ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মীম নোশিন নাওয়াল খান

সূর্য মেঘের বন্ধুত্ব

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৫ আগস্ট ২০১৭

সূর্য মেঘের বন্ধুত্ব

ব্যাগটা কোন রকমে নামিয়ে রেখেই ধপ করে সোফায় বসে পড়ল মুনিয়া। মামণি আঁচলে হাত মুছতে মুছতে পাশে এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, রেজাল্ট কী হলো? মুনিয়া চুপ করে রইল। মামণি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আজকে তোমার রেজাল্ট দেয়ার কথা ছিল না? মুনিয়া মাথা ঝাঁকাল। তারপর ব্যাগটা রেখেই দ্রুতপায়ে নিজের ঘরে চলে গেল। মামণি আর কিছু জানতে চাইলেন না। বললেন, গোসল করে এসো। টেবিলে খাবার দিচ্ছি। মুনিয়া গোসল করে বেরুল ঠিকই, কিন্তু খেতে এলো না। মামণি ডাকতে গিয়ে দেখলেন, বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে আছে মুনিয়া। মামণি তার পাশে গিয়ে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, রেজাল্ট খারাপ হয়েছে মুনিয়া? ঠিক আছে, মন খারাপ কর না। পরেরবার ভাল হবে। মুনিয়া এবার হু হু করে কেঁদে উঠল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আমাদের ক্লাসে যে মেয়েটা নতুন ভর্তি হয়েছে, ও ফার্স্ট হয়েছে মামণি। আমি সেকেন্ড হয়েছি। আমার রেজাল্ট আগের চেয়ে খারাপ হয়নি, ওই মেয়েটা বেশি ভাল রেজাল্ট করেছে। মামণি বললেন, তাতে কী হয়েছে? ও ভাল করেছে মানে তো এটা না যে তুমি খারাপ করেছ। তুমি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছ? মুনিয়া মাথা নেড়ে বলল, ওকে আমি সহ্য করতে পারি না মামণি। আগে আমি সব সময় ক্লাসে সবার আগে দাঁড়িয়ে পড়া বলতাম। এখন ও আমার আগেই বলে ফেলে। টিচাররা ওকে বেশি ভালবাসে। ওকে আমার একটুও সহ্য হয় না। আরও কী জানো মামণি? ও আবার আমার কাছে আসে বন্ধুত্ব করতে। আসলে ও আমার পড়াশোনার খোঁজ নেয়ার জন্য আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়, যেন আমার চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারে। মামণি হেসে ফেললেন। মুনিয়ার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, তুমি আর বড় হলে না মুনিয়া! আচ্ছা চলো তোমাকে একটা গল্প শোনাই। মন ভাল হবে। মুনিয়া কিছু বলল না। মামণি জিজ্ঞেস করলেন, শুরু করব? মুনিয়া এবারও চুপ থাকল। মামণি এবার গল্প শুরু করলেন : অনেক অনেকদিন আগের কথা। আকাশে তখন মেঘ ছিল না। চাঁদ ছিল না। শুধু সূর্য ছিল। দিনরাত পৃথিবী আলোকিত হত সূর্যের আলোয়। সূর্য একাই ছিল পুরো আকাশের রাজা। একদিন কোথা থেকে অনেকগুলো মেঘ উড়ে এলো। পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘগুলো আকাশের বুকে ভেলা হয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল। পৃথিবীর সব পশুপাখি, গাছপালা তাদের পছন্দ করতে শুরু করল। মুগ্ধ হয়ে তারা মেঘগুলোকে দেখত। মেঘগুলোকে দেখিয়ে বলত, ওগুলো কী সুন্দর, তাই নয়? সূর্যের তখন ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু সে অহঙ্কারের কারণে মেঘগুলোর সঙ্গে কোন কথা বলল না। মনে মনে রাগতে থাকল শুধু। দুই-তিনদিন পর ঘুরতে ঘুরতে কয়েকটা মেঘ সূর্যটাকে ঢেকে ফেলল। এবার তো সূর্য প্রচণ্ড রেগে উঠল। সে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? কোথা থেকে এসেছ? কেনই বা এসেছ? মেঘরা বলল, আমরা মেঘ। আমরা এই আকাশে থাকতে এসেছি। সূর্য তো তখন রেগে লাল হয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, এই আকাশ আমার। এখানে শুধু আমি থাকব। তোমরা এখানে কেন এসেছ? একটা মেঘ বলল, আকাশটা তো অনেক বড়। তুমি থাক, আমরাও থাকি। আমরা তো তোমার কোন ক্ষতি করছি না ভাই। সূর্য বলল, না। এই আকাশে শুধু আমিই থাকব। তোমরা না। পৃথিবীর পশুপাখি আর গাছেরা শুধু আমাকে ভালবাসবে, আর কাউকে না। সূর্যটা মেঘগুলোকে খুব বকল। মেঘগুলোকে সে তাড়িয়েই দিল। তারপর মনের আনন্দে আকাশের বুকে ঝলমল করতে লাগল। পরেরদিন সকালে যখন পৃথিবীর পশুপাখি আর গাছপালারা মেঘেদের দেখতে পেল না, তারা বলাবলি করতে লাগল, ইশ! মেঘগুলোর আড়ালে সূর্যটাকে কী সুন্দরই না লাগত! মেঘের আড়াল থেকে সূর্যটা যখন আলো ছড়াত, মনে হতো যেন আকাশে স্বর্গ নেমে এসেছে। কোথায় গেল মেঘগুলো? একটা পাখি আরেকটা পাখিকে বলল, সূর্যটা বড্ড একা হয়ে গেছে। মেঘগুলো কোথায় যে চলে গেল! অন্য পাখিটা বলল, আর তাছাড়া মেঘগুলোকে ছাড়া পৃথিবীটা কেমন গরম হয়ে থাকে। মেঘেরা থাকলে সূর্যের আলোটা খুব মিষ্টি লাগত। এখন সেই রোদ যেন পুড়িয়ে দেয় সবকিছু। সবার কথা শুনে সূর্যের মনে হলো, মেঘগুলো থাকলেই ভাল হতো। সত্যিই তো, মেঘেদের সঙ্গে একসঙ্গে তাকে খুব সুন্দর লাগে। মেঘেদের ওপর যখন তার আলো পড়ে, মেঘগুলো ঝলমল করে ওঠে। কখনও কমলা দেখায়, কখনও সোনালি দেখায় শুভ্র মেঘগুলোকে। ভালোই তো লাগে। মেঘগুলো তো আসলে তার কোন ক্ষতি করেনি। বরং তাকে আরও সুন্দর করেছে। সূর্য বাতাসকে ডেকে বলল, মেঘেদের ডেকে আনো না ভাই। বলো, আমি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই। বাতাস মেঘেদের ডেকে আনল। মেঘেরা আকাশে এলো। সূর্যের কথা শুনে তারা আনন্দে কেঁদে ফেলল। তাদের কান্নায় পৃথিবীতে নামল অঝোর বৃষ্টি। আর বৃষ্টির পর সূর্যের আলো মেখে আকাশের গায়ে উঠল একটা বিশাল বড় রংধনু। সেই রংধনুটা হচ্ছে মেঘ আর সূর্যের বন্ধুত্বের প্রতীক। সেই থেকে এখনও বৃষ্টির পর রংধনু ওঠে মেঘ আর সূর্যের বন্ধুত্বের গল্প শোনাতে। গল্প শেষ করে মামণি মুনিয়ার দিকে তাকালেন। সে চোখ বড় বড় করে গল্প শুনছে। মামণি বললেন, কেউ কারোর জায়গা নেয় না মুনিয়া। বরং মেঘ আর সূর্যের মতো তুমি আর তোমার নতুন সহপাঠী যদি বন্ধুত্ব কর, তাহলে তোমরা দু’জনই দু’জনের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখবে। দু’জনে মিলে সেরা হবে। সবাই তোমাদের দু’জনকে ভালবাসবে। তোমাদের দেখিয়ে বলবে, ওই দুই বান্ধবী সবকিছুতেই সেরা, আর ওদের বন্ধুত্বটাও কী চমৎকার! আমি যেমন সূর্য আর মেঘের বন্ধুত্বের গল্প বললাম, তেমন সবাই তোমাদের বন্ধুত্বের গল্প থেকে উৎসাহিত হবে। তোমরা দুজন মিলে অনেক ভাল কাজ করবে, ভাল করে পড়াশোনা করবে আর পৃথিবীটাকে সুন্দর করে তুলতে একসঙ্গে কাজ করবে। মুনিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর চোখ মুছে বলল, আমি খাওয়া দাওয়া সেরে তন্বীদের বাসায় যাব। মামণি জিজ্ঞেস করলেন, তন্বী কে? মুনিয়া বলল, আমার নতুন বান্ধবী। আমার বাগানে আজকে বেলি ফুল ফুটেছে না মামণি? আমি ফুলগুলো দিয়ে ওকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আসব আর ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে আসব। মেঘ আর সূর্যের বন্ধুত্বের প্রতীক যেমন রংধনু, তেমন আমাদের বন্ধুত্বের প্রতীক হবে বেলি ফুল। ভাল হবে না মামণি? ভিকারুননিসা নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ১ম বর্ষ (ইংরেজী ভার্সন)
×