটি নির্বাচনে পরাজয়ে তৃণমূলের সাংগঠনিক দুর্বলতা বড় কারণ। এ কারণে তখন আওয়ামী লীগের প্রচারে নামতেই দেরি হয়েছিল। ফলে অবাধে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর সুযোগ পেয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা। তবে এবার তাদের সে সুযোগ দেয়া হবে না। তাই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আগে থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রচার চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত লিটন মেয়র থাকাকালে নগরীর উন্নয়নের চিত্র ভোটারদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। লিটন বলেন, দলের সভানেত্রীর নির্দেশে আমি ভোটের মাঠে নেমে পড়েছি। প্রতিদিনই কোন না কোাে ওয়ার্ডে উঠান বৈঠক করছি। সরকারের উন্নয়নের কথা জানাচ্ছি। পাশাপাশি আমি মেয়র থাকাকালে যেসব উন্নয়ন করেছি তা-ও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। জানিয়ে দিচ্ছি যে, আমার অসমাপ্ত কাজগুলো এখন স্থবির হয়ে আছে। এতে নগরীর উন্নয়ন থেমে গেছে। আমি আগামীতে মেয়র নির্বাচিত হলে বেকারদের কর্মসংস্থানসহ উন্নয়নের মহাসড়কে রাজশাহীকে নিয়ে যাব, বলেন লিটন। প্রসঙ্গত, ১৯৮৭ সালে গঠিত রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৯৪ সালে। ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মোসাদ্দেক হোসেন (আনারস প্রতীক) এক লাখ ৩১ হাজার ৫৮ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন (তালা প্রতীক) পেয়েছিলেন ৮৩ হাজার ৭২৬ ভোট। ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর মেয়রের দায়িত্ব নিলেও এরপর দুই দফা বরখাস্ত হয়ে বুলবুলকে বেশিরভাগ সময় কারাগার বা নগর ভবনের বাইরেই থাকতে হয়েছে।
×