ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী;###; তিনি বললেন, এই কন্সটিটিউশনাল এ্যামেন্ডমেন্টটা আমরা আবার পাস করব, অনবরত করতে থাকব

সুপ্রীমকোর্টে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গ ফের বিল পাস হবে

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ৫ আগস্ট ২০১৭

সুপ্রীমকোর্টে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গ ফের বিল পাস হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিচারপতি অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করছে বলেই মনে হচ্ছে। এ নিয়ে প্রধান বিচারপতি ও সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকদিন ধরেই বাদানুবাদ চললেও এসব বাদানুবাদ থেকে সরকারের সঠিক অবস্থান ফুটে ওঠেনি। মূলত, শুক্রবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্য থেকেই এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘বিচারপতি অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আদালত যতবার বাতিল করবে ততবারই সংসদে এই সংশোধনী পাস করা হবে।’ অর্থমন্ত্রী সরকারের একজন নীতিনির্ধারক এবং মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্য। সেই সঙ্গে জাতীয় সংসদের একজন প্রবীণ সদস্যও বটে। তার এই বক্তব্যের মধ্যদিয়ে শুধু সরকারের অবস্থানই নয়, জাতীয় সংসদের অভিমতও ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, বিচারপতিদের চাকরি সংসদই দেয়, সুতরাং তাদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই থাকা উচিত। তিনি আরও বলেছেন, ‘বিচারকরা জনগণের প্রতিনিধিদের ওপর খবরদারি করেন। অথচ আমরা তাদের নিয়োগ দেই। বিচারকদের এমন আচরণ ঠিক নয়।’ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে করা সরকারের আপীল গত ৩ জুলাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ খারিজ করে দেন। যার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট গত মঙ্গলবার প্রকাশ হয়েছে। এর ফলে উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত রইল বলেই আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছিলেন। কিন্তু ওই রায় প্রকাশের পর সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ স্পষ্ট হচ্ছিল না। এখন অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যদিয়ে সেই অবস্থান স্পষ্ট হলো। বিশেষ করে, বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণার পর সরকার যে হাল ছেড়ে দেয়নি, সেটাই স্পষ্ট হয়েছে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্যদিয়ে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট, তাহলো সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে নতুন করে বিরোধের সূত্রপাত হয়েছে। এটা যে খুব সহজে থামছে না সেটাও ফুটে উঠেছে। কারণ, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘এটা আমরা এ্যাসেম্বলিতে আবার পাস করব..এই আইনটা। এই কন্সটিটিউশনাল এ্যামেন্ডমেন্টটা আমরা আবার পাস করব এবং অনবরত করতে থাকব। দেখি জুডিশিয়ারি কতদূর যায়।’ সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর ইস্যুটি যে এখানেই থেমে যাচ্ছে তা নয়। ইস্যুটি চলমান থাকবে। শেষ পর্যন্ত এটি বিচার বিভাগ ও জাতীয় সংসদের একটি মর্যাদার ইস্যুতে পরিণত হতে পারে। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। বিলটি পাসের পর ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে এই রিট আবেদন হয়। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নবেম্বর রুল দেয়। সেই রুলের ওপর ১৭ দিন শুনানির পর সুপ্রীমকোর্টের নয়জন আইনজীবীর এক রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১৬ সালে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। গত ৩ জুলাই আপীল বিভাগেও ওই রায় বহাল থাকে, যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি মঙ্গলবার (১ আগস্ট) প্রকাশ করা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়ের ফলে সুপ্রীমকোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা আবারও জাতীয় সংসদ থেকে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোন পরিবর্তন আসেনি। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়। বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ে সংক্ষুব্ধ রাষ্ট্রপক্ষ। তারা বলছেন, স্থগিতের জন্য আপীল বিভাগে যাবে। আর আইনজীবীরা বলছেন, এ বিষয়ে সাধারণত চেম্বার জজ স্থগিত আদেশ দেন না। কারণ, আইন চ্যালেঞ্জ করলে সেখানে স্থগিত আদেশ হয় না। এরপর বাস্তবে কী ঘটতে পারে, এ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও রিটকারী পক্ষের মধ্যে চলছে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর সংসদে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি সংসদে বলেছেন, হাইকোর্টের রায় অবৈধ। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করব। আপীল করলে এ রায় গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। এখনও বিশ্বাস করি বিচার বিভাগ স্বাধীন। সে জন্য আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আইনী পথেই যাব। আমরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র সহ্য করব না। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের প্রসঙ্গ টেনে আইনমন্ত্রী বলেছেন, আমরা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে এই সংশোধনী করেছি। কিন্তু উনারা রায়ে বলে দিলেন, এটা ইলিগ্যাল। এখনও আমি বলি, এটা মোটেও ইলিগ্যাল নয়। উনারা যেটা বলছেন, সেটা নট মেইনটেন্যাবল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা যদিও মনে করেন, চেম্বার জাজের কাছে স্থগিত আদেশ চাওয়ার সুযোগ আছে। পরবর্তী প্রক্রিয়ার বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, এ আদেশ আমাদের সংক্ষুব্ধ করেছে। রায়ে আমাদের আপীলের সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। এই রায় স্থগিতের জন্য চেম্বার আদালতে আবেদন করব। এদিকে, রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছেন, সংক্ষুব্ধ যে কেউ চাইলেই আদালতের কাছে যে কোন আবেদনই নিয়ে যেতে পারেন। আমরা শুনানিতে অংশ নেব এবং আইন চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে স্থগিত আদেশ দেয়ার সুযোগ নিয়েই আমরা কথা বলতে চাই।
×