ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণসন্ধ্যায় গানে গানে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৫ আগস্ট ২০১৭

শ্রাবণসন্ধ্যায় গানে গানে রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাঙালীর কাছে রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে চিরকালীন ও সর্বজনীন। আপন সৃষ্টির আলোয় সঙ্কটে কিংবা বেদনায় দেখিয়ে যান পথের দিশা। আনন্দ বা উচ্ছ্বাসেও অবারিতভাবে খুলে দেন মননের দুয়ার। এভাবেই বিশ্বকবি হয়ে ওঠেন সারা বছরের কিংবা সারা জীবনের সঙ্গী। তবে বিশেষ সময়ে কবিগুরুর সৃষ্টিসম্ভার যেন তার অনুরাগীদের আরও বেশি কাছে টানে। বছর ঘুরে আবার আসছে বাইশে শ্রাবণ। কাল রবিবার সেই দিন। প্রিয় পৃথিবী ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদায়ের দিন। সেই সুবাদে প্রয়াণবার্ষিকীর দুই দিন আগে শুক্রবার ছুটির দিনে স্মরণ করা হলো কবিকে। গানে গানে জানানো হলো শ্রদ্ধাঞ্জলি। শ্রাবণসন্ধ্যায় সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে সূচনা হলো রবিঠাকুরের গানে সাজানো দু’দিনব্যাপী সঙ্গীতানুষ্ঠানের। ‘বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি এ দ্বারে’ প্রতিপাদ্যে এই সঙ্গীত আসরের আয়োজক বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা (বারশিস)। আয়োজনের শুরুতেই শিল্পীদের সম্মেলক কণ্ঠে উঠে আসে বাংলা মায়ের প্রতি ভালবাসা। নারী ও পুরুষ শিল্পীরা দুই ভাগে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে যান রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতিতে সাজানো মঞ্চের দুই পাশে। অনেক কণ্ঠ এক সুরে গেয়ে যায় ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি/আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...। জাতীয় সঙ্গীতের সুরটি থামতেই সবাই মিলে বলে যায় এগিয়ে চলার কথা। গেয়ে শোনান ‘সমুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার’। সম্মেলক সঙ্গীত শেষে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্থার সভাপতি তপন মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক সাজেদ আকবর। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সালমা আকবর ও পিযূষ বড়ুয়া। বাঙালীর যাপিত জীবনে বিশ্বকবির প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে তপন মাহমুদ বলেন, রবীন্দ্রনাথ চির নূতন। একই কারণেই তিনি সব সময়ই প্রাসঙ্গিক ও আধুনিক। তাই অবিকৃতভাবে রবীন্দ্রচর্চা করলে বাঙালীর সারা জীবনের সাথী হয়ে থাকবেন তিনি। এই বর্ষাতেই তিনি বিদায় নিয়েছিলেন। সেই বিদায়ের শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ আমাদের এই আয়োজন। স্বল্প কথনের পর মঞ্চে আসেন তনুশ্রী দীপক। সুললিত কণ্ঠে গেয়ে শোনান ‘ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি/শুনতে কি পাস দূরের পারের বাঁশি উঠছে বাজি’। জয়ন্ত আচার্র্য্যর কণ্ঠে গীত হয় ‘পথের শেষ কোথায়’। লিটন চন্দ্র বৈদ্য গেয়ে শোনান ‘পুব হাওয়াতে দেয় দোলা’। অনিকেত আচার্য গেয়ে শোনান ‘আকাশজুড়ে শুনিনু’। বর্ষার গান শোনান আহমেদ শাকিল হাশমী। তার কণ্ঠে গীত হয় ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে’। রাবেয়া আক্তার পরিবেশিত গানের শিরোনাম ছিল ‘গহন রাতের শ্রাবণ ধারা’। কাকলী গোস্বামী গেয়ে শোনান ‘এই করেছ ভালো নিঠুর হয়ে’। সুরাহ্্ আকবার পরিবেশন করেন ‘সঘন গহন রাত্রী ঝরিছে শ্রাবণ ধারা’। ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’ শীর্ষক সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুফিয়া যাকারিয়া। রিতা মুসা গেয়ে শোনান ‘আমার নিশীথ রাতের বাদল ধারা’, ফেরদৌসী কাকলী ‘আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার’, আহমেদ মায়া আখতারী ‘প্রতিদিন আমি হে জীবন স্বামী’, সানজিদা রহমান ‘আমার না বলা বানীর’, অপর্ণা খান ‘একলা বসে বাদল শেষে’ ও শাপলা ইসলামের কণ্ঠে গীত হয় ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’। এছাড়াও প্রথম দিনের সঙ্গীতাসরে একক কণ্ঠে গান শোনান রফিকুর আলম, আব্দুল ওয়াদুদ, মহাদেব ঘোষ, মামুন জাহিদ, আজিজুর রহমান তুহিন, অভীক দেব, আশিকুর রহমান, আব্দুর রশিদ, গোলাম হায়দার, বুলা মাহমুদ, লিলি ইসলাম, তানজিলা তমা, ছায়া কর্মকার, সীমা সরকার ও সুমাইয়া ইমাম। আজ শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় একই স্থানে অনুষ্ঠিত হবে রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত সমাপনী দিনের সঙ্গীতায়োজন। শিল্পাঙ্গনে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনী ॥ তার হাতের ছোঁয়ায় কুড়িয়ে পাওয়া কাঠের টুকরোগুলো পরিণত হয় শিল্পে। মৃত বৃক্ষের ডালপালা বা শেকড়-বাকড় যেন প্রাণের পরশে মেলে ধরে বহুমাত্রিক অবয়ব। এভাবেই তিনি প্রকৃতির মাঝে খুঁজে নেন জীবনকে। অবহেলায় পড়ে থাকা বস্তুর মাঝে শিল্পের সন্ধান খোঁজা এই বরণ্যে শিল্পী ফৌরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। প্রকৃতিনির্ভর তেমন কিছু ভাস্কর্য নিয়ে রাজধানীর শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে শুরু হলো এই ভাস্করের ভাস্কর্য প্রদর্শনী। শুক্রবার বিকেলে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘মেঘের সঙ্গী’। নিজের শিল্প ভাবনা প্রসঙ্গে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেন, আমি বাণিজ্যের কথা ভাবি না। প্রদর্শনীর কথা ভাবি না। শিল্পের দাম নিয়েও ভাবি না। কখনও ভাবিনি। শুধু শিল্পের কথাই থাকে মনে। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের গানে আমার জীবনের সকল রোমান্স। আর প্রকৃতির মাঝে পাই শিল্পের দেখা। আমার সব কাজ প্রকৃতি থেকে নেয়া। রঙ-তুলি এনে, কল্পনার আশ্রয়ে একটা কিছু আঁকবেনÑএমন শিল্পী নন মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। বরং তিনি অনন্য এক ভাবুক মানুষ। তার শিল্পের মধ্যে তাই প্রশান্তি মেলে। জানতে পারি প্রকৃতি ও মানুষের যুগল বন্ধনের মর্মকথা। এ প্রদর্শনীতে শিল্পীর ৮৯ শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভালবাসা, সোনালী কন্যা, জলে ভাসা, ভিজে পাখি, ক্ষুধার্ত বক, বীরাঙ্গনা বিলাপ, মিলন তিথি, পরম্পরা, মাতৃত্ব, প্রতিপক্ষ, অপেক্ষা, শৈশব। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন কথাশিল্পী আনিসুল হক। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী এবং শিল্পাঙ্গন গ্যালারির পরিচালক রুমী নোমান। তাসমিমা হোসেন বলেন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর্য আমাদের প্রকৃতির কাছে নিয়ে যান। প্রকৃতির মাঝে জীবনের যে রহস্য লুকিয়ে আছে তা খুঁজে নেবার উৎসাহ দেন। মনকে মেঘের মতো মুক্ত-স্বাধীন করে তোলে তার ভাস্কর্য। ভাস্কর্য প্রিয়ভাষিণী আমাদের স্মৃতিময় অতীতের কথা যেমন বলেন তেমনি সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তুলবার জন্য প্রাণিত করেন। আনিসুল হক বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে যেসব মানুষের বীরোচিত অবদান রয়েছে; যাদের ঋণ চিরকাল ধরে স্বীকার করে যেতে হবে তার মধ্যে ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী অন্যতম। তিনি মানুষকে সুন্দরের প্রতি টেনে আনেন। প্রিয়ভাষিণী তার হাতের স্পর্শে তার প্রিয় সৃজনীয় আঙ্গুল দিয়ে অনির্বচনীয় আনন্দ দেন। তার শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে আরও সুন্দর মনের অধিকারী হয়ে উঠি। শিল্পের ‘বচন’ দিয়ে তিনি এমন এক উপলব্ধির সামনে দাঁড় করিয়ে দেন যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শাহরিয়ার কবির বলেন, প্রিয়ভাষিণী তার সারাজীবনের কাজ দিয়ে মানুষের মাঝে নন্দনবোধ সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতির মাঝে যেভাবে তিনি শিল্পকে দেখেন তার সেই অন্তর্দৃষ্টি অন্যকেও প্রভাবিত করে খুব সহজে। এখানেই তার কাজের সার্থকতা। প্রদর্শনী ঘুরে দেখা যায়, প্রতীকনির্ভর কাজ করেন প্রিয়ভাষিণী। প্রকাশবাদী আঙ্গিক ও নিরীক্ষার কারণেই হয়ত তার কাজকে সর্বদাই নতুন মনে হয়। বিশেষ করে দেব-দেবীর গড়ন ও কাঠামোর সঙ্গে বিষয়ের সমন্বয় করতে গিয়ে তিনি পুরাণের দিকে চোখ রাখেন। তবে সেখানেও থাকে লোকজ মোটিফ। শিল্পী হিসেবে তিনি প্রকৃতিপিয়াসী, সৌন্দর্য রূপায়ণের কারিগর। ধানমন-ির ৩০ নম্বর সড়কের গ্যালারি শিল্পাঙ্গনে এই প্রদর্শনী চলবে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। শিল্পকলায় লালন-রাধারমণের গানের সন্ধ্য্ া॥ লালন ও রাধারমণ উভয়েই তত্ত্বজিজ্ঞাসু ছিলেন। উভয়ের গানেই বাউল, দেহতত্ত্বের কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে মনের মানুষের সন্ধান তো রয়েছেই গানে। এ দুজনের বিভিন্ন পর্যায়ের বিশটি গান নিয়ে এক গবেষণাধর্মী পরিবেশনায় অংশ নিলেন রাধারমণ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র। সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত অনুষ্ঠানে কেন্দ্রের পক্ষে লালনের গান পরিবেশন করেন শিল্পী শাহনাজ বেলী ও রাধারমণের গান গেয়ে শোনান শিল্পী বিশ্বজিৎ রায়। শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি কলা কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে গানের শুরুতে ছিল সংক্ষিপ্ত কথন। যাতে প্রাককথনে অংশ নেন পিএসসির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক ও লোকসঙ্গীত শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী। কথনের পর শুরু হয় গানের পালা। শাহনাজ বেলী গেয়ে শোনান লালনের ‘কবে হবে সজল বরষা বসে আছি সেই ভরসায়’, ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়’, ‘আমি একদিন না দেখিলাম তারে’, ‘কেন জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা’, ‘জাত গেল জাত গেল’, ‘তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে’, ‘কালার কথা কেন বল আমায়’, ‘মায়েরে ভজিলে হয় সে বাপের ঠিকানা’, ‘গেড়ে গাঙ্গেরে ক্ষ্যাপা’ ও ‘করিমনা কাম ছাড়েনা মদনে’। বিশ্বজিৎ রায়ের কণ্ঠে শোনা যায় রাধারমণের ‘পতিতপবনে নাম শুনিয়া’, ‘আমার সাধনের ধন গেল অকারণ’, ‘আমার শ্যাম জানি কই রইলো গো’, ‘গৌর নামের চলছে গাড়ি’, ‘পাষাণ মনরে বুঝাইও’, ‘সুরধ্বনির কিনারায় সোনার নূপুর দিয়া পায়’, ‘ললিতে সুখ হইল না কালার বিপরীতে’, ‘তোমার আমার যত কথা সবই বৃথা হল’, ‘কাঙাল জানিয়া পার কর’ ও ‘আমি ডাকি কাঙালিনী’।
×