ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ ॥ ভাংচুর, গাড়িতে আগুন ॥ টিয়ারশেল

গৃহকর্মীর মৃত্যু ঘিরে বনশ্রীতে তুলকালাম

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৫ আগস্ট ২০১৭

গৃহকর্মীর মৃত্যু ঘিরে বনশ্রীতে তুলকালাম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর বনশ্রীতে একটি বাড়ি থেকে এক গৃহবধূকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধারের পর মৃত্যুর ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভকালে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর ও একটি গাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বাড়ি মালিকের ফাঁসি দাবিতে বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। বাড়ির মালিকের নির্যাতনের কারণেই ওই গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন বলে বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ। বিক্ষোভের কারণে বনশ্রীসহ আশপাশের রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। রাত আটটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিক্ষোভ চলছিল। এতে ওই এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। বাড়ির মালিক মুন্সী মইনুদ্দিন ও দারোয়ানকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার সকাল নয়টার দিকে ঘটনার সূত্রপাত। রাজধানীর রামপুরা থানার শেষ সীমানায় অবস্থিত খিলগাঁও থানাধীন বনশ্রীর জি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর সাততলার বাড়ির নিচ তলার একটি কক্ষ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় গৃহবধূ লাইলী আক্তারকে (২৫) উদ্ধার করে পুলিশ ও স্থানীয়রা। দ্রুত ওই গৃহবধূকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নেয়া হয়। হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসকরা লাইলীকে সকাল দশটার দিকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর পুলিশ লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। বাসিন্দাদের দাবি, লাইলী বাড়িটির নিচতলার ভাড়াটিয়া মইনুদ্দিনের বাসায় গৃহকর্মী ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রায় সাত মাস ধরে মইনুদ্দিনের বাসায় কাজ করছিলেন। তাকে অনেকেই চেনেন। তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন। লাইলীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তার মৃত্যু নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলতে থাকে। মানুষের মধ্যে নানা কথাবার্তা চলতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে লাইলীকে বাড়ির মালিক কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই শত শত মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। জুমার নামাজের সময় আশপাশের বিভিন্ন মসজিদের যাওয়া মুসল্লিদের মধ্যেও এ নিয়ে নানা কথাবার্তা চলতে থাকে। লাইলীর মৃত্যু নিয়ে নানা খবর প্রকাশের কারণে পুরো এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। বেলা তিনটার দিকে পুরো এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেই বিক্ষোভে যোগ দেন নারী, পুরুষ, শিশুসহ প্রায় সকলেই। অন্তত পাঁচ হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ বাড়িটির দিকে রওনা হন। তারা বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে সেøাগান দিতে থাকেন। বিক্ষোভকারীরা বাড়ির মালিকের ফাঁসি দাবি করেন। পরবর্তীতে পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়, ওই গৃহবধূকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের তরফ থেকে এ বিষয়ে মাইকিং করা হয়। তাতেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। এরপর বিক্ষোভকারীরা দাবি করেন, বাড়ির মালিকের অমানুসিক পৈচাশিক নির্যাতনের কারণে ওই গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন। বাড়ির মালিকের নির্যাতন সইতে না পেরেই উপায়ান্তর না দেখে লোকলজ্জার ভয়ে ওই গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন বলে বিক্ষোভকারীরা সেøাগান দিতে থাকেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দ্রুত বাড়িটি ঘিরে ফেলে পুলিশ। তারপরও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা বাড়ির আশপাশে অবস্থান নেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে। তাতেও বিক্ষোভকারীরা পিছু হটে না। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা বাড়িতে হামলা চালায়। তারা বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। অনেক বিক্ষোভকারী তাদের জুতা ছুড়ে মারেন। এ সময় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে করে পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিক্ষোভকারীরা বনশ্রীর আশপাশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়। দুর্ভোগে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। বন্ধ হয়ে যায় সব দোকানপাট। থেমে যায় যানাবাহন চলাচল। বিক্ষোভকারীরা কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর করে। একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুইটি ইউনিট সেখানে হাজির হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বনশ্রী এলাকায় যাওয়া মাত্র বিক্ষোভকারীরা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির গতিরোধ করে। তারা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে বাধা দেয়। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটি গাড়ি প্রায় পুরো পুড়ে যায়। যদিও গাড়িতে থাকা যাত্রীরা আগে নেমে যান। ফলে কোন প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেনি। বিক্ষোভকারীরা বাড়ির আশপাশে অবস্থান নিয়ে বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এমন পরিস্থিতিতে বাড়ির অন্যান্য তলায় থাকা বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বাড়ির অনেক বাসিন্দা বিক্ষোভের দাবানল থেকে বাড়ি থেকে অন্যত্র চলে যান। তারা নিজেদের আড়াল করতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে মিশে যান। তারাও বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে সেøাগান দিতে থাকেন। বিক্ষোভকালে অনেক বিক্ষোভকারী ওই বাড়ির বাসিন্দাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাড়ির বাসিন্দারা অজানা আতঙ্কে বিষয়টি এড়িয়ে যান। তারা অন্যত্র নিরাপদ জায়গায় চলে যান। রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী সাহান হক জনকণ্ঠকে বলেন, অন্তত ৫ হাজার বিক্ষোভকারী বাড়িটির আশপাশে অবস্থান করছে। তারা বাড়ির মালিকের ফাঁসি দাবি করছে। বিক্ষোভকারীরা বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপের পাপাশাশি বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের কোনক্রমেই থামানো যাচ্ছে না। বিক্ষোভের কারণে বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত পুরো এলাকার জীবনযাত্রা ব্যাহত ছিল। রাত আটটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিক্ষোভ চলছিল বলে জনকণ্ঠকে জানান রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী সাহান হক। বিক্ষোভকারীরা যানবাহন ভাংচুরসহ একটি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আশপাশের সব থানার পুলিশ মোতায়েন রয়েছে এলাকাটিতে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, লাইলীর বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়িয়া থানাধীন আজুয়াটালী গ্রামে। তার স্বামীর নাম নজরুল ইসলাম। নজরুল ইসলাম বছরখানেক আগে ভারত থেকে দেশে আসার পথে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। পুলিশ জানায়, দরজা ভেঙ্গে লাইলীকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকালে লাইলী ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচানো অবস্থায় ঝুলছিল। তিনি খিলগাঁও থানাধীন বনশ্রী হিন্দুপাড়ার একটি বস্তিতে সন্তান নিয়ে ভাড়ায় বসবাস করতেন। লাইলীর গলায় কালো দাগ রয়েছে। তবে মইনুদ্দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, প্রতিদিনের মতো সকালে বাসায় কাজ যায় লাইলী। যাওয়ার পর আচমকা একটি কক্ষে ঢুকে পড়ে। দ্রুত ওই কক্ষের দরজা বন্ধ করে দেয়। অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা খুলছিল না লাইলী। পরে বাড়ির ম্যানেজার এসে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে। লাইলীকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় ঝুলে থাকতে দেখা যায়। পুলিশকে খবর দেয়া হয়। পুলিশ এসে লাইলীকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা লাইলীকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, লাইলীর গলায় কালো দাগ রয়েছে। শরীরের অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়নি।
×