ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে ইলিশ উৎপাদনে বিস্ময়

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৫ আগস্ট ২০১৭

সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে ইলিশ উৎপাদনে বিস্ময়

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ প্রজনন মৌসুমে সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধকরণ এবং ওই সময়ে মৎস্যজীবীদের খাদ্য সহায়তা প্রদানসহ সরকারের নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে ইলিশ উৎপাদনে বিস্ময় বাংলাদেশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেখানে ইলিশের উৎপাদন কমছে, সেখানে বাংলাদেশে বাড়ছে বছরে প্রায় ১০ শতাংশ হারে। দেড় দশকে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে দ্বিগুণ। দেশের মোট মৎস্য সম্পদের শতকরা ১২ ভাগ ইলিশ। জিডিপিতে বাড়ছে ইলিশের অবদান। সাগরে এখন যেন ইলিশ উৎসব। খালি ফিরে আসছে না মাছ ধরার কোন নৌকা কিংবা ট্রলার। মৎস্যজীবীদের মুখে তৃপ্তির হাসি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশের ইলিশ উৎপাদন। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ দল। বাংলাদেশ যেন ইলিশ উৎপাদনে রোল মডেল। সরকারের মৎস্য বিভাগ মনে করছে, জাটকা রক্ষায় আরও কঠোরতা আরোপ এবং মৎস্যজীবীদের সচেতন করে প্রতি ইলিশের ন্যূনতম ওজন ৫শ’ গ্রাম নিশ্চিত করা গেলে উৎপাদন আরও ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ইলিশের উৎপাদন গত দেড় দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছিল ১ লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টন। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে উন্নীত হয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টনে। অথচ, এ সময়ের মধ্যে অন্যান্য দেশে উৎপাদন কমেছে। ইলিশ রফতানি থেকে আসছে বছরে প্রায় ৩শ’ কোটি মার্কিন ডলার। জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ, যা উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় আরও বাড়বে বলে আশাবাদ বিশেষজ্ঞদের। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) গবেষণা, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা এবং গৃহীত কর্মকৌশল মাঠ পর্যায়ে যথাযথ প্রয়োগের ফলে ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে বলে মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞ মহল। বাংলাদেশের ইলিশ উৎপাদন যে শুধু বাড়ছে তাই নয়, উৎপাদিত ইলিশ স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। সে কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী ইলিশ বেশ সমাদৃত। বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে যত ইলিশ উৎপাদিত হয় তার ৬৫ শতাংশই বাংলাদেশে। উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে অন্যান্য দেশের। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আসছেন বিভিন্ন দেশের সরকারী পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। তারা জানতে চাইছেন ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির নেপথ্যে গৃহীত পদক্ষেপ। ইলিশ অত্যন্ত আকর্ষণীয় মাছ হলেও বিশ্বের খুব বেশি দেশে এর উৎপাদন হয় না। প্রধানত ১১টি দেশে ইলিশ উৎপাদন হয়ে থাকে। এরমধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ। ক্রমানুসারে বাকি ১০টি দেশ হলো মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ড। তবে অন্য সকল দেশ মিলে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন করে তার সব মিলিয়েও বাংলাদেশের সমান নয়। বর্তমানে বিশ্বে বার্ষিক ইলিশ উৎপাদন ধরা হয়ে থাকে ৫ লাখ মেট্রিক টন বা সামান্য বেশি। এরমধ্যে বাংলাদেশে একক উৎপাদনই ৪ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি। প্রতিবছর এ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে ৯ থেকে ১০ শতাংশ হারে। বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতর বলছে, মোট মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ স্থান অধিকারী। এরমধ্যে ইলিশের অবদান উল্লেখযোগ্য। সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে মাছের উৎপাদন ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করার। এর জন্য প্রতিবছরে দেড়লাখ টন করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এরমধ্যে বেশ সফলতা এসেছে রুই, রাজপুঁটি, তেলাপিয়া এবং পাঙ্গাস চাষে। সাগরের মৎস্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভরসা ইলিশের ওপর। মা ইলিশ রক্ষার জন্য বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকায় তা অন্যান্য মাছের বংশ বিস্তারেও সহায়ক হয়েছে। সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদনও বাড়ছে। বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গতি এসেছে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর। এর ফলে সমুদ্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলের আয়তন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার। ব্লু ইকোনমির দিকে মনোযোগী হয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সমুদ্র থেকে মৎস্যসহ বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ আহরণে নানা প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। এরমধ্যেই সংগ্রহ করা হয়েছে মৎস্য জরিপ জাহাজ। অথচ, সতেরো বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটি বন্ধ ছিল। মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ। নতুন কেনা ‘আরভি মিন সন্ধানী’ নামের একটি জাহাজ নিয়ে এ জরিপ চালাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে রাশিয়া থেকে সংগৃহীত হয়েছিল একটি মৎস্য জরিপ জাহাজ। এরপর আনা হয় আরও দুটি। কিন্তু সবগুলো জাহাজই একপর্যায়ে অকেজো হয়ে পড়ায় মৎস্য জরিপের কাজটি চলছিল অনুমাননির্ভর। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মালয়েশিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয় মৎস্য জরিপ জাহাজ আরভি মিন সন্ধানী, যা গত বছরের ১৮ নবেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মৎস্য গবেষণা অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, জরিপ জাহাজটি সংযোজিত হওয়ার পর সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এখন জানা যাবে বঙ্গোপসাগরে কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে এবং মাছের বিচরণ কোন্ এলাকায় বেশি। কোন্ কোন্ স্থানে মাছের অভয়ারণ্য সৃষ্টি করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে তাও নির্দিষ্ট করা সহজ হবে। এদিকে, ইলিশের এ ভরা মৌসুমে এখন বঙ্গোপসাগরে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। সাইজেও বেশ ভাল। সাগরে যেন ইলিশ উৎসব। নগর থেকে শুরু করে মফস্বল পর্যন্ত সকল হাট বাজারেই এখন ইলিশের দেখা মিলছে। বড় সাইজের ইলিশের দাম বেশি হলেও মাঝারি সাইজের ইলিশ মোটামুটি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই। ইলিশ যে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ তা এ মৌসুমে বেশ যুক্তিযুক্তভাবে অনুভূত হয়। বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত ইলিশের একটি বড় অংশের অবতরণ হয় চট্টগ্রাম নগরীর ইকবাল রোডের ফিশারিঘাটে। প্রসিদ্ধ এ মাছ বাজারের মজুদের সিংহভাগই এখন ইলিশ। সেখান থেকে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। চট্টগ্রামের মৎস্য ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন সোনালী যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আমিনুল হক বাবুল সিকদার শুক্রবার জনকণ্ঠকে জানান, এখন সাগর থেকে আসা প্রতিটি বোটেই ইলিশ। ছোট নৌকা কিংবা বড় ট্রলার কোনটিই শূন্য অবস্থায় ফিরে আসছে না। সাইজভেদে প্রতিটি নৌকা ও ট্রলারে মাছ আসছে ২০ থেকে শুরু করে দেড়শ’ মণ পর্যন্ত। গড়ে ৬শ’ থেকে ৯শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশের দর প্রতিকেজি ৬শ’ থেকে ৭শ’ টাকা। ২শ’ থেকে ৪শ’ গ্রাম ওজনের প্রতিকেজি ইলিশের মূল্য ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। ১ কেজির বেশি ওজনের ইলিশের তুলনামূলক কম, এর মূল্য হাজার টাকা। সাগরে এখন অন্য কোন মাছ ধরা পড়ছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি ইলিশের মৌসুম। তবে লইট্যা মাছ ধরা পড়ছে প্রচুর পরিমাণ। এছাড়া ছোট চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছও ধরা পড়ছে কমবেশি। মূলত বাংলাদেশে এটিই মাছের মৌসুম। আগামী কয়েক মাস প্রচুর মাছ ধরা পড়বে। দামও সহনীয় পর্যায়ে থাকবে বলে অভিমত এই ব্যবসায়ীর।
×