ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এম. নজরুল ইসলাম

জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি শেখ কামাল

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৫ আগস্ট ২০১৭

 জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি শেখ কামাল

সেসব দিনের স্মৃতি আজও অমলিন। স্বাধীনতার পর কী এক উচ্ছল সময় গেছে আমাদের। চারদিকে আনন্দের জোয়ার। সর্বত্র মুক্তির হাওয়া। মুক্ত বাতাসে তখন আমাদের বিচরণ। নিষেধের বেড়াজাল ছিল না। অনুপস্থিত অবাঞ্ছিত কারও চোখ রাঙানিও। শাসনের নাগপাশ ভেঙ্গে আমাদের ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’। সেই পথে ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ কিছু তরুণ ‘আমরা চকিত অভাবনীয়ের ক্বচিৎ-কিরণে দীপ্ত’। ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে’ আমাদের চিত্ত তখন ঝলমল করে। আবার তারই ভেতর থেকে একটি গোষ্ঠী অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চেয়েছে। সেই দুরন্ত সময়ে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন যে প্রাণময় তরুণ, তিনি শেখ কামাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯৭১ সালে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। প্রথম ওয়ার কোর্সের সদস্য হয়েও স্বাধীনতার পর ফিরে যান নিজের পরিচিত পরিম-ল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের যুব-মানস গঠনে নিয়োজিত হন। শেখ কামাল এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারার নাম। যারা তাকে দেখেনি তারা কল্পনাও করতে পারবে না কী অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে এই তরুণ সারা ঢাকা শহর চষে বেড়াতেন। সকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, দুপুরে ছাত্রলীগ অফিস, বিকেলে খেলার মাঠ, সন্ধ্যায় নাটক কী গানের মহড়ায় তার সরব উপস্থিতি। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৩ সালে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের ঠিক উল্টোদিকে ৩০ মিরপুর রোডে ছিল ছাত্রলীগের অফিস। দোতলা বাড়ির নিচতলায় মহানগর ছাত্রলীগের, দোতলায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অফিসে আমারও যাতায়াত ছিল। বয়সে কনিষ্ঠ হলেও ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি তখন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শাখা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে মহানগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক হিসেবে আমাকে মনোনীত করা হয়। আর সেই সূত্রেই তার কাছে আসা। ছাত্র রাজনীতির সাংগঠনিক পরিচয়ের গ-ি পার হয়ে তার ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগেনি। আমার দিক থেকে সঙ্কোচ ও ভয় দুটোই ছিল। স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে তিনি। স্বাভাবিকভাবেই একটি দূরত্ব তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু কামাল ভাইয়ের ব্যক্তিত্ব ও মানসকে কাছে টেনে নেয়ার অসামান্য ক্ষমতা সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে একটুও সময় নেয়নি। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে অন্য রকম একটা জোয়ার আনার চেষ্টা করেছিলেন শেখ কামাল। ছাত্র রাজনীতির গুণগতমানের পরিবর্তনের চেষ্টা ছিল তার। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী এ তরুণ যে কোন মানুষকে অনায়াসে কাছে টানার শক্তি রাখতেন। জানতেন কী করে সংগঠন প্রাণবন্ত রাখতে হয়। তার প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন বোধ করি আজও হয়নি। মূল্যায়ন তো দূরের কথা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তার চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ তার শিল্পী মনের পরিচয় ক’জনের জানা আছে? অনেকেই হয়ত জানেন না, শেখ কামাল চমৎকার সেতার বাজাতেন। ছায়ানটের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দেশের সঙ্গীত জগতে পপ সঙ্গীতের যে উত্থান তার নেপথ্যেও শেখ কামালের অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে সে সময় গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন’ শিল্পীগোষ্ঠী- যে দলটি দেশের সঙ্গীত জগতে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়েছিল সেই সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে। দেশের নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে শেখ কামাল ছিলেন প্রথম সারির সংগঠক। ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও। অভিনেতা হিসেবেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে ছিলেন প্রতিষ্ঠিত। শৈশব থেকেই ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় উৎসাহী শেখ কামাল স্বাধীনতার পর আবির্ভূত হন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে। উপমহাদেশের অন্যতম ক্রীড়া সংগঠন ও আধুনিক ফুটবলের অগ্রদূত আবাহনী ক্রীড়াচক্রের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। রাজনীতিতে তার অবদান কম নয়। ছাত্রলীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য। শাহাদাতবরণের সময় ছিলেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন তিনি। শুরু থেকেই যদি গুণগত পরিবর্তন করে দেয়া যায় তাহলে ভবিষ্যতের রাজনীতি হবে কলুষমুক্তÑ এমনই স্বপ্ন দেখতেন তিনি। নিজের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতেন তিনি অন্যদের ভেতর। যে কোন সংগঠনের শীর্ষ পদটি গ্রহণ করার সব যোগ্যতা ছিল তার। নেননি। নিজেকে নেপথ্যের কর্মী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। অসাধারণ হয়েও খুব সাধারণ ছিলেন তিনি। সাধারণের মধ্যেই নিজেকে মানানসই মনে করতেন। সহজে সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। নিজেকে কোনদিন জাহির করতে যাননি যে মানুষটি তিনি শেখ কামাল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে। আজকের দিনে যখন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে সাম্প্রদায়িক শক্তি, যখন স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করেই চলেছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল তখন শেখ কামালের মতো একজন দক্ষ সংগঠকের অভাব বোধ করি। আজ তার মতো নেতৃত্ব বেশি প্রয়োজন এ দেশে। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×