পিরোজপুরের আটঘর কুড়িয়ানার শাখার খালের ও ডাঙ্গায় কয়েক যুগ যুগ ধরে বসে আসা মৌসুমভিত্তিক ব্যবসায় জড়িত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। স্বরূপকাঠী উপজেলারও নেই এর কোন ব্যতিক্রম। এখন বর্র্ষাকাল তাই প্রকৃতিতে আসছে বর্ষা। খালে-বিলে টইটম্বুর হয়ে উঠবে বর্ষা ও জোয়ারের নতুন পানিতে। পানিতে ছোটাছুটি করবে দেশীয় ছোটবড় হরেক প্রজাতির মাছ। আর এ মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহের লক্ষ্য বরাবরের ন্যায় এ বছরও উপজেলার আটঘরের জলেডাঙ্গায় পাশাপাশি বসে জমে উঠছে বিখ্যাত নৌকা ও চাঁইর হাট। হাটে বিকিকিনিতে মহা ব্যস্ত হয়ে উঠছে এ উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা নৌকা ও চাঁই বিক্রেতারা।
বাংলা আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিনের শেষ সময় পর্যন্ত সপ্তাহের শুক্র ও সোমবারে আটঘরের বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় জলে ও কূলে বসে এ নয়নাভিরাম নৌকারহাট। রেইনট্রি, মেহগনি ও কড়াই কাঠের তৈরি হাটে আসা নৌকাগুলো এলাকার প্রায় আধা কিলোমিটার জায়গাজুড়ে খালের জলে ও কূলে বিস্তৃতি ঘটে।
সরেজমিনে নৌকারহাট ঘুরে মনে হলো, যেন এক নৌ সাম্রাজ্য। যে দিকেই দু‘চোখ যায় কেবল নৌকা আর নৌকা। আধুনিক সভ্যতায় যান্ত্রিক নানান ইঞ্জিনচালিত বোর্ডের রাজত্ব থাকলেও; এখানকার মানুষের কাছে নৌকার কদর শত শত বছর ধরে। গাছ থেকে পেয়ারা সংগ্রহ, কৃষিকাজ পরিচর্যা, গো-খাদ্য সংগ্রহ, ভাসমান সবজির বাজারে বিকিকিনিসহ যাবতীয় কাজে নৌকাই এখানকার মানুষের প্রধান ভরসাকে কেন্দ্র করে আটঘরে চলে আসছে এ বিখ্যাত নৌকারহাট। চলতি আষাঢ়ের একধারে খড়া আর অন্যদিকে ঝড়া বর্ষার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্রেতা, বিক্রেতা আর নৌহাট দেখার উৎসুখ মানুষের সমাগমে এ সময়ে দেখা মেলে নৌকা বিকিকিনির এ মিলনমেলা।
কথা হয় ইলুহার গ্রামের নৌকা বিক্রেতা মনির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্ষাকালে গোখাদ্য সংগ্রহ, পেয়ারা পারাসহ ভাসমান সবজির বাজারে ব্যবসার কাজে এখানকার মানুষের কাছে নৌকার কদর অনেক। তবে, সাধারণত আটঘর কুড়িয়ানা ও ঝালকাঠি অঞ্চলের মানুষেরা গাছ থেকে পেয়ারা সংগ্রহের কাজেই বেশি নৌকা কিনে থাকেন। এ বর্ষা মৌসুমে এ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের প্রতিটি বাড়িসহ জলাবাড়ি, সোহাগদল, বলদিয়া, গুয়ারেখা ও সিমান্তবর্তী ঝালকাঠি জেলার প্রতিহাটে কয়েক শতাধিক লোক আসে নৌকা ক্রয়ের জন্য। মনির জানায়, আজকের হাটে সে বিক্রির জন্য ২৭টি নৌকা নিয়ে এসেছে। আকার ও কাঠের প্রকারভেদে একেক নৌকার একেক রকমের দাম রয়েছে। মনির আরও বলে, সে গ্রাম থেকে ঘুরে ঘুরে নৌকা কিনে প্রতি হাটে একসঙ্গে ২০-৩০টি নৌকা নিয়ে আসে। হাটে চাম্বলের নৌকা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। একটি আটহাতি চাম্বল কাঠের তৈরি নৌকা তিনি বিক্রি করেন দু‘হাজার থেকে ২২শ’ টাকায়। এতে তিনি খরচপাতি পুষিয়ে মোটামুটি লাভের মুখ দেখছেন।
ওই এলাকার বিদ্যালয় সংলগ্ন খালে ও জলে বিক্রেতারা সারি সারি নৌকা সাজিয়ে সমানতালে বিক্রি করে চলছেন। আর বরিশাল বিভাগের বিল ও চরাঞ্চলের বিভিন্ন মানুষেরা হাটে এসে প্রয়োজনুযায়ি একসাথে তিন থেকে চারটি নৌকা কিনে নসিমন ও ট্রলারযোগে নিয়ে যাচ্ছেন গন্ত্যব্যে। বিক্রেতারা নৌকার একটু বেশি দাম হাকালেই ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে নৌকার সঠিক দামদর যাচাই করে পছন্দের নৌকাটি কিনে নিচ্ছেন।
উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের নৌকা কারিগর মোঃ আজমল হোসেন (৫০) জানান, পনের বছর ধরে তিনি এহাটে নৌকা বিক্রি করতে আসেন।
আজকের হাটে সে ১৫টি নৌকা নিয়ে এসেছে। বেঁচাবিক্রি ভাল। তিনি জানান, একটি ১২ হাতি নৌকা তৈরিতে একজনের সময় লাগে ৩/৪দিন। যাহার মজুরি ও কাঠপাঠ মিলিয়ে খরচ পড়ে ২৫শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা। হাটে সেই নৌকাটি তার বিক্রি হয় ৩ হাজার ৭শ‘ থেকে ৪ হাজার টাকায়। হাটে সাধারনত আট হাত ও দশহাতি নৌকার বেশি চাহিদা।
নৌকা ব্যাবসায়ী ও হাটের স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর বর্ষা মৌনসুমের এই নৌকার হাটে পিরোজপুর, বরিশাল ও ঝালকাঠী জেলার বিভিন্ন পেশার লোকেরা আসে। তারা একসঙ্গে কয়েকটি নৌকা কিনে কেউ নৌকার ওপর নৌকা; আবার, কেউ কেউ নসিমন ও ট্রলারে ক্রয়কৃত নৌকাগুলো একসঙ্গে সাজিয়ে নিয়ে যান দূর-দূরান্তে।
নৌকার হাটের সঙ্গেই রাস্তার উপরে বসে বৈঠার দোকান। সেখানে বিক্রেতারা দু‘পাশে দুটি খুঁটি পুঁতে তার ওপর আড়াআড়ি একটি বাশ বেঁধে বাঁশের উপরে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয় বৈঠা। বিলাতি গাভ, মেহগনি ও আমইর কাঠ দিয়ে বানানো হয় বৈঠাগুলো।
হাটে বিলাতিগাভ ও আমইর কাঠের বৈঠার চাহিদা বেশি। বলদিয়া ইউনিয়নের চামী গ্রামের বৈঠা বিক্রেতা মহাসিন জানান, হাটে সে ১০৭টি বৈঠা নিয়ে এসেছে। বেঁচা-বিক্রি মোটামুটি ভাল। তবে নৌকার মতো বেশি বৈঠা বিক্রি হয় না। কারণ, একটি আমইরকাঠ ও বিলাতি গাভের বৈঠা অনেক বছর সময় দেয়।
হাটের ইজারাদার মোঃ মোস্তফা কামাল বলেন, প্রতিহাটে ৯০০-১০০০ খানা নৌকা ওঠে। হাটে বিভিন্ন আকারের ৬০০-৭০০খানা নৌকা বিক্রি হয়। হাটে একশ’ টাকায় দশ টাকা খাজনা নেয়া হয়। তবে এ বছর বেচাকেনা খুবই খারাপ যাচ্ছে।
হাটের ইজারাদার ও ব্যবসায়ীরা জানান, আগে প্রতি হাটে নৌকা ও চাঁই বিক্রি মিলিয়ে ৭৫-৮০ লাখ টাকা বিক্রি হতো। এখন নানা সমস্যাজনিত কারণে বেচা বিক্রি এসে দাঁড়িয়েছে ২৫-৩০ লাখ টাকায়। আবার কোন কোন হাটে এ বেঁচা বিক্রিও অনেক নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। তারা আরও জানান, ধার-দেনা করে প্রতি বছর ব্যবসায়ীরা হাটে চাঁই ও নৌকা নিয়ে আসে। এভাবে বেঁচা-বিক্রি দিন দিন কমে গেলে এক সময় দেশের গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসা কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
Ñশফিউল হক মিঠু, ফিরোজপুর থেকে
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: