ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাড়ে ৩ মাস আগে আদালতে খুনের আশঙ্কা প্রকাশ করেন পারভীন

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৫ আগস্ট ২০১৭

সাড়ে ৩ মাস আগে আদালতে খুনের আশঙ্কা প্রকাশ করেন পারভীন

স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ আদালতকে খুনের আশঙ্কা জানিয়েছিলেন গৃহবধূ পারভীন বেগম। আদালতে বলেছিলেন, যে কোন মুহূর্তে তিনি ও তার স্বামী দেলোয়ার মোল্লা খুন হতে পারেন। আদালত আদেশ দেয়ার আগেই পারভীন বেগমের আশঙ্কা নির্মম সত্যে পরিণত হয়েছে। কেবল স্বামীসহ পারভীন বেগম খুন হননি। তাদের সঙ্গে খুনের শিকার হয়েছে তাদের একমাত্র মেয়ে কাজলী বেগমও। খুনীরা এ তিনজনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে হত্যা করেছে। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, ৬ মাস আগে সংঘটিত একটি হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেয়ায় এ তিনজনকে খুন করা হয়েছে। এর আগে একই হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেয়ায় অপর এক মহিলার বাড়িঘর প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পটুয়াখালীর গলাচিপায় চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডার হত্যাকা-ের অনুসন্ধানে পুলিশসহ একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। থানায় দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার বিকেলের মধ্যে যে কোন সময়ে গলাচিপা উপজেলার আমখোলা ইউনিয়নের ছৈলাবুনিয়া গ্রামে ট্রিপল মার্ডারের এ ঘটনা ঘটে। খুনীরা নির্মমভাবে কুপিয়ে কৃষক দেলোয়ার মোল্লা (৬৫), স্ত্রী পারভীন বেগম (৫৫) ও মেয়ে কাজলী বেগমকে (১৫) হত্যা করে। এ ঘটনার ৬ মাস আগে এ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি নিহত দেলোয়ার মোল্লার বড় ভাই ইদ্রিছ মোল্লার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলে শফি মোল্লা ওরফে মাহিনকে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের লোকজন কুপিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে। ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় শফি মোল্লা মারা যায়। এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের হয়। এ হত্যা মামলায় অন্যান্যের মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন দেলোয়ার মোল্লা ও তার স্ত্রী পারভীন বেগম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষ। আর এতেই জীবন নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন পারভীন বেগম। গত ১২ এপ্রিল পারভীন বেগম পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারায় একটি মোকদ্দমার মাধ্যমে বিস্তারিত অবহিত করেন। যার নম্বর এমপি ১৫৮/১৭। ওই অবহিতকরণ মোকদ্দমায় পারভীন বেগম ৩২ জনের নাম উল্লেখ করে সরাসরি আসামি করেন। মোকদ্দমার আবেদনে আদালতকে পারভীন বেগম বলেন, আসামিরা তাকে ও তার স্বামী দেলোয়ার মোল্লাকে নিয়মিত খুনের হুমকি দিচ্ছে। বাড়িঘর দখলের হুমকি দিচ্ছে। বসতঘরের মালামাল লুট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। তার ভাসুর ইদ্রিছ মোল্লাকেও খুনের হুমকি দিচ্ছে। এ মোকদ্দমার আইনজীবী মোঃ শামীম মিয়া জানান, আদালত এ মোকদ্দমায় কোন আদেশ দেয়নি। বাদীর আবেদন অনুযায়ী কেবল নথিভুক্ত করে রেখেছে। খুনের আশঙ্কা প্রকাশ করে মোকদ্দমা দায়েরের মাত্র সাড়ে তিন মাসের মাথায় পারভীন বেগম স্বামী ও মেয়েসহ খুন হন। এদিকে, শফি মোল্লা হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ফুফু পিয়ারা বেগম। নিহত শফি মোল্লার বাবা ইদ্রিছ মোল্লার বোন পিয়ারা বেগমের বাড়িও ছৈলাবুনিয়া গ্রামে। পিয়ারা বেগম সাক্ষ্য দেয়ার পাশাপাশি পটুয়াখালী পুলিশ সুপারের কাছে তার ভাইয়ের ছেলে শফি মোল্লা হত্যার যাতে সুষ্ঠু তদন্ত হয় এজন্য আবেদনও করেছিলেন। এতেও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষ। গত ২৫ মার্চ সকালে প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষের লোকজন পিয়ারা বেগমের বসতঘর আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। এ ঘটনায় পিয়ারা বেগম বাদী হয়ে ৩ এপ্রিল গলাচিপা উপজেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। যার নম্বর-সিআর ২৩০/১৭। এ মামলারও আইনজীবী মোঃ শামীম মিয়া। তিনি বলেন, আদালতের বিচারক মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইকে তদন্তের আদেশ দেয়। পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছে বলে জানতে পেরেছি। তবে তার কপি এখনও হাতে পাইনি। তাই বিস্তারিত বলতে পারছি না। অপরদিকে, ট্রিপল মার্ডার মামলার বাদী ইদ্রিস মোল্লা জানান, তার চাচাত ভাই বজলু মোল্লার সঙ্গে তার আপন বোন রোকেয়া বেগমের বিয়ে হয়। জমিজমা নিয়ে তার চাচাত ভাই বজলু মোল্লার সঙ্গে দীর্ঘ দিনের বিরোধ। তিনি বেঁচে নেই কিন্তু তার সাত ছেলের সঙ্গে সেই বিরোধ রয়ে গেছে। সেই বিরোধের জের ধরে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে শফি মোল্লার ওপর হামলা চালায়। ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছেলে শফির মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে বজলু মোল্লার ছেলেদের আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। শফি হত্যা মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিলেন তার ভাই দেলোয়ার মোল্লা ও তার ভাবি পারভীন বেগম। তিনি বলেন, ছেলে হত্যার পর নিজের নিরাপত্তার জন্য নিজ বাড়ি ছেড়ে পটুয়াখালীতে শ্বশুরবাড়ি বসবাস করছি। তার অবর্তমানে ঘরে ভাই-ভাবি তাদের মেয়ে নিয়ে থাকতেন। মূলত হত্যা মামলা থেকে রেহাই পেতেই আসামিরা তিনজনকে খুন করেছে। গলাচিপার চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডার মামলায় পুলিশ এখনও কোন আসামি গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে তদন্তের সঙ্গে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সবদিক বিবেচনায় রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে শফি মোল্লা হত্যার বিষয়টি এ মুহূর্তে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। শফি মোল্লা হত্যার ধারাবাহিতায় যে ট্রিপল মার্ডার ঘটেছে, তা প্রাথমিকভাবে অনেকটাই প্রমাণিত। এছাড়া, খুনীরা কোন পথে এবং কিভাবে ঘরে ঢুকেছে তাও বিবেচনা করা হচ্ছে। জানা গেছে, বর্তমানে পুলিশের পাশাপাশি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও ঘটনাটি তদন্ত করছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সাইদুল ইসলাম জানান, সহসাই মামলার রহস্য উন্মোচিত হবে বলে আশা করছি।
×